পুরভোটের মুখে জলের আকাল নিয়ে পুরুলিয়ায় ইতিমধ্যেই অস্বস্তির মুখে শাসকদল। জলের দাবিতে অবরোধ-আন্দোলনও শুরু হয়ে গিয়েছে। এই অবস্থায় তড়িঘড়ি পুরুলিয়া শহরে জল পৌঁছে দিতে সরকারি ভাবে জমি অধিগ্রহণ না করেই গ্রামবাসীদের জমিতে পাইপলাইন বসানোর অভিযোগ উঠল প্রশাসনের বিরুদ্ধে। যার জেরে আরও অস্বস্তিতে পড়ল তৃণমূল।
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুক্রবার পুরুলিয়া শহরের উপকণ্ঠে চাকদা গ্রামে উত্তেজনা ছড়ায়। মাটির নীচে পাইপলাইন বসানোর জন্য এ দিন সকালে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ শুরু হতেই বেশ কয়েক জন জমি-মালিক কাজের জায়গায় শুয়ে পড়েন। ফলে বন্ধ হয়ে যায় কাজ। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পুলিশ পৌঁছয়। পৌঁছন প্রশাসনিক কর্তারাও। বিকেল অবধি দফায় দফায় গ্রামবাসীদের সঙ্গে প্রশাসনিক কর্তাদের আলোচনা চলে। দিনের শেষে অবশ্য প্রশাসন দাবি করেছে, আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হয়েছে। কাজ চলার ক্ষেত্রে আপাতত কোনও বাধা নেই।
পুরুলিয়া শহরে পানীয় জলের সমস্যা মেটাতে তৃণমূল পরিচালিত পুরসভা ২০১৩ সালে নতুন জলপ্রকল্প তৈরির কাজে হাত দেয়। শহরের উপকণ্ঠে থাকা কংসাবতী নদী থেকে জল তুলে শহরের বাসিন্দাদের পানীয় জলের চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যেই শুরু হয়েছিল প্রকল্প। কিন্তু, সেই প্রকল্প এখনও বিশবাঁও জলে। শহর জুড়ে পাঁচটি জলাধার নির্মাণ হয়ে গেলেও নদীতে জল নেই। নদীতে যে এই সময় জল থাকে না, বিগত বছরগুলির অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে পুরসভা তেলেডি এলাকার (যেখানে বর্তমান জল প্রকল্পের পাম্পিং স্টেশন রয়েছে) অদূরে কংসাবতী নদীতে একটি চেকড্যাম তৈরির কাজ শুরু করে। উদ্দেশ্য ছিল, এই চেকড্যামে জল ধরে রেখে এই জলাভাবের সময় বাসিন্দাদের কাছে আরও কিছুটা বেশি জল পৌঁছে দেওয়া।
পুরসভা সূত্রের খবর, চেকড্যামের কাজ শেষের পথে। সমস্যা দেখা দিয়েছে এই ড্যাম থেকে জল ট্যাঙ্কে পৌঁছনো নিয়ে। ড্যাম থেকে ট্যাঙ্ক অবধি প্রায় এক কিলোমিটার এলাকায় পাইপলাইন বসানোর কাজ করতে হবে পুরসভাকে। যে জমির নীচে পাইপ বসানো হবে, তা চাকদা গ্রামের কয়েক জন বাসিন্দার। তাঁদের জমির নীচে জলের পাইপ বসবে জেনে কিছুদিন আগেই জমির মালিকেরা পুরসভাকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেন, জমির উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের পাশাপাশি তাঁদের চাকরি দিতে হবে। জমি-মালিকদের দাবি, পুরসভা তাঁদের চিঠি পেয়ে দাবির ব্যাপারে আশ্বাস দেয়।
বিষয়টি আশ্বাসের মধ্যেই আটকে ছিল। কিন্তু শহরে ভোটের মুখে তীব্র জলাভাব দেখা দিতেই পরিস্থিতি বদলে যায়। এমনিতে জলের সঙ্কট নতুন কিছু নয় পুরুলিয়ায়। ফি-বছর একই ছবি দেখা যায় এই সুখা জেলার বিভিন্ন প্রান্তে। কিন্তু, এ বার যেন সঙ্কটের তীব্রতা বেশি। গরমের শুরু থেকেই জলের আকাল দেখা দিয়েছে জেলায়। আর পুরভোটের মরসুমে এই সমস্যার জন্য লাগসই কোনও যুক্তিও খাড়া করতে পারছে না তৃণমূল। জলাভাবের কারণে ইতিমধ্যেই পরের পর জাতীয় সড়ক অবরোধ, কোথাও ভোট বয়কটের ডাকও দিয়েছেন শহরবাসী। অস্বস্তিতে পড়ে ওই চেকড্যাম থেকে তড়িঘড়ি জল শহরে পৌঁছতে তৎপর হয়ে ওঠে পুরসভা তথা শাসকদল। শহরে জলাভাবের বিষয়টি মাথায় রেখে বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করে প্রশাসনও।
যদিও ঘটনা হল, তিন দিন আগে পাইপলাইন পাতার জন্য খোঁড়াখুঁড়ির কাজ শুরু হতেই চাকদা গ্রামে ক্ষোভ ছড়াতে শুরু করে। কাজ শুরু করায় আপত্তি জানান জমি-মালিকেরা। তাঁদের বক্তব্য, কত পরিমাণ জমি প্রশাসন বা পুরসভা নিচ্ছে, তা তাঁদের জানানো হয়নি। ক্ষতিপূরণের বিষয়েও তাঁরা অন্ধকারে। অথচ কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। বৃহস্পতিবার পুলিশি প্রহরায় কাজ হলেও শুক্রবার সকালে কাজের জায়গায় শুয়ে পড়েন ক্ষুব্ধ জমি-মালিকদের কয়েক জন। তাঁরা দাবি করেন, ‘‘প্রশাসন এখনও আমাদের কিছুই জানায়নি, আমাদের কার কার কত জমি নেওয়া হচ্ছে বা আমরা কতটা ক্ষতিপূরণ পাব।’’ কাজ বন্ধের খবর পেয়ে পুরুলিয়া মফস্সল থানা থেকে পুলিশ পৌঁছয়। কিন্তু জমির মালিকেরা তাঁদের দাবিতে অনড় থাকেন। পৌঁছন বিডিও (পুরুলিয়া ১) স্বপন মাইতি, পুরুলিয়ার (সদর) মহকুমাশাসক সৌম্যজিৎ দেবনাথ, জেলা পুলিশের ডিএসপি(শৃঙ্খলা ও প্রশিক্ষণ) কুন্তল বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁরা জমি-মালিকদের সঙ্গে আলোচনা করেন।
জমির মালিক সঞ্জীব গরাঁই, সবের্শ্বর মাহাতোরা প্রশাসনিক আধিকারিকদের কাছে দাবি তোলেন, ‘‘কার কতটা পরিমাণ জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে ও ক্ষতিপূরণের পরিমাণ কত, সে সম্পর্কে প্রশাসনকে লিখিত প্রতিশ্রুতি দিতে হবে।’’ তাঁরা এ-ও জানিয়ে দেন, কোনও জনপ্রতিনিধির কাছ থেকে লিখিত প্রতিশ্রুতি নেবেন না। তা দিতে হবে প্রশাসনকেই! জেলাশাসক তন্ময় চক্রবর্তী জানিয়েছেন, জমি অধিগ্রহণ আইন এখন নেই। তাই কার কত জমি এই পাইপলাইন পাতার জন্য নেওয়া হচ্ছে, তা আগাম জানানো হয়নি। প্রশাসনকে প্রয়োজনীয় জমি কিনে নিতে হবে। জমির নীচে পাইপ বসার পরে মাপ করে দলিল দেখে জমির দাম দিয়ে দেওয়া হবে। এ কথা বাসিন্দাদের জানানো হয়েছে।
চাকদা গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলছেন প্রশাসনিক আধিকারিক। — নিজস্ব চিত্র।
জেলাশাসক আরও বলেন, ‘‘ওই গ্রামের লোকজনের দাবি ছিল, তাঁদেরও পানীয় জল দিতে হবে। আমরা সেই ব্যবস্থাও করে দিয়েছি। এ দিন বিডিও জমি মালিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। আশা করি সমস্যা মিটে যাবে।’’ তাঁর মতে, পুরুলিয়া শহরের জলের সমস্যার সমাধানের বিষয়টি এখন এইটুকু জমিতেই আটকে রয়েছে। ড্যামে জল রয়েছে, ট্যাঙ্কও তৈরি। শুধু প্রয়োজন রিজার্ভারের সঙ্গে ড্যামের সংযোগ। জেলা প্রশাসনের এক কর্তা আবার এই ঘটনার সঙ্গে রঘুনাথপুরে ডিভিসি-র তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পে ‘ওয়াটার করিডর’ (জল আনার পাইপ বসানো)-এর কাজ জমিদাতাদের বারবার বাধা দেওয়ার ঘটনার মিল খুঁজে পাচ্ছেন।
পুরুলিয়ার তৃণমূল বিধায়ক কে পি সিংহদেও বলেছেন, ‘‘গ্রামবাসীরা উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ চাইছেন। আমরা বলেছি, সরকার তা দেখবে। তাঁরা জল দাবি করেছেন। সরকার সেটাও দেখবে। কিন্তু, আমরা ওঁদের জানিয়েছি, সরকারি বিধি মোতাবেক চাকরি দেওয়া সম্ভব নয়।’’ আলোচনার পরে জমি-মালিকেরা চাকরির দাবি থেকে সরে এসেছেন বলে বিধায়কের দাবি।
সত্যিই কি সরে এসেছেন? জমির মালিকদের একাংশ বিষয়টি নিয়ে আদালতে যাওয়ার কথাও ভাবছেন।