এখানেই পড়েছিল কৈলাস মাহাতোর দেহ।—নিজস্ব চিত্র
আঁচ করতে পারেননি কেউ। কিন্তু তদন্তে নেমে একের পর এক জাল কাটতে কাটতে পুলিশ যখন খুনে জড়িত বলে তার নাম পেয়েছিল, তাজ্জব হয়ে গিয়েছিল।
বছর তিনেক আগে সাঁওতালডিহি বস্তির এক হত্যা-রহস্যের কিনারা করতে নেমে পুলিশকে গোড়া থেকে পুরোদস্তুর বিভ্রান্ত করেছিল নিহতেরই এক আত্মীয়। অপরাধীদের ধরতে কী ভাবে পুলিশ সে বার জাল গুটিয়েছিল, তা এখন শিক্ষানবীশ পুলিশ কর্মীদের কাছে গল্পচ্ছলে অনেকেই আলোচনা করেন।
সাঁওতালডিহি থানার কেস নম্বর ১২/১৩। ২০১৩ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি রাতে মদের আসরে নৃশংস ভাবে খুন হয়ে গিয়েছিলেন সাঁওতালডিহি বস্তির বাসিন্দা কৈলাস মাহাতো। পরের দিন ভোজুডি কোল ওয়াশারি রেলগেটের কাছে বিদেশি মদের দোকানের পিছনের দিকে জঙ্গলে তাঁর ক্ষতবিক্ষত দেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ বেশ কয়েকটি মদের বোতল, প্লাস্টিকের গ্লাস উদ্ধার করে। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ বুঝতে পারে, আসরে বিবাদের জেরেই খুনের ঘটনা। দেহের পাশে পড়েছিল মদের ভাঙা বোতল। যা দেখে পুলিশের সন্দেহ হয়েছিল, বোতল ভেঙে তা দিয়েই গলার নলি কেটে, কৈলাসকে তাঁর সঙ্গীরা কুপিয়ে খুন করেছে। কিন্তু এর বেশি কিছু সূত্রে গোড়ায় পুলিশের হাতে আসেনি। মৃতের পরিবারও আততায়ীদের সম্পর্কে কোনও সম্ভাব্য তথ্য পুলিশকে জানাতে পারেনি। অজ্ঞাত পরিচয়রা খুন করেছে বলে অভিযোগ দায়ের হয়েছিল। ফলে তদন্ত নেমে কার্যত বিশবাঁও জলে পড়েছিল সাঁওতালডিহি থানার পুলিশ।
পুলিশ কর্মীরা জানাচ্ছেন, তদন্তের কাজে লাগতে পারে এমন কোনও তথ্য-প্রমাণ না থাকায় স্বভাবতই তদন্ত কিছুটা ঢিমেতালে চলছিল। মাসের পর মাস গড়িয়েছে, ঘটনার কিনারা দূরঅস্ত্ ঘটনায় জড়িত সন্দেহভাজনদের গ্রেফতার বা আটক পর্যন্ত করতে পারেনি পুলিশ। এ দিকে পুলিশের উপরতলা থেকে ঘটনার কিনারা করতে চাপ বাড়ছিল থানার উপরে। জেলা পুলিশের এক কর্তার কথায়, ‘‘সাঁওতালডিহি থানার ওই খুনের ঘটনার তদন্তে নেমে কোনও জোরালো ক্লু মিলছিল না, যার সূত্র ধরে তদন্ত এগোবে।”
জেলা পুলিশের এক আধিকারিক জানাচ্ছেন, এই ধরনে ঘটনায় মূলত দু’টি পন্থা তাঁরা অবলম্বন করেন। প্রথমত, সন্দেহভাজনদের থানায় এনে টানা জিজ্ঞাসাবাদ করে তাদের উপরে মানসিক চাপ তৈরি করা। যাতে তারা নিজেরাই ঘটনার কথা কবুল করে। দ্বিতীয়ত, মদের আসরে খুন হওয়ায় এলাকায় মদের ঠেকগুলিতে নিজস্ব লোক মারফৎ খোঁজখবর নেওয়া। এই খুনের তদন্তে ওই দু’টি পদ্ধতি পুলিশ অবলম্বল করেছিল।
সাঁওতালডিহি থানার তৎকালীন ওসি ত্রিগুণা রায় জানান, খুনের তদন্তে নেমে নির্দিষ্ট তথ্য মেলেনি। কিন্তু তাঁরা প্রথম থেকেই নিশ্চিত ছিলেন খুনিরা সকলেই স্থানীয় ও মৃতের পরিচিত। তাই আদালতে কৈলাসের মায়ের গোপন জবানবন্দি করানো হয়। সেখানে তিনি সন্দেহভাজন হিসাবে বেশ কয়েকজনের নাম বলেছিলেন। স্থানীয় ভাবে খোঁজখবর নিয়ে আরও কয়েকজনকে জিজ্ঞসাবাদ করার পরে তাঁরা ওই তালিকাটা ছোট করে আনেন। তারপর মূল সন্দেহভাজনদের ফের জিজ্ঞসাবাদ শুরু করা হয়। আর তাতেই কাজ হয়।
পুলিশ গ্রেফতার করে কিশোর চৌধুরী নামে ওই এলাকার এক বাসিন্দাকে। পুলিশের দাবি, কিশোর তাদের টানা জিজ্ঞাসাবাদে কিছুটা ভাঙলেও পুরোপুরি মচকায়নি। জামিন পেয়ে যায়। পুলিশ তার উপরে নজরদারি শুরু করে। তাতেই সাফল্য মেলে। কিছুদিন পরেই কিশোর একটি মদের ঠেকে খুনের ঘটনার বিষয়ে এমন কিছু মন্তব্য করে বসে, যাতে তার সঙ্গে খুনের প্রত্যক্ষ যোগাযোগের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়। ভাগ্যক্রমে আবার সেখানে উপস্থিত ছিলেন কৈলাসের এক আত্মীয়। তিনি কিশোরের সেই কথা শুনে পুলিশকে তা জানান। কিশোরকে ফের থানায় তুলে এনে পুলিশ দীর্ঘ জেরা শুরু করে।
পুলিশের দাবি, শেষ পর্যন্ত ভেঙে পড়ে সমস্ত ঘটনা কবুল করে ওই ব্যক্তি। এর পরেই পরপর গ্রেফতার করা হয় ওই খুনের ঘটনায় অন্যতম জড়িত সঞ্জয় পরামনিক, আকুল বাউরি ও শেষে নির্মল মাহাতোকে।
•২০১৩ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি সাঁওতালডিহি বস্তি এলাকায় মদের আসরে খুন এক যুবক। গোড়ায় পুলিশ ধন্দে পড়ে যায়।
• পরে এক অভিযুক্ত মদের আসরেই তথ্য ফাঁস করেন।
• একে একে ধরা পড়ে চার জন। আদালতে মামলা চলছে।
এই নির্মলের নাম শুনেই তাজ্জব হয়ে গিয়েছিলেন তদন্তকারীরা। কারণ কৈলাসের দেহ নিয়ে এলাকায় সে দিন যে বিক্ষোভ হয়েছিল, সেখানে এই নির্মলই প্রথম সারিতে ছিল। সেখান থেকে পুরুলিয়ায় কৈলাসের দেহ ময়নাতদন্ত করতে নিয়ে যাওয়া থেকে দাহ— সর্বত্রই নির্মল ছিল। যদিও তারপরেই সে ওড়িশায় কাজ করতে চলে গিয়েছিল। পুলিশের অভিযোগ, তাদের বিভ্রান্ত করতেই নির্মল খুনের পরে বিক্ষোভ দেখানো থেকে অন্ত্যেষ্টিতে সক্রিয় ভাবে ছিল। তার নাম পেতেই পুলিশ ফাঁদ পেতে ওড়িশা থেকে তাকে সাঁওতালডিহিতে টেনে আনে। তার মোবাইল ফোনের টাওয়ার লোকেশনও পুলিশ নজর রাখছিল। সাঁওতালডিহিতে পা দিতেই নির্মলকে গ্রেফতার করা হয়।
পুলিশের দাবি, বদরাগী হিসাবে পরিচিত কৈলাসের ব্যবহার ও পুরনো পারিবারিক বিবাদের জেরে সে দিন মদের আসরে সে খুন হয়ে যায় বলে ধৃতেরা জেরায় তাদের জানিয়েছে। পরে তাদের নিয়ে অপরাধের পু্র্নগঠন করেছিল পুলিশ। সেখানে ধৃতেরা দেখিয়েছিল কী ভাবে কৈলাসকে মদ খাইয়ে কার্যত বেহুঁশ করে ভাঙা মদের বোতল দিয়ে খুন করা হয়। কে হাত ধরেছিল, কে পা ধরেছিল, কারা গলার নলি কাটে— সবটাই পুর্নগঠন করানো হয়। ঘটনাস্থলের অদূরে পুকুরের পাড়ে পোঁতা কৈলাসের রুপোর হারও উদ্ধার হয়।
চার জনকে গ্রেফতারের তিন মাসের মধ্যেই পুলিশ আদালতে চার্জশিট জমা দেয়। খুনের মামলাটি এখন আদালতের বিচারাধীন। রায়ের দিকে তাকিয়ে রয়েছে সাঁওতালডিহি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy