শোকস্তব্ধ: মহম্মদ তাহেরের দেহ দেখতে ভিড় গ্রামবাসীদের। নলহাটির বুজুংয়ে। নিজস্ব চিত্র
উৎসবের দিনে সন্ধ্যার নমাজ সবেমাত্র শেষ হয়েছে। এলাকার চায়ের দোকান তখনও সরগরম। বাসস্ট্যান্ড যাওয়ার রাস্তায় ফুচকা, আইসক্রিম, তেলেভাজা, ঘুগনির স্টলে কচিকাঁচা থেকে বড়দের ভিড়। সেই ভিড়ের মাঝেই মসজিদে নমাজ পড়িয়ে মোটরবাইকে বাড়ি ফিরছিলেন নলহাটির বুজুং গ্রামের বাসিন্দা মহম্মদ তাহের। যিনি ওই তল্লাটে তাহের মাস্টার নামেই সবার কাছে জনপ্রিয়। এলাকায় ছেলেমেয়েদের মধ্যে শিক্ষার প্রসারে বরাবর সক্রিয় চল্লিশ বছরের সেই তাহেরকে যে কেউ খুন করতে পারে, তা এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না তাঁর পরিবারের লোকজন এবং বুজুং গ্রামের বাসিন্দাদের।
বুধবার সন্ধ্যা পৌঁনে সাতটা নাগাদ বুজুং গ্রামের বাসস্ট্যান্ড যাওয়ার রাস্তায় ধারালো অস্ত্রের কোপে তাহেরকে খুন করা হয়। ওই ঘটনায় অভিযোগের তির নিহতেরই এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের দিকে। তিনি তাহেরে পাড়াতেই থাকেন। যদিও পরিবারের তরফে সেই আত্মীয়ের নামে লিখিত অভিযোগ হয়নি বৃহস্পতিবার রাত অবধি। এ দিন সকালেই নলহাটি থানার লোহাপুর থেকে অভিযুক্তকে আটক করে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ চালাচ্ছে। কিন্তু ঠিক কী কারণে তাহেরের উপরে এই হামলা, তা এখনও পুলিশের কাছে স্পষ্ট নয়। এলাকার বাসিন্দাদের ধারণা, পূর্ব কোনও আক্রোশবশত তাহের মাস্টারকে খুন হতে হয়েছে। তাঁদের দাবি, পুলিশ পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করে দোষীকে শাস্তি দিক।
প্রত্যক্ষদর্শীরা পুলিশকে জানিয়েছেন, নমাজ পড়িয়ে বাড়ি ফেরার সময় অভিযুক্ত তাহেরকে বাইক থামাতে বলেন। তাঁকে পিছনে বসিয়ে নিয়েছিলেন তাহের। কিছুটা দূর এগিয়ে বাইক থামে। অভিযোগ, ওই যুবক নেমে প্রথমে তাহেরের ঘাড়ে কোপ মারেন। এর পরে পিঠেও পড়ে অস্ত্রের কোপ। তাহের পড়ে যেতেই রাস্তার ভিড় ঠেলে পালিয়ে যান অভিযুক্ত। গুরুতর জখম অবস্থায় তাহেরকে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ রামপুরহাট হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। কর্তব্যরত চিকিৎসকের নির্দেশে রামপুরহাট সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়ার পথেই তিনি মারা যান।
মৃত তাহের মাস্টার
তাহেরের মৃত্যু ঘিরে ধোঁয়াশা কাটছে না বুজুং গ্রাম-সহ আশপাশের সরধা, রামেশ্বরপুর, পাখা, খিদিরপুর, কানাইপুর, সুরফুলা, ধরমপুরের মতো ৭-৮টি গ্রামের বাসিন্দাদের। স্থানীয় সূত্রে জানা যাচ্ছে, গত ৯ বছর ধরে এই সমস্ত গ্রামের শিশুদের শিক্ষিত করতে তাহের মাস্টার কার্যত নিজের প্রচেষ্টায় গড়ে তুলেছিলেন বেসরকারি একটি স্কুল। যেখানে বাংলার পাশাপাশি ইংরেজিকেও সমান গুরুত্ব দিয়ে ছেলেমেয়েদের নার্সারি থেকে ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। ছোট চালা ঘর থেকে তিল তিল করে অফিস-সহ আটটি পাকা ক্লাসরুম তৈরি করেছিলেন ওই যুবক। তাঁর হাতে গড়া সেই স্কুলে বর্তমানে ২৭৫ জন ছাত্রছাত্রী। তাহেরের স্কুলে এলাকার জনা দশেক যুবক-যুবতী পড়ানোর সঙ্গে যুক্ত।
এ হেন তাহেরকে খুনের ঘটনায় এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। ময়নাতদন্তের পরে ওই যুবকের মৃতদেহ বুজুংয়ে ঢোকার আগে দু’কিলোমিটার দূরের গ্রাম সরধা মোড়েও তাহের মাস্টারকে শেষ দেখা দেখার জন্য পুরুষ-মহিলারা রাস্তার ধারে ভিড় করেছিলেন। তাঁদের অনেকের চোখেই জল। এ দিন বুজুং গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, তাহেরের বাড়ি ঘিরে পড়শিদের ভিড়। বাড়ির লোকেরা কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। বিবাহিত তাহেরের দু’টি কন্যা সন্তান। একটি ছ’বছরের, অন্যটি দশ।
এলাকাবাসী জানালেন, তাহেরদের পরিবার যথেষ্ট স্বচ্ছল। তাঁদের দান করা জমিতেই গ্রামে ইদগাহ গড়ে উঠেছে। স্কুল পরিচালনায় দাদার সঙ্গে কাজ করা তাহেরের ভাই মাহামাদুল হাসানের কথায়, ‘‘দাদার মতো সমাজসেবীর কোনও শত্রু থাকতে পারে, ভাবতেই পারছি না।’’ তাঁর দাবি, তাঁদের সঙ্গে কারও পারিবারিক শত্রুতা বা সম্পত্তিগত বিবাদ ছিল না। তবে, তাহেরকে পূর্ব পরিকল্পনামাফিকই খুন করা হয়েছে বলে ধারণা তাঁর পরিবার ও পড়শিদের। না হলে সুযোগ বুঝে মোটরবাইক থামিয়ে তাহেরের উপরে হামলা চালানো হত না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy