Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

বাঘমুণ্ডির আশ্রমে চলছে সমাধির জমির খোঁজ

অনেকদিন আশ্রমে তাঁর পা পড়েনি। থাকতেন অনেকদূরে কলকাতায়। কিন্তু বাঘমুণ্ডির সুইসায় নিজের তৈরি ‘নেতাজি সুভাষ আশ্রমে’র সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়নি। বিচ্ছিন্ন করতে চাননি নিজেও। তাই ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রয়াত রাজ্য সম্পাদক অশোক ঘোষের ইচ্ছা মেনে সুইসার সেই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের আশ্রমেই তাঁর দেহ সমাহিত করতে চলেছে দল।

সুইসায় নিজের প্রতিষ্ঠিত এই আশ্রমে নিয়মিত আসা যাওয়া ছিল ফব-র রাজ্য সম্পাদক অশোক ঘোষের। অ্যালবাম উল্টে তাঁর স্মৃতিতে মগ্ন কর্মীরা। —সুজিত মাহাতো ও ফাইল চিত্র।

সুইসায় নিজের প্রতিষ্ঠিত এই আশ্রমে নিয়মিত আসা যাওয়া ছিল ফব-র রাজ্য সম্পাদক অশোক ঘোষের। অ্যালবাম উল্টে তাঁর স্মৃতিতে মগ্ন কর্মীরা। —সুজিত মাহাতো ও ফাইল চিত্র।

প্রশান্ত পাল
বাঘমুণ্ডি শেষ আপডেট: ০৪ মার্চ ২০১৬ ০১:১৮
Share: Save:

অনেকদিন আশ্রমে তাঁর পা পড়েনি। থাকতেন অনেকদূরে কলকাতায়। কিন্তু বাঘমুণ্ডির সুইসায় নিজের তৈরি ‘নেতাজি সুভাষ আশ্রমে’র সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়নি। বিচ্ছিন্ন করতে চাননি নিজেও। তাই ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রয়াত রাজ্য সম্পাদক অশোক ঘোষের ইচ্ছা মেনে সুইসার সেই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের আশ্রমেই তাঁর দেহ সমাহিত করতে চলেছে দল।

চান্ডিল-মুরি রেলপথে সুইসা স্টেশনের কাছেই গাছগাছালি ঘেরা এই আশ্রমের সঙ্গে অশোকবাবুর জীবনের একটা বড় অংশ জুড়ে গিয়েছিল। বৃহস্পতিবার তাঁর মৃত্যু সংবাদ আসার পরে এই আশ্রমের কর্মীদের মধ্যে যেন স্বজন হারানোর শোক নেমে এসেছে। তাঁদের কথায় বারবার এসেছে অশোকদার আশ্রমের দিনগুলোর কথা। তাঁদের মধ্যে অসীম সিংহ, কালীদাস কুইরি, পিন্টু পরামানিক বলছিলেন, ‘‘অশোকদা আমাদের নিয়ে এমন মেতে থাকতেন যেন একটা পরিবার। তিনি ছিলেন সবার দাদা। শেষবার আশ্রমে এসেছিলেন ২০০৬ সালে। শরীর অনেকটাই ভেঙে গিয়েছিল। কিন্তু তখনও কি জানতাম, সেটাই তাঁর শেষ আসা।’’

পরিবার থেকে তিনি অবশ্য আলাদা হচ্ছেন না। দলের বর্ষীয়ান নেতা প্রাক্তন সাংসদ বীরসিংহ মাহাতো জানিয়েছেন, শনিবার পুরুলিয়ায় দলের অফিসে অশোকবাবুর দেহ নিয়ে আসা হবে। পরেরদিন সুইসার আশ্রমে তাঁর দেহ সমাধি দেওয়া হবে। আশ্রমের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি বীরসিংহবাবু বলছিলেন, ‘‘বছর কুড়ি আগে আমি, অশোকদা ও দেবুদা (দেবব্রত বিশ্বাস) এই আশ্রম থেকে একটা কাজে বেরোচ্ছিলাম। সেই সময় আশ্রমের বাগানে নেতাজির মূর্তি দেখিয়ে অশোকদা বলেছিলেন, সেখানেই যেন মৃত্যুর পরে তাঁর দেহ সমাধি দেওয়া হয়। তিনি নেতাজির মুখোমুখো তাঁর দেহ সমাধি দিতে বলেছিলেন।’’

সুইসার এই আশ্রম তৈরির পিছনে অশোকবাবুর ভূমিকা সব থেকে বেশি ছিল। ১৯৬১ সালে এই আশ্রমের প্রতিষ্ঠা। অবশ্য এখানে তাঁর আনাগোনা ছিল অনেক আগে থেকে। কংগ্রেস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ফরওয়ার্ড ব্লক প্রতিষ্ঠা করে ১৯৪০ সালে বিহারের রামগড়ে অধিবেশন করেন সুভাষচন্দ্র বসু। সেই অধিবেশনে বাঘমুণ্ডি এলাকা থেকে বহু তরুণ যান। তখন থেকেই এই এলাকায় ফব-র বিস্তার শুরু হয়েছিল। বিহারের বাসিন্দা রাম শৃঙ্গার সিং ফরওয়ার্ড ব্লকের শ্রমিক সংগঠন করতেন। তিনি সুইসায় এসে শিক্ষা বিস্তারের জন্য নেতাজির ভাবার্দশে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। রাম শৃঙ্গার, শশীভূষণ মাহাতো, দমন কুইরি প্রমুখের নেতৃত্বে বাসিন্দারা এলাকার সামগ্রিক উন্নয়নের দাবিতে পুরুলিয়ায় জেলাশাসকের কাছে স্মারকলিপি দেন। কলকাতায় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায়ের কাছেও স্মারকলিপি দেওয়ার কথা ঠিক হয়।

সে জন্য স্থানীয় নোয়াডি গ্রামে সভা করতে প্রথম আসেন অশোক ঘোষ। ট্রাস্টি বোর্ডের বর্তমান সম্পাদক মহেশ্বর কুইরি স্মৃতি থেকে বলেন, ‘‘সে দিন আশোকদা জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়েছিলেন। কলকাতা যাওয়ার খরচ তুলতে সভায় স্লোগান দেওয়া হয়েছিল— ‘এক টাকা, দু’আনা, কলক্কাতা যানা-আনা, গঙ্গা নাহানা, খানা।’’ কলকাতাগামী ওই ফব কর্মীদের সঙ্গে ছিলেন বীরসিংহবাবুর বাবা। তাঁর কাছে বীরসিংহবাবু শুনেছিলেন, প্রায় এক হাজার মানুষ ট্রেনে কলকাতা যাচ্ছিলেন। খড়গপুরে পুলিশ নেতাদের গ্রেফতার করে। খবর পেয়ে অশোকবাবু, চিত্ত বসু, হেমন্ত বসু, নির্মল বসু খড়গপুরে এসে নেতাদের ছাড়ান। মিছিল কলকাতায় গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দেয়।

এরপর থেকে আশোকবাবু মাঝেমধ্যেই চলে আসতেন সুইসায়। ভোররাতে ট্রেন থেকে নেমে খবরের কাগজ বিছিয়ে সুইসা স্টেশনে ঘুমিয়ে নিতেন। সকালে পায়ে হেঁটে কর্মীদের বাড়িতে গিয়ে উঠতেন। তারপর টোটো করে দিনভর এ গাঁ, ও গাঁ ঘুরে সংগঠন তৈরির কাজ করতেন। অশোকদাকে তখন কাছ থেকে দেখা কচিবয়সের ছেলেরাই এখন সুইসায় দলের নেতা। তাঁদের মধ্যে গোপালচন্দ্র মাহাতো, পরেশচন্দ্র কুইরি জানান, ১৯৫৮ সালে সুইসায় ফব-র অগ্রগামী কিসান সভার সর্বভারতীয় সম্মেলনের পরে অশোকবাবু ঠিক করেন এখানে একটা আশ্রম গড়ে তোলা হবে। আশ্রম গড়ে তোলার দায়িত্ব দেওয়া হয় অনুশীলন কমিটির সদস্য বিপ্লবী হরিনারায়ণ চন্দ্রকে। আশ্রমের উদ্বোধন করেন হেমন্ত বসু। নামেই আশ্রম, ধর্মকর্ম থেকে দূরে থাকা এই আশ্রমে রাজনীতির পাঠ দেওয়া হয়, সমাজসেবা ও সংস্কৃতি প্রসারের কাজই মূলত হয়। যেমনটা চেয়েছিলেন অশোকবাবু।

জরুরি অবস্থার সময় এই আশ্রমেই অশোকবাবু আত্মগোপন করেছিলেন। কর্মীরা মনে করিয়ে দেন, নিজের কাজ নিজেই করতে পছন্দ করতেন অশোকবাবু। বিছানা করা, জমাকাপড় কাচায় কাউকে হাত লাগাতে দিতেন না। মাঝে মধ্যেই আশ্রমে এসে ক’টা দিন তিনি কাটিয়ে যেতেন। নেতাজির জন্মদিনে ‘নেতাজির মেলা’তেও তিনি আসতেন। আশপাশের গাঁ-গঞ্জের মানুষের সঙ্গেও তাঁর সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। চিঠিপত্র চালাচালিও হতো কারও কারও সঙ্গে। তাই অশোকদার ‘ফিরে আসার’ জন্য অপেক্ষা করছে তামাম বাঘমুণ্ডি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

tomb ashok ghosh baghmundi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE