Advertisement
E-Paper

ইতিহাসের মোতিঝিলে ফিরছে মুক্ত

ইতিহাস চুরি হয়, নাকি হারিয়ে যায়? এ বিতর্কের শুরু আছে, শেষ নেই। সেকালের ‘রাজ কাহিনী’ তাই সময়ের ধুলো মেখে মলাট বন্দি হয়ে পড়ে থাকে ইতিহাসের বইয়ে।

অনল আবেদিন

শেষ আপডেট: ১১ জুলাই ২০১৬ ০২:০৪

ইতিহাস চুরি হয়, নাকি হারিয়ে যায়?

এ বিতর্কের শুরু আছে, শেষ নেই। সেকালের ‘রাজ কাহিনী’ তাই সময়ের ধুলো মেখে মলাট বন্দি হয়ে পড়ে থাকে ইতিহাসের বইয়ে।

সে ইতিহাসকে ফিরে দেখতে হলে, সেই মোতি-মাণিক্য খচিত নবাবের খাস মহলে ঢুকতে হলে চড়ে বসতে হয় কোনও কল্পবিজ্ঞানের টাইম মেশিনে।

টাইম মেশিন যখন নেই, তাই ৩০০ বছর আগের নবাবি আমলের ফেরার চেষ্টা না করে মুর্শিদাবাদের জেলা প্রশাসন পুরনো ইতিহাসকে ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা করেছে। প্রায় তিনশো বছর আগের নবাবি আমলের ঐতিহাসিক মোতিঝিলের শুক্তিতে মোতি বা মুক্তকে ফেরানোর সেই কর্মযজ্ঞ শুরুও হয়েছে।

১১৮ বছর আগে প্রকাশিত ঐতিহাসিক নিখিলনাথ রায় তাঁর ‘মুর্শিদাবাদ কাহিনী’ গ্রন্থের ‘মোতিঝিল’ অধ্যায়ে লিখেছেন, ‘‘ইহার গর্ভে অনেক শুক্তি পাওয়া যাইত বলিয়া ইহা মোতিঝিল নামে অভিহিত হইয়া থাকে।... এই সকল শুক্তিগর্ভস্থিত মোতিচূর্ণে নবাবদিগের তাম্বুলসেবন হইত বলিয়া প্রবাদ আছে।’’

ইতিহাসের পাতায় যেমন ধুলো জমে, নবাবি মোতিঝিলের গর্ভেও সময়ের পলি। কিন্তু, তাতে অবশ্য মোতি-কাহিনীর পথরোধ হচ্ছে না। জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, মাস কয়েকের মধ্যেই ঘষেটি বেগমের সেই মোতিঝিলে শুরু হবে মুক্তো চাষ। পরিকল্পনা পাকা।

শতাধিক বছরের অবহেলার পর সম্প্রতি রং বাহারি অজস্র আলোর মালায় মোতিঝিল আজ অপরূপা। মুক্তো চাষের সম্ভবনা খতিয়ে দেখতে গত জুন মাসে ‘ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব এগ্রিকালচারাল রিসার্চ’ (আইসিএআর) এর অধীনে থাকা ‘সেন্ট্রাল ইন্সটিটিউট অব ফ্রেস ওয়াটার অ্যাকোয়া কালচার’ (সিআইএফএ)-এর বিজ্ঞানীরা মোতিঝিল ঘুরে গিয়েছেন। সম্ভাবনায় সিলমোহরও দেওয়ার পর জোর কদমে শুরু হয়েছে কাজ।

অশ্বখুরাকৃতি মোতিঝিলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও নিরাপদ স্থানের কথা ভেবে নবাব আলিবর্দির মেয়ে ঘসেটি বেগম ও জামাই নওয়াজেস মহম্মদ খাঁ সেখানে গড়ে তুলেছিলেন আলিশান মহল। ৩০০ বিঘার জলাশয় বেষ্টিত মোতিঝিল এলাকার মোট আয়তন ৩৫০ একর।

বাংলার মসনদ থেকে নবাব সিরাজকে উৎখাতের জন্য ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, উমিচাঁদ, রায় দুর্লভ প্রমুখদের সঙ্গে মিলিত ভাবে ঘসেটি বেগমের ষড়যন্ত্র-সহ অনেক ইতিহাসের সাক্ষী মোতিঝিল। সেই পুরাসম্পদ একদা অনাদরে অবহেলায় কচুরিপানার ডোবা, আর গা ছমছমে জঙ্গলে পরিণত হয়েছিল।

কখনও ডলফিন পার্ক, কখনও মোটেল-সহ গত কয়েক দশকে মোতিঝিল নিয়ে সরকারি প্রতিশ্রুতি শুনে মুর্শিদাবাদর মানুষ ক্লান্ত ও হতাশ হয়ে পড়েছিল। অবশেষে বছর দুয়েকের চেষ্টায় মোতিঝিলের ভোল আমূল বদলে গিয়েছে। আকর্ষণের দিক থেকে পর্যটকদের কাছে হাজারদুয়ারি ও মোতিঝিল একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠেছে।

গত বছরের ১ জুলাই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী মোতিঝিলের নামকরণ করেন ‘প্রকৃতিতীর্থ’। প্রতি শনিবার ও রবিবার সন্ধ্যায় অত্যাধুনিক মুক্তমঞ্চে নাচ, গান ও নাটকের মতো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। প্রতিদিন সন্ধ্যা পৌনে ৭টায় ‘লাইট অ্যান্ড সাউন্ড’-এ জীবন্ত হয়ে ওঠে নবাবি আমল, মসনদের দখলদরি নিয়ে ষড়যন্ত্র, পলাশির যুদ্ধ ও সামন্তযুগ।

লাইট অ্যান্ড সাউন্ডের পাশাপাশি এখানে তৈরি হয়েছে বিলাসবহুল তিনটি কটেজে, ন’টি স্যুইট। বানানো হযেছে ৩০ ফুট উঁচু ওয়াচ টাওয়ার। সেখান থেকে পুরো মোতিঝিল দেখা যায়। নানা বিনোদনের সঙ্গে এবার যুক্ত হতে চলেছে মুক্তোচাষ।

মুর্শিদাবাদ জেলা মৎস্য বিভাগের সহকারি অধিকর্তা জয়ন্ত প্রধান বলেন, ‘‘মোতিঝিলে মুক্তোচাষের ভাবনা প্রথম ভাবেন জেলাশাসক ওয়াই রত্নাকর। তাঁর ভাবনা বাস্তবে রূপ দিতে রাজ্য মৎস্য দফতরের অধিকর্তা সিআইএফএ-এর বিজ্ঞানীদের অনুরোধ করেন। জেলাশাসক নিজেও পৃথক ভাবে সিআইএফএ-এর বিজ্ঞানীদের লিখিত ভাবে আবেদন করেন।’’

সেই মতো গত ২ জুন সিআইএফএ-র বিজ্ঞানী শৈলেন সৌরভ ও সিনিয়র টেকনিক্যাল অফিসার উৎকল লক্ষ্মী মহান্তি মোতিঝিল ঘুরে দেখেন। এ বার তাঁদের কাছে হাতে কলমে মুক্তোচাষ শিখতে মুর্শিদাবাদ থেকে ভুবনেশ্বর যাবেন দু’জন অফিসার ও চার জন মৎস্যচাষি।

প্রথম বার সিআইএফএ-এর বিজ্ঞানীরা মোতিঝিলে নিজেরাই মুক্তচাষ করবেন। তারপর এখানকার প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা নিজেরা চাষ করবেন। জয়ন্তবাবু বলেন, ‘‘নবাবি আমলে মোতিঝিলে মারগরিটিফেরা প্রজাতির ঝিনুকে মুক্তোচাষ হত। এখন সেই প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। এখানে এখন মুক্তোচাষ করা হবে ল্যামিলিডেনস প্রজাতির ঝিনুকে।

জেলা শাসক ওয়াই রত্নাকর জানিয়েছেন, একটি ঝিনুক থেকে আট থেকে ১২ মাসে মুক্তো পাওয়া সম্ভব হবে। চাকচিক্য ফেরানোর পর মৎস্যচাষি সমবায় সমিতিকে লিজ দেওয়া কিছু বিশেষ জলাশয়ে মুক্তো চাষ করা হবে। মুক্তোচাষের জন্য মোতিঝিল জলাশয় সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছে। ঝিলের গভীরতা ফেরাতে শুরু হয়েছে জ্রেজিং। তার জন্য আনা হয়েছে চারটি ড্রেজার।

শতকরা একশো ভাগ মুক্তো পেতে ঝিনুক ঝিলে ছেড়ে না দিয়ে ঝিলের জলে ফেলে রাখা বাঁশের সঙ্গে সুতো দিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া হবে। ফলে মুক্তো তৈরি হয়ে গেলে প্রতিটি ঝিনুকই সংগ্রহ করা সহজ হবে। ওই প্রকল্পের বিষয়ে মুর্শিদাবাদ জেলাশাসক ওয়াই রত্মাকর রাও বলেন, ‘‘যাবতীয় পরিকল্পনা ও প্রকল্প সবাইটাই মোতিঝিলকে ইতিহাসের পুরনো দিনের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যই।’’

এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, এতে একই সঙ্গে আধুনিক বিনোদন ও ঐতিহাসিক স্বাদ দুটোই মিলবে। তার সঙ্গে স্থানীয়দের সামনে নতুন আয়ের দিগন্ত খুলবে। উন্নতি হবে পর্যটন শিল্পের ও জেলার অর্থনীতিরও।

Motijheel Pearl cultivation
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy