বাঁ দিকে শারীরশিক্ষার ক্লাস ও ডান দিকে তাপস হাজরা। —নিজস্ব চিত্র।
লেখাপড়া করলে গাড়িঘোড়া চড়া যায়। আর খেলাধুলো করলে?
অধিকাংশ অভিভাবকের ধারণা, খেলাধুলো মানে সময় নষ্ট। লাভপুরের কুরুম্বা মুকুন্দলাল হাইস্কুলের ক্রীড়া শিক্ষক তাপস হাজরা বাবা-মাদের নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছেন। খেলার মাধ্যমেও যে জীবন-জীবিকার পথ খুঁজে পাওয়া যায়, তা দেখিয়ে দিয়েছেন মধ্যচল্লিশের ওই শিক্ষক।
স্কুল কর্তৃপক্ষ জানান, খেলাধুলার চর্চার সুবাদে সামরিক বাহিনী, পুলিশ, শারীরবিদ্যার শিক্ষকতা-সহ বিভিন্ন দফতরে চাকরি পেয়েছেন শতাধিক ছাত্রছাত্রী। ঢোলটিকুরির সুখী কিস্কু, সিমাইতের সুশান্ত মেটে-সহ এলাকার অভিভাবকরা এখন ভরসা করছেন তাপসবাবুর উপর। খো-খো’য় রাজ্য স্তরে প্রতিনিধিত্ব করা সুখীদেবীর ছেলে দশরথ বছরখানেক আগে সামরিক বাহিনীতে ঢুকেছেন। একই খেলায় পারদর্শী সুশান্তবাবুর বড় ছেলে কল্যাণ রাজ্য পুলিশ, এবং ছোট ছেলে অমিত সামরিক বাহিনীতে যোগ দিয়েছেন। সুশান্তবাবু বলেন, ‘‘যখন তাপসবাবু ছেলেদের খেলার মাঠে নিয়ে যাওয়ার জন্য বাড়িতে হাজির হতেন, তখন মনে হতো পড়াশোনার বারোটা বাজবে। আজ বুঝি সেই ধারণা কতটা ভুল ছিল।’’
একই মত রাজ্য পুলিশে কর্মরত বেরুগ্রামের মালা চৌধুরী, তিলুটিয়ার ময়জ্জমা খাতুন, গঙ্গারামপুরের নুর আলম, আসলিম মোল্লাদেরও। তাঁরা বলছেন, ‘‘ভাগ্যিস সে দিন স্যারের কথা শুনে নিয়মিত খেলাধুলা করেছি। তাই কাজ পেতে সুবিধে হয়েছে।’’
স্কুলের প্রধান শিক্ষক সুব্রত পাল এবং জেলা শারীর শিক্ষা আধিকারিক অশোক বিশ্বাস জানান, তাপসবাবুর নিরলস প্রচেষ্টার জন্য খেলাধুলোয় নাম করে স্কুলের, তথা জেলার, নাম উজ্জ্বল করেছে বহু পড়ুয়া। ২০০৫ সালে আন্তঃরাজ্য আদিবাসী কবাডি প্রতিযোগিতায় বাংলার অধিনায়ক ছিল অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী রানি সোরেন। ২০টি রাজ্যের মধ্যে সেরা শিরোপা লাভ করে তার দল। ২০১১-১২ সালে জাতীয় স্তরের তিরন্দাজি প্রতিযোগিতায় দলগত ভাবে সোনা, ব্যক্তিগত ভাবে ব্রোঞ্চ পদক পেয়েছিল এই স্কুলের রাজকুমার দাস।
শুধু গত ১০ বছরের পরিসখ্যান বলছে, ওই স্কুল থেকে খো-খোতে ১০০, তিরন্দাজিতে ৫০, কবাডিতে ৪০, অ্যাথলেটিক্সে ১০, ফুটবলে ৫, সাঁতারে ৪, সাইক্লিংয়ে ২, বাস্কেটবলে ২ জন রাজ্যস্তরের প্রতিযোগিতায় জেলার হয়ে প্রতিনিধিত্ব করে বিভিন্ন পদক লাভ করেছে। বিভিন্ন খেলায় ৭৭ জন জাতীয়স্তরে রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করে সাফল্য পেয়েছে।
এই সব সাফল্য অবশ্য সহজে আসেনি। বিস্তর কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে তাপসবাবুকে। তাঁর কথায়, ‘‘বহু ছেলেমেয়েকে বাড়ির চাপে খেলা ছেড়ে দিতে হয়। স্কুলের মাঠে কেউ না এলে বাড়িতে খোঁজ নিতে গিয়ে শুনেছি, খেলা নিয়ে মেতে থাকলে তো পড়াশোনা মাটি হবে।’’ অনেকের মূল সমস্যা ছিল খেলার পোশাক, সরঞ্জাম কিংবা খেলতে যাওয়ার খরচ জোগানো। তাপসবাবু গাঁটের কড়ি খরচ করে অনেকের পোশাক, সরঞ্জাম, খেলতে যাওয়ার খরচ জুগিয়েছেন। কিন্তু বাড়ির মনোভাব বদলানোই ছিল সব চাইতে কঠিন, বলেছেন তিনি।
তাপসবাবুর বাড়ি মুর্শিদাবাদের রঘুনাথগঞ্জের বাড়ালা গ্রামে। বাবা প্রয়াত কামাখ্যাচরণবাবু কলকাতায় এ ডিভিশনে ফুটবল খেলেছেন। তাপসবাবুও ঐক্য সম্মিলনীতে খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু একটি প্রর্দশনী ম্যাচে পা ভেঙে যাওয়ায় মাঠ ছাড়তে হয়। নিজের আর খেলা হয়নি। স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে চারিয়ে দিয়েছেন খেলার প্রতি ভালবাসা। শারীরশিক্ষার বাঁধাধরা ক্লাস করে দায় সারেননি। নিজে একের পর এক প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তার পর তা শিখিয়েছেন পড়ুয়াদের। তাঁর সাফল্য প্রথম নজর কাড়ে, যখন ১৯৮৯ সালে যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে ‘ভারতীয়ম’ প্রতিযোগিতায় রাজ্যের ১০০টি স্কুলের মধ্যে যুগ্ম চ্যাম্পিয়ান হয় কুরুম্বা। ওই বছরই দিল্লিতে জাতীয় ‘ভারতীয়ম’-এ সেরা দল হওয়ায় রাষ্ট্রপতি ভবনে চা চক্রে আমন্ত্রিত হয় লাভপুরের স্কুল।
বোলপুরের কালিকাপুর গ্রামে স্ত্রী পুতুলদেবী এবং ছেলে সম্রাটকে নিয়ে তাপসবাবুর সংসার। স্ত্রীর অনুযোগ, ‘‘ওঁর সংসার আসলে ওঁর স্কুলের ছেলেমেয়েদের নিয়েই। মাঝে মধ্যে রাগ হলেও, ওদের মুখে জয়ের হাসি দেখে সব গলে জল হয়ে যায়।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy