Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

পটশিল্পকে বাঁচাতে চিত্রকরদের রং-তুলি ধরালেন পুলিশ-কর্তা

মারাংবুরু থেকে মল্ল রাজাদের কুলদেবতা মদনমোহন, জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রার লীলা কাহিনী এক সময় প্রাণ পেত বাঁকুড়ার হিড়বাঁধের নোয়াদিহি গ্রামের চিত্রকরদের পটচিত্রে।

পটে-গানে: শিল্পীর কাছে বাঁকুড়ার পুলিশ সুপার। নিজস্ব চিত্র

পটে-গানে: শিল্পীর কাছে বাঁকুড়ার পুলিশ সুপার। নিজস্ব চিত্র

রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
হিড়বাঁধ শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০১৭ ০১:২৭
Share: Save:

মারাংবুরু থেকে মল্ল রাজাদের কুলদেবতা মদনমোহন, জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রার লীলা কাহিনী এক সময় প্রাণ পেত বাঁকুড়ার হিড়বাঁধের নোয়াদিহি গ্রামের চিত্রকরদের পটচিত্রে। সমুদ্র মন্থন থেকে সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর লোকগাথাও ফুটে উঠত পটে। তবে বাজার ধরার ইঁদুর দৌড়ে পিছিয়ে পড়ে অভাবের তাড়নায় সেই চিত্রকরেরাই রং-তুলি ছেড়ে কেউ ভিক্ষা, কেউবা দিন মজুরি বেছে নেন। ফের তাঁদের শিল্পমুখী করতে উদ্যোগী হল বাঁকুড়া জেলা পুলিশ।

সম্প্রতি তাঁদের হাতে আর্ট পেপার ও রং-তুলি তুলে দিয়ে প্রত্যেক শিল্পীকে ২০টি করে পটচিত্র আঁকার বরাত দিয়েছে জেলা পুলিশ। যার ফলে নোয়াদিহি গ্রামের চিত্রকরদের বাড়িতে ফের শুরু হয়েছে পটচিত্র তৈরির তোড়জোড়। ভেষজ রং তৈরি করতে রঙিন মাটি-সহ বিভিন্ন ফল, ফুল সংগ্রহে নেমে পড়েছেন চিত্রকরেরা।

বাঁকুড়ার পুলিশ সুপার সুখেন্দু হীরার কথায়, “হিন্দু পুরাণ থেকে সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর দেবতা মারাংবুরুর নানা কথা নিয়ে পটচিত্রে তুলে ধরে সুর করে গান গাওয়াই ওই চিত্রকরদের আসল পেশা। তাই নোয়াদিহির চিত্রকরদের নিয়ে পরিকল্পনা করে এগোতে পারলে পর্যটকদের সেখানে টেনে আনা কঠিন নয়।’’

গ্রামের প্রবীণ শিল্পী মুচিরাম চিত্রকরের কথায়, “বাপ ঠাকুরদার আমল থেকেই পটচিত্র এঁকে রোজগার আমাদের। কয়েক দশক আগেও বাইরে থেকে লোকজন আসত আমাদের কাছে পটচিত্র কিনতে। অনেককাল তা বন্ধ। পেট চালাতে তাই পটশিল্পের সঙ্গে যুক্ত ১৫টি পরিবারকে অন্য কাজ করতে হচ্ছে।” গ্রামের যুবক শিশির চিত্রকর, অশোক চিত্রকররাও জানান, পটচিত্রের রং, তুলি ছেড়ে অনেকে গ্রামে-গ্রামে ঘুরে গান গেয়ে ভিক্ষা করেন। সহানুভূতি পেতে অনেকে বাড়ির ছোট বাচ্চাদেরও সঙ্গে নেন। কখনও সখনও আদিবাসীদের ঘরে কেউ মারা গেলে তাঁর বাড়িতে গিয়ে চক্ষুদানের গান গাইবার ডাক আসে। তবে এ বার পুলিশবাবুরা উৎসাহ দেওয়ায় ফের তুলি ধরছি।’’

ছবি কেনার পাশাপাশি চিত্রকরদের এই গ্রামকে বাঁকুড়ার পর্যটন মানচিত্রে তুলে আনতেও চিন্তাভাবনা শুরু করেছে জেলা পুলিশ। জেলার অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র মুকুটমণিপুর থেকে এই গ্রাম ২০ কিলোমিটারের মধ্যেই। জেলার অন্য দু’টি পর্যটনকেন্দ্র বিষ্ণুপুর ও শুশুনিয়া পাহাড় থেকেও গ্রামটির ব্যবধান কমবেশি ৭০ কিলোমিটার। তাই বাঁকুড়া-মুকুটমণিপুর রাস্তায় হাতিরামপুর মোড় থেকে প্রায় সাত কিমি দূরের নোয়াদিহি গ্রামে চিত্রকরদের বাড়িতে ঢুঁ মারা পর্যটকদের কাছে খুব একটা সময় সাপেক্ষও নয়। সুখেন্দুবাবু জানান, চিত্রকরদের পটচিত্র পুলিশের বিভিন্ন দফতরে সাজিয়ে রাখা হবে বলে ঠিক হয়েছে। পর্যটকদের আকর্ষণ করতে চিত্রকরেরা যাতে তাঁদের বাড়ির দেওয়ালেও নানা পটচিত্র আঁকেন, সেই পরামর্শও দিয়েছেন পুলিশ কর্তারা।

শিল্পী উত্তম চিত্রকর, প্রদীপ চিত্রকররা বলেন, “বারো মাস পট এঁকে সংসার চালাতে গেলে শক্তপোক্ত বিপণন দরকার।’’ শিল্পীদের আক্ষেপ, সরকারের দেওয়া শিল্পীর পরিচয়পত্র তাঁদের হাতে থাকলেও মেলা বা কোনও অনুষ্ঠানে তাঁদের কাছে ডাক আসে না। কয়েকজনের বিপিএল কার্ড থাকলেও সবার তা নেই। একশো দিনের কাজও সে ভাবে হয়নি।’’

পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলার নয়া গ্রামে কয়েকটি এনজিও এবং খড়গপুর আইআইটির সহায়তায় পটচিত্রের গুণমান বেড়েছে। সেখানকার পটচিত্র এখন বিদেশেও যাচ্ছে। নোয়াদিহি তবে কেন পিছিয়ে? বাঁকুড়ার জেলাশাসক মৌমিতা গোদারা বসু জানান, জেলা তথ্য ও সংস্কৃতি কেন্দ্রকে তিনি বিষয়টি জানাবেন। তাঁর আশ্বাস, ‘‘কী ভাবে ওই চিত্রসামগ্রী বিক্রির ব্যবস্থা করা যায়, তাঁদের মানোন্নয়নেও কী করা যায়, আমরা দেখব।’’

সহ প্রতিবেদন: সৌমেশ্বর মণ্ডল

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Police Super Iconography
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE