অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। —সুজিত মাহাতো।
শহরাঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সুবর্ণজয়ন্তী বা শতবর্ষ দেখা যায়। কিন্তু প্রত্যন্ত এলাকার একটি স্কুল যখন শতবর্ষ পালন করে, তখন বিস্ময় জাগেই। বুধবার ঝালদার সত্যভামা বিদ্যাপীঠের শতবর্ষ অনুষ্ঠানে এসে সেই বিস্ময়ের ছোঁয়া পাওয়া গেল দেশের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের গলাতেও। প্রণববাবু বলেন, ‘‘এই স্কুলের শতবর্ষ পূর্তির আমন্ত্রণ পত্র পেয়ে মনে হল, এটা গ্রহণ করা দরকার। বড় শহরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৫০ বছর, শতবার্ষিকী, দ্বিশত বার্ষিকী পূর্তি পালিত হয়। কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ১০০ বছর পূর্ণ করেছে, এবং শহিদদের স্মরণ করে এখানে একটি মিউজিয়ামের উদ্বোধন হচ্ছে, এটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে।’’ রাষ্ট্রপতির মুখে এই প্রশংসা পেয়ে বিদ্যাপীঠের থইথই ভরা মাঠে হাততালি ফেটে পড়ে।
রাষ্ট্রপতির ভাষণে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা উঠে আসে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘ওই ইতিহাসের কথা আমরা জানি। কিন্তু এই অঞ্চলও যে পিছিয়ে নেই, তা এই জেলার বাইরে বেশি মানুষ জানেন না। এখানেও প্রতিবাদ, আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল। ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে পাঁচজন শহিদ হয়েছিলেন। সত্যকিঙ্কর দত্ত ছিলেন তাঁদের অনুপ্রেরণা। আজ বিনম্র চিত্তে সেই শহিদদের স্মরণ করছি, প্রণাম করছি। স্বাধীনতা আন্দোলনে এই অঞ্চলের চুঁয়াড় বিদ্রোহেরও ভূমিকা রয়েছে। মিউজিয়ামে সে সব স্থান পেয়েছে। সময়ের অভাবে তা দেখে যেতে পারলাম না।’’ তিনি জানান, পরে সময় পেলে তিনি মিউজিয়াম ঘুরে যাবেন।
রাষ্ট্রপতি মনে করিয়ে দেন, পুরুলিয়া জেলার জন্ম হয়েছিল একটি আন্দোলনের মাধ্যমেই, তার নাম ভাষা আন্দোলন। মঞ্চে হাজির ছিলেন রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী। রাষ্ট্রপতি তাঁর উদ্দেশে বলেন, ‘‘এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়ার জন্য রাজ্যপালকে আমি পুরুলিয়াবাসীর পক্ষ থেকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।’’ তা শুনে হাততালিতে ফেটে পড়ে মঞ্চ থেকে মাঠ।
পড়ুয়াদের উদ্দেশে একসময়কার শিক্ষক প্রণববাবুর পরামর্শ, ‘‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা নিশ্চয় বড় কাজ। তার থেকেও বড় কাজ, দেখতে হবে সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকৃত মানুষ যেন বের হয়। কতগুলি জিনিস শিখলাম, করায়ত্ত করলাম, তা দিয়ে শিক্ষা হয় না। বিবেকানন্দ বলেছিলেন, যে শিক্ষা প্রকৃত মানুষ তৈরি করে না, চরিত্র গঠন করে না, মানুষকে সিংহের সাহস না দেয়, সেই শিক্ষা নিয়ে আমরা কী করব?’’ পড়ুয়াদের কাছে তিনি নিজের আক্ষেপও গোপন করেননি। প্রণববাবুর মতে, চারদিকে একটা উন্মার্গগামীতা লক্ষ করা যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের লক্ষ হওয়া উচিত অভিন্ন। সভ্যতার মূল্যবোধ যেন অস্বীকার না করা হয়। 0দ্বিশতবর্ষের কলকাতায় হিন্দু স্কুল, প্রেসিডেন্সি থেকে যেমন মুল্যবোধ নিয়ে ছাত্রছাত্রী বেরিয়েছে, তেমনই এই স্কুলের পড়ুয়াদের মধ্যেও সেই গুণাবলী থাকে।
এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক বাঘমুণ্ডির কংগ্রেস বিধায়ক নেপাল মাহাতো। সে কারণেই এই স্কুলের অনুষ্ঠান, এ দিন অন্য মাত্রা পায়। দুপুর ৩টেয় রাষ্ট্রপতির আসার কথা থাকলেও, মাঠ ভরে গিয়েছিল বেলা প্রায় ১২টাতেই। নেপালবাবু জানান, শহিদ সত্যকিঙ্কর দত্ত ইংরেজদের বিরুদ্ধে লাঠিয়াল বাহিনী তৈরি করছিলেন। সেই রোষে ১৯২৯ সালে তাঁকে খুন করা হয়। তাঁর স্মৃতিতে ১৯৩১ সালের ১ মাঘ সত্যমেলা চালু হয়। সেই ক্ষোভে ইংরেজ পুলিশ গুলি চালায়। মারা যান সহদেব মাহাতো, মোহন মাহাতো, গোকুল মাহাতো, শীতল মাহাতো ও গণেশ মাহাতো। সত্যকিঙ্করবাবু-সহ ছ’জন শহিদকে এ দিন অনুষ্ঠানের সূচনাতেই স্মরণ করা হয়। রাষ্টপতির হাত ধরে উদ্বোধন হয় স্কুলের ফুটবল মাঠ, শতবর্ষ স্মারক, মিউজিয়ামের। শতবার্ষিকী হলের ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপিত হয়। মন্ত্রী শান্তিরাম মাহাতো, সাংসদ মৃগাঙ্ক মাহাতো, জেলা পরিষদের অধ্যক্ষ বাহাদুর মাহাতো প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। শান্তিরামবাবু বলেন, ‘‘প্রণববাবুর এই সফর পুরুলিয়ায় শিক্ষার নতুন দিগন্ত খুলে দেবে বলে আমরা আশাবাদী।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy