Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

পোস্ত চাষে সর্বনাশ, বার্তা দিতে পদযাত্রায় কর্তারা

‘এক ছটাক জমিতে এ বার বেআইনি পোস্ত চাষ করতে দেব না। করলেই ফল হবে কমপক্ষে ১০ বছর হাজতবাস’।

 নবসন গ্রামে পদযাত্রায় সামিল হলেন প্রশাসনের কর্তারা। — দয়াল সেনগুপ্ত

নবসন গ্রামে পদযাত্রায় সামিল হলেন প্রশাসনের কর্তারা। — দয়াল সেনগুপ্ত

নিজস্ব সংবাদদাতা
কাঁকরতলা শেষ আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০১৬ ০০:১৯
Share: Save:

‘এক ছটাক জমিতে এ বার বেআইনি পোস্ত চাষ করতে দেব না। করলেই ফল হবে কমপক্ষে ১০ বছর হাজতবাস’।

বেআইনি পোস্ত চাষ কেন ক্ষতিকারক, চাষ করলে পরিণতি কী, কী ভাবে যুবসমাজ নেশার কবলে পড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে— এমনই নানা বিষয় তুলে ধরে শনিবার কাঁকরতলা থানা এলাকার নবসন গ্রামে স্কুল পড়ুয়াদের সঙ্গে বেআইনি পোস্ত-চাষ বিরোধী পদযাত্রায় সামিল হলেন জেলা ও ব্লকের পুলিশ-প্রশাসনের কর্তারা। উদ্যোক্তা কাঁকরতলা থানা।

অজয় নদ ঘেঁষা প্রত্যন্ত গ্রামটিকে বাছা হল কেন?

পুলিশ ও আবগারি দফতর জানাচ্ছে, গতবার ওই এলাকায় ঢালাও পোস্ত চাষ হয়েছিল। প্রশাসনিক ভাবে কিছু জমির ফসল নষ্ট করা হলেও বাকিটা থেকে বিস্তর মুনাফা করেছে কিছু লোক। তা যাতে এ বার না হয়, সেটা বোঝাতেই ওই উদ্যোগ। হাঁটলেন অতিরিক্ত জেলাশাসক (সাধারণ) উমাশঙ্কর এস, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জোবি থমাস, আবগারি দফতরের জেলা সুপারিন্টেন্ডেন্ট তপন রায়, ছিলেন খয়রাশোলের বিডিও তারকনাথ চন্দ্র, পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি অসীমা ধীবর প্রমুখ।

আফিম, হেরোইন, ব্রাউন সুগারের মতো মাদক তৈরির মূল উপাদান পোস্ত। সেই কারণে সরকারি নজরদারিতে দেশের দু’-একটি রাজ্যেই পোস্ত চাষ হয়। বাকি কোথাও পোস্ত চাষ করা দণ্ডনীয় অপরাধ। অথচ, গত ২০০৫-৬ সাল থেকে বীরভূমে বেআইনি পোস্ত চাষের শুরু। প্রচুর অর্থ উপার্জনের হাতছানি থাকায় ওই পথ নিতে বেশি সময় নেয়নি কিছু লোক। জেলার যে কয়েকটি ব্লকে পোস্ত চাষ শুরু হয়, তাদের মধ্যে সামনের সারিতে ছিল দুবরাজপুর ও খয়রাশোল।

নাম না প্রকাশের শর্তে দুবরাজপুরের এক চাষির কাছ থেকে শোনা গেল পোস্ত চাষের লাভের খতিয়ান। তাঁর দাবি, বেআইনি ভাবে চাষ হওয়া পোস্তর আঠার দাম কিলো প্রতি ৫০-৮০ হাজার টাকা। এক বিঘে জমিতে পোস্ত চাষ করে কম করে তিন-চার কেজি আঠা মেলে। এই পরিমাণ জমিতে পোস্ত হতে পারে প্রায় ১৫০ কিলো। যার বাজারমূল্য কম করে প্রতি কিলো ৪০০ টাকা। এ ছাড়া, পাওয়া যায় একই পরিমাণ (১৫০ কিলো) পোস্তর খোলা। গুড়ো করা সেই খোলার দাম কেজি প্রতি পাঁচশো থেকে তিন হাজার টাকা! সহজ হিসেবে এক বিঘে জমিতে পোস্ত চাষে লাভ কম করে আড়াই লক্ষ টাকা! এখানেই শেষ নয়। অনেকে বলছেন, এক কিলো পোস্তর আঠার সঙ্গে রাসায়নিক মিশিয়ে একশো গ্রাম ব্রাউন-সুগার তৈরি করা যায়। যার দাম কম করেও লক্ষ টাকার কাছাকাছি।

স্থানীয় সূত্রের খবর, একেবারে গোড়ায় চাষিদের একাংশকে এ কাজ হাতেকলমে শিখিয়েছিল বহিরাগত মাদক কারবারিরা। সে সময় তারা চাষ করার জন্য কিছু লোককে দাদন দিত। কিন্তু দাদনের চাষে লাভের মুখ দেখে জমি তৈরি, সেচ দেওয়া এবং নির্দিষ্ট সময়ে কী ভাবে পোস্তর আঠা সংগ্রহ করতে হয় সবেতেই সিদ্ধহস্ত হয়ে ওঠে চাষিদের একাংশ। মাঝেমধ্যে দু’-চার কিলো পোস্তর আঠা এবং কয়েক বস্তা পোস্ত-খোল উদ্ধার এবং কিছু ধরপাকড় হলেও ২০০৯ সাল পর্যন্ত কার্যত বিনা বাধায় হতে থাকে বেআইনি পোস্ত চাষ। আনাগোনা বাড়তে থাকে ভিন্-জেলার মাদক কারবারিদের। কিন্তু ওই কারবার চললে বিপদের আশঙ্কা করে রুখতে তৎপর হয় ‘নারকোটিক্স কন্ট্রোল ব্যুরো’র (এনসিবি) পূর্বাঞ্চলীয় শাখা, জেলা পুলিশ ও প্রশাসন। মিলিত চেষ্টা কাজে দেয়। ২০১০-১১ সালে এই কারবার ও চাষ প্রায় নির্মূল করা সম্ভব হয়েছিল। এ জন্য বীরভূম জেলা এনসিবি-র পুরস্কারও পায়।

এলাকাবাসীর অভিজ্ঞতা, ওই সাফল্যের পরে পুলিশ-প্রশাসনের নানা স্তরে যেন কিছুটা সমন্বয়ের অভাব তৈরি হয়। এনসিবি-রও তেমন কোনও সক্রিয়তা চোখে পড়েনি স্থানীয় বাসিন্দাদের। সেই সুযোগে ২০১৩-১৪ সালে ফের অল্প জমিতে শুরু হয় পোস্ত চাষ। স্থানীয়দের একটা বড় অংশের অভিযোগ, সে সময় সে ব্যাপারে প্রশাসনের নানা স্তরে জানিয়েও লাভ হয়নি। প্রশাসনের তরফে বলা হয়েছিল, শুধু সরকারি খাস জমি ও সেচ দফতরের নিয়ন্ত্রণে থাকা জমিতে পোস্ত লাগাচ্ছে চাষিরা। ফলে, কে পোস্ত গাছ লাগিয়েছে, সে সম্পর্কে খোঁজ পাওয়া দুষ্কর হচ্ছে। এ সব ক্ষেত্রে সাধারণত যা দস্তুর—জমির মালিকের বিরুদ্ধে মামলা করা, তা-ও করা যায়নি।

২০১৫ সালে বাড়াবাড়ি হয় ওই বেআইনি চাষের। সে সময় লোকপুর থানা এলাকায় শুকিয়ে যাওয়া হিংলো জলাধারে প্রায় তিন একর জমিতে পোস্ত লাগিয়ে দিয়েছিল মাদক ব্যবসায়ীরা। সে ব্যাপারে পুলিশ এবং আবগারি দফতরকে চিঠি পাঠান সেচ দফতরের এক কর্তা। তাঁর কথায়, ‘‘সরকারি জলাধারও পোস্ত চাষে ব্যবহার করেছিল এত সাহস এদের।’’ স্থানীয় সূত্রের দাবি, গত বছর প্রায় সাড়ে ছ’হাজার বিঘা জমিতে পোস্ত চাষ হয়েছিল। তার মধ্যে প্রায় ১,১০০ বিঘার চাষ নষ্ট করা হয়েছে। ১৩ জনের বিরুদ্ধে মাদক আইনে মামলা করা হয়। কিন্তু পোস্ত চাষের এলাকা এবং পোস্ত-চাষিদের সংখ্যার অনুপাতে তা অনেকটাই কম বলে ধারণা এলাকার একটা বড় অংশের। মানুষের।

‘‘এ বার পরিস্থিতি আলাদা’’, দাবি অতিরিক্ত জেলাশাসক উমাশঙ্কর এসের। তাঁর এবং আবগারি দফতরের জেলা সুপারিন্টেন্ডেন্টের হুঁশিয়ারি, ‘‘কোনও ভাবেই পোস্ত চাষ বরদাস্ত করা হবে না। এটা একটা সামাজিক অপরাধ। যে পোস্ত চাষ করবে, তার বিরুদ্ধে মাদক আইনে মামলা করা হবে।’’ জেলা, ব্লক ও পঞ্চায়েত স্তরে কমিটি গড়ে সচেতনতা-প্রচার এবং‌ উপগ্রহ-চিত্র ধরে নজরদারি চলবে বলেও জানিয়েছেন কর্তারা। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বলেছেন, ‘‘ব্যাপারটা আমাদের নজরেও রয়েছে। মাদক কারবারিদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’

হঠাৎ এখন কেন এই তৎপরতা?

কর্তাদের ব্যাখ্যা, বছরের এই সময়েই পোস্ত বীজ বোনা হয়। এখন কড়াকড়ি করলে ওই বেআইনি কারবারে অনেকটাই বাধা দেওয়া সম্ভব হবে।

প্রশাসন বা পুলিশ কী করে দেখতে আগ্রহী খয়রাশোল, কাঁকরতলার বহু বাসিন্দাই। তাঁরা আওড়েছেন প্রবাদ—‘‘না আঁচালে বিশ্বাস নেই।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Poppy seed Cultivation Procession
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE