শ্যামাদাসীদেবী। —নিজস্ব চিত্র।
দৃষ্টিশক্তি হারাতে বসা এক ব্যক্তির যন্ত্রণা নাড়িয়ে দিয়েছিল তাঁকে। তখনই ঠিক করেছিলেন, মৃত্যুর পরে তাঁর চোখ জোড়া তিনি দান করে যাবেন। পরিজনেরা পাছে ভুলে যান, সে জন্য মৃত্যুর আগের কয়েক বছর নিজের শেষ ইচ্ছের কথা বারবার স্মরণ করিয়ে দিতেন তিনি। নিতুড়িয়ার ভামুরিয়া গ্রামের বৃদ্ধা নব্বুই বছরের শ্যামাদাসী দাসগুপ্তের সেই ইচ্ছাপূরণ হয়েছে।
মঙ্গলবার তিনি মারা যাওয়ার পরে তাঁর চোখ আসানসোলের একটি বেসরকারি চক্ষু হাসপাতালের চিকিৎসকেরা সংগ্রহ করে কলকাতার মেডিক্যাল কলেজে পাঠিয়ে দেন। শ্যামাদাসীদেবীর ওই চক্ষুদান পুরুলিয়ার মতো পিছিয়ে পড়ার জেলার প্রেক্ষিতে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করছেন মরণোত্তর চক্ষুদান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত মানুষজন।
বস্তুত রাজ্যের অন্যতম পিছিয়ে পড়া জেলা পুরুলিয়াতে মরণোত্তর চক্ষুদানের প্রচলন কার্যত নেই বললেই চলে। সেই অর্থে কিছুটা হলেও নজির তৈরি করেছেন ভামুরিয়া বৈদ্যিপাড়ার বাসিন্দা এই বৃদ্ধা। তাঁর পরিবার সূত্রে খবর, প্রাথমিক স্কুলের গণ্ডিও পেরোননি তিনি। বছর পঞ্চাশ আগে তাঁর স্বামী মারা যান। নিঃসন্তান শ্যামাদাসীদেবী সেই থেকে তাঁর ভাইপো ইসিএলের কর্মী দেবাশিস সরকারের কাছেই থাকতেন। দেবাশিসবাবু এলাকায় মরণোত্তর চক্ষুদানের আন্দোলনে অগ্রণী ভামুরিয়া যুবকল্যাণ সমিতির অন্যতম কর্মকর্তা। তিনি জানান, বেশ কয়েক বছর আগে শ্যামাদাসীদেবীর চোখে সমস্যা হওয়ায় আসানসোলের একটি হাসপাতালে চক্ষু চিকিৎসকের কাছে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানেই তিনি দেখেন, চোখের দৃষ্টি প্রায় হারিয়ে বসা এক ব্যক্তিকে। চিকিৎসক তাঁকে জানিয়েছিলেন, অন্য কারও চোখের কর্নিয়া পাওয়া গেলে তবেই তিনি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবেন। দেবাশিসবাবু বলেন, ‘‘চিকিৎসকের ওই কথা শুনে ভেঙে পড়েছিলেন সেই ব্যক্তি। সে দিন সব দেখেশুনে বাড়ি ফেরার পরে পিসিমা বলেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পরে যেন চোখ দান করা হয়।” এক অপরিচিত ব্যক্তির দেখতে না পাওয়ার যন্ত্রণা নাড়িয়ে দিয়েছিল শ্যামাদাসীদেবীকে।
প্রথম দিকে সেই বৃদ্ধার চক্ষুদানের অঙ্গীকারে গুরুত্ব দেয়নি তাঁর পরিবার। কিন্তু যতদিন গিয়েছে মৃত্যুর পরে তার চোখ দেওয়ার বিষয়টি বারবারই পরিজনদের মনে করিয়ে দিয়েছেন। দেবাশিসবাবুর কথায়,‘‘মৃত্যুর আগের কয়েকটা বছর চোখ দেওয়ার বাসনা নেশার মতই পেয়ে বসেছিল পিসিমাকে। বারবারই বলতেন তাঁর শেষ ইচ্ছা যেন পূর্ণ করা হয়। না হলে আত্মা শান্তি পাবে না।”
মঙ্গলবার দুপুরের দিকে শ্যামাদাসীদেবীর মৃত্যুর পরেই দেরি না করে পরিজনেরা যোগাযোগ করেছিলেন আসানসোলের ওই চোখের হাসপাতালের কর্মকর্তাদের সঙ্গে। ভামুরিয়ায় এসে তাঁরা বৃদ্ধার চোখ সংগ্রহ করেন। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের কার্যত নিরক্ষর এক বৃদ্ধার চক্ষুদানের ঘটনা জেলার আরও অনেককে মরণোত্তর চোখ দানে অনুপ্রাণিত করবে বলে মনে করছেন আসানসোলের ওই হাসপাতালের সম্পাদক প্রদ্যুৎ মজুমদার। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের হাসপাতালে চক্ষু সংরক্ষণের ব্যবস্থা এখনও তৈরি হয়নি। তাই সংগৃহীত চোখ পাঠিয়ে দেওয়া হয় কলতাকার আরআইও-তে।’’ তিনি জানান, ৯০ বছরের ওই বৃদ্ধার চোখ কেমন অবস্থায় রয়েছে, ওই চোখের কর্নিয়া অন্য কারও চোখে প্রতিস্থাপিত করা সম্ভব কি না, তা কলকাতার চোখের ওই হাসপাতালের চিকিৎসকরা দেখবেন। না হলে ডাক্তারি পড়ুয়াদেরও কাজে লাগবে।
চক্ষুদান আন্দোলনে যুক্ত লোকজনেরা জানাচ্ছেন, বাস্তব অভিজ্ঞতায় তাঁরা দেখেছেন, প্রথাগত শিক্ষিত লোকজনের মধ্যে এখনও মরণোত্তর চক্ষুদানের ক্ষেত্রে অনেক জড়তা ও কুসংস্কার রয়েছে। সেই দিক দিয়ে শ্যামাদাসীদেবী যে ভাবে এগিয়ে এসেছেন, তা এককথায় বিরল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy