Advertisement
E-Paper

১৪ শাক রোগ প্রতিষেধকও

১৪ প্রদীপ জ্বালানো হলেও কালীপুজোর সঙ্গে ১৪ শাকের সম্পর্ক নিয়ে কোনও সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। ভেষজ উদ্ভিদের বিশেষজ্ঞদের মতে, মূলত স্বাস্থ্যরক্ষার্থে ১৪টি শাক খাওয়ার নিয়মটি এসেছে।

দয়াল সেনগুপ্ত ও দেবস্মিতা চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০১৮ ১২:০৩

দুর্গার মতো কালীকেও অশুভ শক্তির বিনাশ ও শষ্যের দেবী বলে ধরা হয়। কালীপুজো বা দেওয়ালির ঠিক আগের দিন আশ্বিন মাসের চতুর্দশী বা ভূত চতুর্দশীর সন্ধ্যায় বাড়িতে ১৪ প্রদীপ জ্বালানো হয়। সঙ্গে ১৪ রকম শাক খাওয়ার নিয়মও রয়েছে৷ সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, এই প্রথার সঙ্গে শস্যদায়িনী দেবী ভাবনার যোগাযোগ রয়েছে। আর ভেষজ বিজ্ঞানীরা মনে করেন, ঋতু পরিবর্তনের সময়ে বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক হিসেবে এই শাকগুলি খাওয়া হত।
হ্যালোইনের রাতে যেমন মিষ্টি কুমড়ো কেটে ভূতের মুখ বানিয়ে তাতে আলো জ্বালান পশ্চিমীরা, তেমনই ভূত চতুর্দশীতে বাড়ির আনাচে-কানাচে আলো জ্বালানোর রেওয়াজ রয়েছে এই বাংলায়ও। রীতির সঙ্গে জুড়ে রয়েছে নানা গল্পও। ভূত চতুর্দশী নিয়ে পুরাণের যে গল্প পাওয়া যায়, তা হল দানবরাজ বলি যখন স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল দখল করে হত্যাযজ্ঞ চলাচ্ছেন। মানুষ দূরের কথা, অত্যাচার থেকে রেহাই পাচ্ছিলেন না দেবতারাও। বলির তাণ্ডব ঠেকাতে দেবগুরু বৃহস্পতি ভগবান বিষ্ণুকে একটি উপায় বাতলে দিলেন। বামনের ছদ্মবেশে এসে তিন পা জমি দান চেয়ে দানবরাজকে পাতালে পাঠালেন।
কিন্তু লোকবিশ্বাস, জেনে শুনেই বিষ্ণুকে জমি দিয়েছিলেন বলি। তাই পৃথিবীতে তাঁকে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন বিষ্ণু। লোকবিশ্বাস হল, কালীপুজোর আগের রাতে বলি রাজা পাতাল থেকে উঠে আসেন পুজো নিতে। তার সহচর হিসেবে থাকেন শত সহস্র ভূত, প্রেতাত্মা এবং অশরীরী। রয়েছে আরও নানা মত। তবে সমাজবিজ্ঞানীদের মতে সহজ ব্যাখ্যাটি হল, চোদ্দো পুরুষের আত্মাকে তুষ্ট করে অশুভ শক্তিকে বিনাশ করতে এবং ক্ষতিকারক কীটের হাত থেকে হৈমন্তিক ফসল রক্ষা করতে ১৪ প্রদীপ জ্বালানোর এই রীতি। তা নানা ভাবে পালিত হয় বীরভূমেও।
বীরভূমের কোটাসুরের বধূ বাসন্তী মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘দাদু গোবিন্দ মজুমদারের সময় থেকেই দেখেছি এই প্রথা। সংস্কৃতের পণ্ডিত তথা মাড়গ্রামের রসমঞ্জরি স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন তিনি। লুকিয়ে দেখতাম, এই দিনটিতে একটি প্রদীপ বাড়ির দরজায় দিয়ে আসতেন। জিজ্ঞাসা করায় বলেছিলেন অপমৃত্যু রুখতেই এই প্রথা।’’ সিউড়ির বীরভূম মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ পার্থসারথি মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘আমাদের বাড়িতে এই রেওয়াজ নেই ঠিকই। তবে গ্রাম বাংলায় এই প্রথার চল রয়েছে।’’
১৪ প্রদীপ জ্বালানো হলেও কালীপুজোর সঙ্গে ১৪ শাকের সম্পর্ক নিয়ে কোনও সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। ভেষজ উদ্ভিদের বিশেষজ্ঞদের মতে, মূলত স্বাস্থ্যরক্ষার্থে ১৪টি শাক খাওয়ার নিয়মটি এসেছে। বর্ষা বিদায়ের পরে এবং নতুন মরসুমে পৌঁছে পেটের রোগ, কৃমির প্রকোপ, ক্ষুধামন্দের মতো অনেক ধরনের শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। মরসুম বদলের সময় প্রধানত শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতেই এই শাক খাওয়া দরকার। অন্তত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় বিষয়টি তাই দাঁড়ায়।
কী কী শাক রয়েছে? ভেষজ বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, এই ১৪ শাকের মধ্যে পরিচিত পুঁই, নটে বা লাউ শাক নেই। এই শাকগুলি হল যথাক্রমে— ওল, কেঁউ, বেতো, সর্ষে, কালকাসুন্দে, নিম, জয়ন্তী, শাঞ্চে, হিলঞ্চ, পলতা, শৌলফ, গুলঞ্চ, ভাঁটপাতা এবং শুষণী। নব্য-স্মৃতিশাস্ত্রকার রঘুনন্দন এই শাকের কথা উল্লেখ করছেন। এই তালিকায় সহমত জানিয়েছেন জেলায় সরকারি আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক হিসেবে কাজ করে যাওয়া কল্যাণ মুখোপাধ্যায়। তাঁর মতে, শাকগুলি প্রধানত তেতো। ফলে মুখ ও পাকস্থলীতে প্রচুর লালা ও উৎসেচক ক্ষরণ হয়। যা রোগ নিরাময়ে খুবই উপকারী। ঋতু সন্ধিক্ষণে এর চরম উপকারিতা রয়েছে। খেয়াল রাখতে হবে রাসায়নিক বা কীটনাশক দেওয়া শাক যেন আমরা গ্রহণ না করি। তবে ১৪ শাক নিয়ে ভিন্ন মতও রয়েছে। আয়ুর্বেদ মতে, প্রাচীন বাংলায় চোদ্দো শাকগুলি ছিল পালং, লাল, সুষণি, পাট, ধনে, পুঁই, কুমড়ো, গিমে, মুলো, কলমি, সরষে, নোটে, মেথি, লাউ অথবা হিঞ্চে শাক। শহরে তো বটেই গ্রামেও এই সব শাক বিশেষ পাওয়া যায় না। চোদ্দ শাকের হিসেব তাই বুঝিয়ে দিতে হয় অন্য শাক দিয়ে।
এ বছর তিথির হেরফেরে চোদ্দ শাক খাওয়ার দিন পড়েছে কালীপুজোর দিনেই। বোলপুর সংলগ্ন গ্রামগুলিতে চোদ্দ শাক ঠিক খুঁজে বের করে নেন গ্রামবাসী। কিন্তু, খোদ শহরাঞ্চলে কী হবে। তা হলে কি চোদ্দ শাক খাওয়া হবে না! মুশকিল আসান হিসেবে সোমবারের হাটে উপস্থিত হয়েছিলেন ভেদিয়া সংলগ্ন এলাকায় কিছু বৃদ্ধা। গুণে চোদ্দ রকম শাকই এনেছিলেন সকলে। কিন্তু, চোদ্দ শাক খাওয়ার দিন যেহেতু মঙ্গলবার তাই বিক্রি হয়েছে খুব কম। আজ আবার চোদ্দ শাকের পসার নিয়ে তাঁরা হাটে বসবেন বলে জানান। আগের তুলনায় এখন চোদ্দ শাকের বিক্রি অনেক কমেছে বলে জানালেন তাঁরা।
পূর্ণিমা দাস নামের এক শাক ব্যবসায়ী বললেন, ‘‘কয়েক বছর আগেও চাহিদা এত বেশি থাকত, জোগান দিতে পারতাম না। কিন্তু এখন তো বিক্রি অনেক কমে গিয়েছে।’’

Vegetable Kali Puja Disease
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy