Advertisement
০৫ মে ২০২৪

অপহরণ করল কে? এরা তো স্বামী-স্ত্রী

পিচ রাস্তা ধরে ঝড়ের বেগে ছুটে আসছিল সাদা অ্যাম্বাসাডর। পিছনে ততটাই জোরে আসছে গোটা পাঁচেক মোটরবাইক। হঠাৎই রাস্তার মাঝে বাঁশ আর বেঞ্চের ব্যারিকেড দেখে জোরে ব্রেক কষলেন গাড়ি চালক। নিমেষে গাড়িটাকে ঘিরে ধরল কিছু লোক। সাঁ সাঁ করে চলে এল ‘বাইকবাহিনী’ও। হাত পাকিয়ে এক বাইক-আরোহী বললেন, “অনেক দৌড় করিয়েছিস। আমাদের এলাকা থেকে মেয়ে নিয়ে পালানো অত সোজা?”

সমীর দত্ত
বান্দোয়ান শেষ আপডেট: ২০ মার্চ ২০১৪ ০২:০৫
Share: Save:

পিচ রাস্তা ধরে ঝড়ের বেগে ছুটে আসছিল সাদা অ্যাম্বাসাডর। পিছনে ততটাই জোরে আসছে গোটা পাঁচেক মোটরবাইক। হঠাৎই রাস্তার মাঝে বাঁশ আর বেঞ্চের ব্যারিকেড দেখে জোরে ব্রেক কষলেন গাড়ি চালক। নিমেষে গাড়িটাকে ঘিরে ধরল কিছু লোক। সাঁ সাঁ করে চলে এল ‘বাইকবাহিনী’ও।

হাত পাকিয়ে এক বাইক-আরোহী বললেন, “অনেক দৌড় করিয়েছিস। আমাদের এলাকা থেকে মেয়ে নিয়ে পালানো অত সোজা?” পিছনের সিটে জড়োসড়ো হয়ে বসে দুই যুবক-যুবতী। ওই যুবক ও গাড়ির চালককে টেনে বের করার চেষ্টা করলেন কয়েক জন। তখনই এসে পড়ল পুলিশ। আর এই হট্টগোলের মাঝেই যুবতী গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে হাতজোড় করে বলে উঠলেন, “ওকে কিছু করবেন না। ও আমার স্বামী!”

এক মুহূর্তের জন্য সবাই চুপ। এতক্ষণ মারমুখী থাকা এক যুবকের মুখ থেকে ছিটকে এল, “যাঃ বাবা! এরা তো দেখছি স্বামী-স্ত্রী! তা হলে কিডন্যাপ কে করছিল?” এ বার স্বমূর্তিতে ফিরে এক কনেস্টেবল গলা চড়িয়ে বললেন, “অ্যাই ভিড় হঠাও, বাঁশ সরাও।” ওই যুবক-যুবতী এবং তাঁদের গাড়ির চালককে নিয়ে সোজা থানায় পৌঁছল পুলিশ। এমন নাটকের শেষ না দেখে কি পারা যায়? অতএব পুলিশের পিছু পিছু থানায় পৌঁছয় উৎসুক জনতাও। জেরায় জানা গেল, ওই যুবক-যুবতী বিবাহিত।

মঙ্গলবার সন্ধ্যায় এই ভুয়ো ‘অপহরণ-কাণ্ড’কে ঘিরে এমনই ধুন্ধুমার বাধল পুরুলিয়ার বান্দোয়ান-বরাবাজার রাস্তায় ঝাড়খণ্ড সীমানা লাগোয়া ধবনী গ্রামের কাছে। গাড়িতে বসে থাকা ওই যুবকের নাম পরিমল মাহাতো। বাড়ি বাঁকুড়ার হিড়বাঁধ থানার ধানাড়া গ্রামে। তাঁর স্ত্রী, বিষ্ণুুপুর কলেজের বাংলার ছাত্রী সুমিত্রা মান্ডি ওই থানারই ঘাগড়া গ্রামের বাসিন্দা। দু’জনের প্রেম অনেক দিনের। মাস তিনেক আগে তাঁদের রেজিস্ট্রি বিয়ে হলেও মেয়ের পরিবার ওই বিয়ে কখনও ‘মেনে’ নেয়নি। যুক্তি, ছেলে ভিন্ সম্প্রদায়ের। সে জন্যই সুমিত্রাকে ঝাড়খণ্ডে আত্মীয়ের বাড়িতে রেখে আসতে যাচ্ছিলেন তাঁর মা লক্ষ্মীমণিদেবী।

বিভ্রাটের শুরু তার পরেই।

মঙ্গলবার হিড়বাঁধ থেকে একটি বাসে মেয়েকে নিয়ে ঝাড়খণ্ডের কমলপুর থানার কাটিং বাজারে নামেন লক্ষ্মীমণিদেবী। পরের বাসের জন্য সেখানেই ঘণ্টাখানেক ধরে অপেক্ষা করছিলেন তাঁরা। মায়ের নজর এড়িয়ে সুমিত্রা স্থানীয় এক বাসিন্দার মোবাইল থেকে পরিমলকে ফোন করে কাটিং বাজারে এসে তাঁকে নিয়ে যেতে বলেন। স্ত্রীকে নিয়ে শাশুড়ি ‘পালিয়ে’ যাচ্ছেন শুনে মাথা ঠিক রাখতে পারেননি পেশায় গাড়িচালক পরিমল। তাঁর কথায়, “ওর ফোন পেয়েই কিলোমিটারের ভিত্তিতে চুক্তি করে এক পরিচিতের অ্যাম্বাসাডর নিয়ে ছুটি। ওখানে পৌঁছেই সুমিত্রাকে তুলে গাড়িটা বাড়ির দিকে ছোটাতে বলি। কিন্তু, এ রকম বিচ্ছিরি একটা কাণ্ড ঘটে যাবে, তা ভাবিনি!”

মেয়ে গাড়িতে চেপে পালাচ্ছে দেখেই চিল চিৎকার জুড়ে দেন লক্ষ্মীমণিদেবী। কাটিং গ্রামের বাসিন্দা অনুপ মাহাতো বলেন, “আমরা কয়েক জন চায়ের দোকানে আড্ডা মারছিলাম। হঠাৎ শুনি ওই মহিলা চেঁচাচ্ছেন, ‘ধরো ধরো! আমার মেয়েকে তুলে নিয়ে গেল’।” সঙ্গে সঙ্গে অনুপ ও তাঁর বন্ধুরা মোটরবাইক নিয়ে গাড়ির পিছনে ধাওয়া করেন। মোবাইলে খবর যায় আশেপাশের গ্রামেও। ধবনী লাগোয়া চাঁদড়ায় বাড়ি বান্দোয়ান ব্লক যুব তৃণমূলের সভাপতি জগদীশ মাহাতোর। তিনি বলেন, “কাটিং থেকে ফোন পেলাম, একটি মেয়েকে নিয়ে অপহরণকারীরা এই রাস্তা ধরেই আসছে। সঙ্গে সঙ্গে থানায় জানিয়ে গাঁয়ের ছেলেদের রাস্তায় ব্যারিকেড গড়তে বলি।”

ওই ব্যারিকেডেই আটকা পড়ে পরিমলদের গাড়ি। উত্তেজিত জনতা গাড়ি ঘিরে ধরতেই চালক কিছু একটা বলতে যেতেই কলার ধরে তাঁকে টেনে বের করার চেষ্টা শুরু হয়। গাড়ি লক্ষ করে পাথরও ছোড়েন কেউ কেউ। পৌঁছে যায় পুলিশ। জনতা সবে ‘অপহরণকারী’দের উত্তম-মধ্যম দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে, ঠিক তখনই সুমিত্রার কাতর আবেদন “আমাকে কেউ অপহরণ করেনি। এই দেখুন বিয়ের কাগজ। আমরা স্বামী-স্ত্রী!” বান্দোয়ান থানা থেকে মঙ্গলবার রাতেই দু’বাড়িতে খবর যায়।

পরিমল জানান, গাড়ি চালানোর সূত্রেই কয়েক বছর আগে সুমিত্রার সঙ্গে তাঁর আলাপ। পরে তা ভালবাসায় পরিণত হয়। গত ডিসেম্বরে বিয়ের পরে তিন মাস হিড়বাঁধে একটি ঘরভাড়া নিয়ে তাঁরা থাকছিলেন। তাঁর অভিযোগ, মাঝে এক দিন তাঁর অনুপস্থিতিতে সুমিত্রাকে নিয়ে চলে যান শাশুড়ি। সুমিত্রা বলেন, “আমি পরিমলকে ভালবাসি। তাই ওকে বিয়ে করে সংসার করতে চেয়েছিলাম। এতে দোষের কি আছে? কিন্তু, ভিন্ জাত হওয়ায় আমার পরিবার এই বিয়ে মেনে নেয়নি।”

ঘটনার রাতেই পরিমল স্ত্রীকে নিয়ে নিজের বাড়ি ফিরেছেন। সুমিত্রার মা কোনও মন্তব্য করতে চাননি। পরিমলের মা ঊষাদেবী কিন্তু বলেছেন, “সুমিত্রা এখন আমাদের বৌমা। ওর ভালমন্দ আমরাই দেখব।” আর পরিমলের আশা, এখন তাঁকে ‘অপহরকারী’ ভাবলেও দু’একদিন বাদে সুমিত্রার বাবা-মা ঠিকই তাঁদের বুকে টেনে নেবেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

samir datta bandwan kidnap
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE