নায়িকার স্পর্শ। রাজনগরে তাঁতিপাড়ার বৃদ্ধা প্রমীলা দাসের সঙ্গে কথা করছেন শতাব্দী রায়। ছবি: দয়াল সেনগুপ্ত।
রাস্তার অদূরে বাড়ির দরজার সামনে সকাল থেকেই অপেক্ষা করছিলেন অশীতিপর ওই বৃদ্ধা। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পরেই কালো রঙের বড় গাড়িটাকে ধুলো ছুটিয়ে রাজনগরের তাঁতিপাড়ার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে উঠে বসলেন। তাড়াহুড়োয় উঠতে গিয়ে হাতের লাঠিটা পড়ে গিয়েছিল। বৃদ্ধাকে দেখেই অবশ্য গাড়িটা থেমে গেল। জানলা দিয়ে যে মুখটা এগিয়ে এল, সেই শতাব্দী রায়ের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন ওই বৃদ্ধা। প্রায় দেড় মিনিট খুব যত্নে বৃদ্ধার হাত ধরে কথা বলে সভা করতে গ্রামের ভেতরে ঢুকে গেলেন বীরভূম লোকসভা কেন্দ্রের ‘সেলিব্রিটি’ তৃণমূল প্রার্থী।
সোমবার শতাব্দীর প্রচার ঘিরে এমনই নানা টুকরো টুকরো মুহূর্ত তৈরি হল। কখনও রাস্তার দু’পাশে অপেক্ষারত মহিলাদের উদ্দেশে দাবির সুরে বললেন, “শুনুন, ভোটটা কিন্তু আমাকেই দেবেন!” কোথাও দেওয়াল লিখনে নিজেই তুলে নিলেন রং-তুলি। কখনও বা শিশু কোলে নিয়ে আসা মাকে জিজ্ঞাসা করে জেনে নিলেন তার নাম। আবার দুপুরের সভায় মহিলাদের যোগ দিতে দেখে মজা করে প্রশ্ন ছুড়লেন, “আজ আপনারা বাড়ির লোকেদের জন্য রান্না করেননি?” শতাব্দীকে দেখে মনের সাধ মিটেছে তাঁতিপাড়ার ওই বৃদ্ধারও। কী বললেন শতাব্দীকে? একগাল হেসে বৃদ্ধা প্রমীলা দাস বললেন, “ওঁকে দেখবো বলেই তো এত ক্ষণ ধরে বসেছিলাম। সে কথাই বললাম শতাব্দীকে।” এই বয়সে ভিড়ে ঠাসা সভায় যেতে পারবেন না বলেই রাস্তায় অপেক্ষা করছিলেন বৃদ্ধা। শতাব্দী অবশ্য সৌজন্য বিনিময়ে করে জানিয়েছেন, প্রমীলাদেবীর সঙ্গে আলাপ করে তাঁর ভাল লেগেছে।
এ দিন দুপুর পর্যন্ত শুধু রাজনগরের বিভিন্ন জায়গায় ৫টি সভা করলেন শতাব্দী। সকালে সাড়ে ১০টা নাগাদ তিনি রাজনগর ব্লকে পৌঁছে যান। প্রথমে আলিগড়, তার পরে রাজনগর, সেখান থেকে শঙ্করপুর, তাঁতিপাড়া, পেরুল, গণেশপুর, পাতাডাঙায় জনসভা সেরেই পৌঁছে যান পাথরচাপুড়ি দাদাবাবার মাজারে। টকটকে লাল শাড়ি পরা শতাব্দী প্রথম থেকেই ছিলেন খোশ মেজাজে। ভিড়ে ঠাসা ওই সভাগুলিতে মহিলাদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। পাথরচাপুড়িতে চাদর চড়িয়ে ভোটের আশীর্বাদ নিয়ে ফিরেই ছুটলেন সিউড়িতে। তাৎপর্যপূণ ভাবে প্রার্থী তালিকা ঘোষণার পরে এ দিনই প্রথম শতাব্দীর হয়ে প্রচারে নামতে দেখা গেল দলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলকে। বিকেলে সিউড়ির তিলপাড়ায় দলীয় প্রচার সভায় একমঞ্চে দেখা গেল শতাব্দী ও অনুব্রতকে। এমনকী, শতাব্দীকে ভোটে জেতানোর আহ্বানও জানালেন তিনি। দলীয় মঞ্চে এমন ‘সহাবস্থানে’র ছবি দেখে নিন্দুকেরাও বলতে সাহস পাবেন না, তাঁদের মধ্যে কোনও দিন কোনও তিক্ততা ছিল। তবে, শুধু শতাব্দী-অনুব্রতই নন, একই মঞ্চে দেখা গেল জেলার রাজনীতিতে শতাব্দীর মতোই অনুব্রত বিরোধী গোষ্ঠীর লোক বলে পরিচিত সিউড়ির বিধায়ক স্বপনকান্তি ঘোষকেও।
কাছাকাছি। দল একই হলেও জেলার রাজনীতিতে দু’জনই দুই
গোষ্ঠীর প্রতিনিধি হিসেবে পরিচিত। তবে লোকসভা নির্বাচনে
তৃণমূল সাংসদ শতাব্দী রায়ের পরামর্শদাতার ভূমিকায় দেখা গেল
দলের বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলকে। সোমবার
সিউড়ির তিলপাড়ায় ছবিটি তুলেছেন তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়।
দাতা বাবার মাজারে চাদর চড়িয়ে শতাব্দী যখন তিলপাড়ার ওই জনসভায় পৌঁছন ঘড়ির কাঁটায় তখন বিকেল সাড়ে ৪টে অতিক্রান্ত হয়েছে। শতাব্দীর পৌঁছনোর ঘণ্টা দেড়েক আগে থেকেই অবশ্য সভায় ভিড় জমতে শুরু করেছিল। সাড়ে তিনটের মধ্যেই পৌঁছে যান অনুব্রত। দলের অন্য নেতারা তত ক্ষণে বক্তব্য শুরু করে দিয়েছেন। কয়েকটি সভায় মাইক বাজতে দেখা গেলেও তিলপাড়ায় নেতারা ‘হ্যান্ড মাইকে’ই নিজেদের বক্তব্য রেখেছেন। ওই বক্তব্য চলাকালীনই একসময় এক সঙ্গে ঢোকেন শতাব্দী ও স্বপনকান্তি ঘোষ। পরপর বক্তব্য রাখেন স্বপনকান্তি, শতাব্দী। সবার শেষে বলেন অনুব্রত। শতাব্দীর বক্তব্য অবশ্য প্রথম থেকেই ছিল একসুরে বাঁধা। সাংসদ তহবিলের টাকায় তিনি কী কী উন্নয়ন করেছেন, তার খতিয়ান উপস্থিত জনতার সামনে তুলে ধরেন। রাজনগরের সভাগুলির মতোই এখানেও শতাব্দী বলেন, “গত বার জিতিয়ে আপনারা আমার বিশ্বাসের মর্যাদা দিয়েছেন। এ বার ফের জেতান, যাতে বাকি কাজ করতে পারি।” বিরোধীদের উদ্দেশে তাঁর কটাক্ষ, “গত বার নির্বাচনে দাঁড়ানোর সময় আমাকে বহিরাগত বলা হয়েছিল। এমন কথাও বলা হয়েছিল, আমি অভিনেত্রী, ভোট ফুরলেই আমার আর দেখা পাওয়া যাবে না।” শতাব্দীর দাবি, “আমি ওদের ভুল প্রমাণ করেছি। এক জন সাংসদের যা যা করণীয়, তা আমি ঠিক ভাবেই পালন করেছি। শুধু উন্নয়নের জন্যই মানুষ আমাকে জেতাবেন।” অন্য দিকে, স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে অনুব্রত বিরোধীদের আক্রমণ করেন। স্বপনবাবু আবার বিজেপি-কে বসন্তের কোকিল বলে কটাক্ষ করেন। একই সভায় সিপিএম ও কংগ্রেস থেকে কয়েক জন তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন।
আর এ দিনই এক সময়ের সহকর্মী বিজেপি প্রার্থী অভিনেতা জয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্দেশে শতাব্দী বলেন, “ওঁর মুখটাই মানুষের এখন আর মনে নেই। আমাকে বেগ দেওয়ার তাই প্রশ্নই ওঠে না।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy