Advertisement
E-Paper

এক হাতেই প্রতিমা গড়েন বৃদ্ধ

বহু বছর আগে সেটা ছিল এক আশ্বিন মাস। দুর্ঘটনায় ডান হাতটাই বাদ পড়ে গিয়েছিল বছর আঠারোর এক তরুণের। খাওয়া থেকে পোশাক পরা সব কিছুতেই অন্যের সাহায্য নিতে হত। তখন তাঁর মনে হয়েছিল, কী লাভ এ ভাবে বেঁচে থেকে! কিন্তু পরবর্তী সময়ে আর অসহায়তার কাছে দমে যায়নি ছেলেটি। বরং মনের জোরে বাবার সঙ্গে ঠাকুর গড়ার কাজে মগ্ন হয়েছিলেন ওই তরুণ। সেই শুরু। তার পর পেরিয়ে গিয়েছে ছ’টা দশক।

দয়াল সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০১:৪১
রং, তুলি হাতে ননীগোপাল দাস। —নিজস্ব চিত্র

রং, তুলি হাতে ননীগোপাল দাস। —নিজস্ব চিত্র

বহু বছর আগে সেটা ছিল এক আশ্বিন মাস। দুর্ঘটনায় ডান হাতটাই বাদ পড়ে গিয়েছিল বছর আঠারোর এক তরুণের। খাওয়া থেকে পোশাক পরা সব কিছুতেই অন্যের সাহায্য নিতে হত। তখন তাঁর মনে হয়েছিল, কী লাভ এ ভাবে বেঁচে থেকে! কিন্তু পরবর্তী সময়ে আর অসহায়তার কাছে দমে যায়নি ছেলেটি। বরং মনের জোরে বাবার সঙ্গে ঠাকুর গড়ার কাজে মগ্ন হয়েছিলেন ওই তরুণ। সেই শুরু। তার পর পেরিয়ে গিয়েছে ছ’টা দশক। খয়রাশোলের লোকপুরের সেই তরুণ ননীগোপাল দাস এখন এলাকার এক প্রসিদ্ধ প্রতিমা শিল্পী। বর্তমানে ৭৯ বছরের বৃদ্ধ ননীগোপালবাবু আজও একহাতে ঠাকুর গড়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। এ বার ন’টি দুর্গা প্রতিমা এবং দু’টি পট আঁকার বরাত পেয়েছেন। তাই ছাত্র তথা ৪১ বছর ধরে তাঁরই সহকর্মী তরুণ ঘোষকে সঙ্গে নিয়ে ওই কাজ শেষ করতে বৃদ্ধ শিল্পী এখন চরম ব্যস্ত।

সোমবার সকালে যখন বৃদ্ধের সঙ্গে দেখা হল, তখন তিনি নিজের গ্রাম থেকে দু’ কিলোমিটার দূরে আনন্দনগর (চেঙ্গুটি নামেই বেশি পরিচিত) গ্রামে। গ্রামের সর্বজনীন দুর্গা প্রতিমার রঙের কাজ শেষ করে চালি আঁকছেন। বিকালের মধ্যে কাজ শেষ করে অন্য প্রতিমায় রঙের কাজে লাগতে হবে। মাঝে কয়েকটি বিশ্বকর্মা প্রতিমাতেও ‘ফিনিশিং টাচ’ দিতে হবে। কাজ করতে করতে ননীগোপালবাবু বললেন, “নিজের গ্রামের সব ক’টি, রাজনগরের দু’টি, ঝাড়খণ্ডে একটি আর খয়রাশোলের কমলপুর ও আনন্দনগর মিলিয়ে এ বার মোট ন’টি দুর্গা প্রতিমা গড়ছি। মাটির কাজ শেষে একে একে রঙ করে যাওয়া। অধিকাংশ প্রতিমাই বছরের পর বছর ধরে করে চলেছি।”

কীভাবে হাত খোয়ালেন?

কথাবার্তার মধ্যে সেই প্রসঙ্গ আসতেই দীর্ঘশ্বাস পড়ল বৃদ্ধের। বললেন, “বহু বছর আগে দুবরাজপুরে এক আত্মীয়ের বাড়িতে যাচ্ছিলাম। রাস্তার মধ্যে বিদ্যুতের তার পড়ে থাকতে দেখে হাতে করে সরাতে গিয়েছিলাম। কিন্তু বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ওখানেই জ্ঞান হারাই। পথ চলতি মানুষ আমাকে হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করেন।” তিন দিন জ্ঞান ফেরেনি ননীগোপালবাবুর। জ্ঞান ফিরতে বুঝতে পারেন ডান হাত অসাড় হয়ে গিয়েছে। পচনও শুরু হয়েছে। চিকিৎসকরেরা বহু চেষ্টা করেও তা থামাতে পারেননি। শেষে হাতটাই বাদ দিতে হয়। “ভীষণ ভেঙে পড়েছিলাম। বাবা মূর্তি তৈরির কাজ করলেও দুর্ঘটনার আগে আমি কাঁসা পিতলের কারখানায় কাজ করতাম। কিন্তু ডান হাতটাই হারানোয় সেই কাজও চলে যায়। এক বছর ধরে ঘরে বসে থেকে শুধু কষ্ট পেয়েছি। তার পর একদিন এক হাত নিয়েই বাবার সঙ্গে প্রতিমা গড়তে শুরু করি।”বলছেন ননীগোপালবাবু।

প্রতিমা গড়েই সংসার করেছেন, দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। স্ত্রী বিজয়াদেবী সারাক্ষণ পাশে থেকে সাহস জুগিয়ে গিয়েছেন। আনন্দনগর গ্রামের বছর পঞ্চাশের নিত্যগোপাল মণ্ডল বা বছর পঁয়তিরিশের রক্ষাকর দাসেরা বলেন, “সেই কোন ছোটবেলা থেকে ননীকাকাকে ঠাকুর গড়তে দেখতে দেখতে চোখ অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। অন্য কাউকে এই জায়গায় ভাবতেই পারি না।” তিন বছর আগে কমলপুর গ্রামে দুর্গা পুজো শুরু হয়েছে। সেখানেও শিল্পী সেই ননীগোপাল দাস। ওই গ্রামের বধূ তাপসী দাস, রিতা দে-রা বলছেন, “আগে আমাদের গ্রামে দুর্গাপুজো হত না। অন্যগ্রামে প্রতিমা দেখতে যেতাম। গ্রামের আনন্দের কথা ভেবে আমরাও পুজো শুরু করি। এমন একটি পুজো শুরু করার ক্ষেত্রে প্রতিমা গড়তে ননী জেঠু ছাড়া কারও কথা ভাবতেই পারিনি আমরা। আমরা চাই, যত দিন সম্ভব উনিই যেন আমাদের ঠাকুর গড়ে দেন।”

এত কিছুর মধ্যেও আক্ষেপ রয়েছে বৃদ্ধ শিল্পীর। বলছেন, “এখন শরীর আর তেমন সায় দেয় না। চোখে কম দেখি, হৃদযন্ত্রেও সমস্যা ধরা পড়েছে। এখন ঠাকুর গড়ে তেমন আয়ও হয় না। কোনও রকমে পেট চলে। শুধু বার্ধক্য ভাতার উপর নির্ভর করে তো আর সংসার চলবে না।” তাই এখনও প্রতিমা গড়ে যেতে চান ননীগোপালবাবু। তাঁর কথায়, “যা-ই ঘটুক, জীবন থামে না। বরং এই কাজই তো আমায় বাঁচিয়ে রেখেছে!”

dayal sengupta pujo khajuraho
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy