Advertisement
E-Paper

খুনের কথা কবুল ধৃতদের, বলল পুলিশ

চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই ভোলবদল! ৩০৪ হয়ে গেল ৩০২! সমালোচনার মুখে পড়ে বীরভূমের সিপিএম কর্মী শেখ হীরালাল খুনের ঘটনায় রবিবার সিউড়ির বিশেষ আদালতে রবিবার ৩০২ ধারায় (সরাসরি খুনের অভিযোগ) মামলা করতে চেয়ে আবেদন করল বীরভূম জেলা পুলিশ। যারা শনিবার করেছিল অনিচ্ছাকৃত খুনের মামলা (৩০৪ ধারা)। জেলার পুলিশ সুপার রশিদ মুনির খান শনিবার বলেছিলেন “তদন্তে জানা গিয়েছে, হীরালালকে খুন করার মতলবে মারধর করা হয়নি। তাই ৩০৪ ধারা দেওয়া হয়েছে।”

দয়াল সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০১৪ ০২:৪৮
নিহত হীরালাল শেখের শোকার্ত স্ত্রী রেক্সোনা বেগম। কেউবোনায় তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।

নিহত হীরালাল শেখের শোকার্ত স্ত্রী রেক্সোনা বেগম। কেউবোনায় তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।

চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই ভোলবদল! ৩০৪ হয়ে গেল ৩০২!

সমালোচনার মুখে পড়ে বীরভূমের সিপিএম কর্মী শেখ হীরালাল খুনের ঘটনায় রবিবার সিউড়ির বিশেষ আদালতে রবিবার ৩০২ ধারায় (সরাসরি খুনের অভিযোগ) মামলা করতে চেয়ে আবেদন করল বীরভূম জেলা পুলিশ। যারা শনিবার করেছিল অনিচ্ছাকৃত খুনের মামলা (৩০৪ ধারা)। জেলার পুলিশ সুপার রশিদ মুনির খান শনিবার বলেছিলেন “তদন্তে জানা গিয়েছে, হীরালালকে খুন করার মতলবে মারধর করা হয়নি। তাই ৩০৪ ধারা দেওয়া হয়েছে।” সেই পুলিশ সুপারই রবিবার বললেন, “পরিস্থিতি বদলেছে। তাই ওই ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া দু’জনের বিরুদ্ধে ৩০২ ধারায় মামলা করতে চেয়ে এ দিন আবেদন করা হয়েছিল। আদালত তা মঞ্জুর করেছে।”

পরিস্থিতির বদলটা কেন?

এসপি-র জবাব, “আর কিছু বলতে পারব না। আমার আরও অনেক কাজ আছে। এই প্রশ্ন শুনে শুনে আমি ক্লান্ত।”

জেলা সিপিএমের দাবি, তাদের ‘চাপেই’ পরিস্থিতির বদল হয়েছে। এ দিন সকালেই দলের জেলা সম্পাদক দিলীপ গঙ্গোপাধ্যায় পুলিশ সুপারকে ফোন করেন। দিলীপবাবুর দাবি, “পুলিশ আসল ঘটনা ধামাচাপা দিতেই বেশি তৎপর ছিল। আমি প্রশ্ন তোলায় এসপি-র সঙ্গে আমার বাদানুবাদ হয়। তার পরেই এসপি বলেন, তিনি তদন্তকারী অফিসারকে ৩০২ ধারায় মামলা করতে নির্দেশ দিচ্ছেন।” জেলা পুলিশের একাংশ কিন্তু দাবি করছে, ধৃত দুই তৃণমূল কর্মী জেরার মুখে পুলিশের কাছে খুনের কথা কবুল করার পরেই খুনের মামলা দায়ের করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। মামলার সরকারি আইনজীবী অসীমকুমার দাসও বলেন, “ধৃতেরা পুলিশের কাছে অপরাধ কবুল করায় তদন্তকারী অফিসার ৩০২ ধারার জন্য আবেদন করেছিলেন। আদালত তা মঞ্জুর করেছে।”


সিউড়িতে নিহত সিপিএম কর্মী শেখ হীরালালের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে
রবিবার বিকেলে কেউবোনা গ্রামে যান সিপিএম নেতা শ্যামল চক্রবর্তী। হীরালালের
মেয়ে আকসানা ও আরিফা সোফিয়া এবং স্ত্রী রেক্সোনা বিবিকে সান্ত্বনা দেন তিনি।

আবার প্রশাসনের একটা মহল মনে করছে, নির্বাচন কমিশনের গুঁতোও পুলিশি তৎপরতার কারণ হতে পারে। হীরালাল হত্যাকাণ্ডে পুলিশ প্রথমে অনিচ্ছাকৃত খুনের মামলা দায়ের করায় সেই মর্মে বীরভূমের জেলাশাসক রিপোর্টও পাঠিয়েছিলেন নির্বাচন কমিশনে। রবিবার পুলিশ সরাসরি খুনের মামলা দায়ের করায় জেলাশাসক ফের নতুন রিপোর্ট কমিশনের কাছে পাঠিয়েছেন।

ঘটনা হল, পুলিশ প্রথমে অনিচ্ছাকৃত মৃত্যুর মামলা দেওয়ায় শাসক দলের শীর্ষ নেতৃত্বের একাংশও ক্ষুব্ধ এবং বিস্মিত। তাঁদের মতে, পুলিশের ওই কাজের ফলে বিরোধীরা প্রচারের হাতিয়ার পেয়ে গিয়েছে। তবে, আনুষ্ঠানিক ভাবে এই নিয়ে মুখ খুলতে তৃণমূল নেতৃত্ব নারাজ। রাজ্যের মন্ত্রী তথা দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় এ দিন শুধু বলেছেন, “আশা করি, পুলিশের এই সিদ্ধান্তের পরে বিরোধীদের মুখ বন্ধ হবে!” সিপিএম কর্মী খুনের ঘটনা নিয়ে বিরোধীদের ‘কুৎসা’র প্রতিবাদে এ দিন বীরভূমের প্রতি ব্লকে ‘গণতন্ত্র দিবস’ পালন করেছে তৃণমূল। রাজ্য জুড়ে সিপিএমের ‘প্রতিবাদ দিবসে’র পাল্টা হিসাবেই এই কর্মসূচি।

এ দিন শেখ নূর হক ও শেখ জিয়াউর রহমান নামে ধৃত দুই তৃণমূল কর্মীকে বিশেষ আদালতে তোলা হলে ভারপ্রাপ্ত বিচারক সৌরভ জানা রায় ধৃতদের চার দিন পুলিশি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন। বিচারক জানতে চান, ধৃতদের হয়ে কোনও আইনজীবী দাঁড়িয়েছেন কি না। ধৃতেরা না বললে বিচারক তাঁদের জন্য সরকারি আইনজীবী দেওয়ার প্রস্তাব দেন। কিন্তু, কোর্ট লক-আপে দাঁড়িয়ে থাকা নূর ও জিয়াউর জানিয়ে দেন, দল ও পরিবারের সঙ্গে আলোচনা করে তাঁরা আদালতকে জানাবেন। পুলিশের দাবি, জেরার মুখে ধৃতেরা জানিয়েছে, তারা পরিকল্পনা করেই এই খুন করেছে। খুনে ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্র (টাঙ্গি, রড) উদ্ধার করতে এবং জড়িত বাকিদের ধরার ব্যাপারে ধৃতেরা সাহায্য করবেন।

শুক্রবার সিউড়িতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভায় আসার অন্যতম রাস্তা, সিউড়ি-বোলপুর সড়কের সলখানায় একটি কালভার্টের নীচ থেকে বিস্ফোরক উদ্ধার হয়। অভিযোগ, ওই ঘটনার জেরে ঘটনাস্থল থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে কেউবোনা গ্রামে হীরালালকে পিটিয়ে মারা হয়। তৃণমূলের ৮ জনের নামে খুনের অভিযোগ দায়ের করেন হীরালালের দাদা, স্থানীয় কেন্দুয়া পঞ্চায়েতের প্রাক্তন সিপিএম প্রধান শেখ আনারুল।


ক্লিক করুন....

এ দিনই সকালে স্থানীয় একডালিয়া মোড়ে সিউড়ি থানার আইসি-র গাড়ি ঘিরে বিক্ষোভ দেখান এলাকার কিছু তৃণমূল কর্মী। তাঁদের দাবি ছিল, বিস্ফোরক-কাণ্ডে মূল অভিযুক্তকে অবিলম্বে ধরতে হবে। বিস্ফোরক উদ্ধারের ঘটনায় তৃণমূলের এক কর্মী যে ছ’জন সিপিএম কর্মীর নামে এফআইআর করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে তিন জন-সহ পাঁচ জনকে ইতিমধ্যেই ধরেছে পুলিশ। এফআইআরে নিহত হীরালালের নামও ছিল। অভিযোগপত্রে এক নম্বরে নাম থাকা স্থানীয় সিপিএম নেতা শেখ মকিমকেই ধরার দাবি এ দিন মূলত তোলেন তৃণমূলের লোকজন। মকিম আপাতত এলাকাছাড়া।

এ দিন বিকেলে কেউবোনায় যান সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শ্যামল চক্রবর্তী। তাঁকে ঘিরে দলের কর্মী-সমর্থকেরা অভিযোগ করেন, তৃণমূলের বাইক-বাহিনী কেউবোনা, হারাইপুর-সহ আশপাশের গ্রামে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, শাসানি দিচ্ছে। আনারুল বলেন, “শনিবার রাত আর রবিবার সকালেও তৃণমূলের ছেলেরা গ্রামে এসে হুমকি দিয়েছে। বিস্ফোরক-কাণ্ডে বেছে বেছে সিপিএম কর্মী-সমর্থকদের বাড়িতে গিয়ে তল্লাশির জন্য পুলিশকেও ওরা প্ররোচনা দিচ্ছে।”

এ দিনই হীরালাল খুনের ঘটনায় অভিযুক্ত নুর হক ও জিয়াউর রহমানকে বাড়ি থেকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

শ্যামলবাবু তাঁদের আশ্বাস দেন, হীরালালের তিনটি মেয়েরই দায়িত্ব দল নেবে। তবে, এখন নির্বাচন চলায় বিধি মেনে কোনও প্রতিশ্রুতি তিনি দিতে পারছেন না। নিহতের পরিবারের প্রতি তাঁর আরও আশ্বাস, “শুধু আমরা নই, একমাত্র তৃণমূল বাদ দিয়ে রাজ্যের মানুষ এবং অন্য রাজনৈতিক দলগুলিও আপনাদের পাশে আছে।” বস্তুত, এ দিন শ্যামলবাবুর আসার কিছু আগেই নিহতের পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন বীরভূম কেন্দ্রের কংগ্রেস প্রার্থী, দলের জেলা সভাপতি সৈয়দ সিরাজ জিম্মি। তিনি হীরালালের স্ত্রী, দাদা, বাবার সঙ্গে আলাদা ভাবে দেখা করেন। জিম্মির দাবি, “রাজনীতি করতে নয়, মানবিকতার খাতিরেই এই পরিবারের পাশে আমরা দাঁড়াতে চাই। তা ছাড়া, এই পরিবারকে সব রকম সাহায্য করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী।”

আনারুলের সুরেই শ্যামলবাবু এ দিন বলেন, “আমাদেরই এক কর্মী খুনের ঘটনার অন্যতম প্রধান সাক্ষী এবং প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ার শাস্তি পেতে হল হীরালালকে। যেখানে হীরালাল খুন হয়েছে, সেই জায়গাটা আমি দেখেছি। যেখানে বিস্ফোরক রাখা হয়েছিল বলে অভিযোগ, সেটাও দেখেছি।” তাঁর অভিযোগ, এটা হল ‘পূর্ব-পরিকল্পিত সচেতন’ চক্রান্ত। আর এই চক্রান্তের নায়িকা খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি নিজে বারবার বিরোধীদের বিরুদ্ধে তাঁকে খুনের চক্রান্তের অভিযোগ তুলছেন। আর দলনেত্রীর সেই অভিযোগকে ঢাল করেই বাম-সহ বিরোধী দলের কর্মীদের উপরে রাজ্য জুড়ে হামলা চালাচ্ছে তৃণমূল। এ দিন দুর্গাপুর শহরের ফুলঝোড়ে এক নির্বাচনী জনসভায় সিপিএমের বর্ধমান জেলা সম্পাদক অমল হালদারও অভিযোগ করেন, “মুখ্যমন্ত্রীর প্ররোচনাতেই ওই খুনের ঘটনা ঘটেছে।”

শ্যামলবাবু চলে যাওয়ার পরে সিপিএমের জেলা নেতারা যখন কেউবোনা থেকে বেরোচ্ছেন, ঠিক তখনই গ্রামে ঢুকছে তৃণমূলের ‘ধিক্কার মিছিল’। সিপিএম নেতাদের দেখে স্লোগান জোরালো হল মিছিল থেকে। পুলিশ থাকায় অপ্রীতিকর পরিস্থিতি আপাতত এড়ানো গেল। বোধহয় আপাততই। নিহতের দাদার আশঙ্কা, “সব সময় তো আর পুলিশ থাকবে না! তখন আমাদের কে বাঁচাবে?”

ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়।

dayal sengupta hiralal seikh siuri tmc
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy