হেঁশেল সামলানোর ফাঁকেই চলছে পড়াশোনা। —নিজস্ব চিত্র।
স্কুলের একাদশ শ্রেণির নতুন ব্যাচের সে দিনই ছিল প্রথম ক্লাস। এক মহিলা ক্লাসে ঢুকতেই পড়ুয়ারা তাঁকেই শিক্ষিকা বলে ভুল করেছিল। অচিরেই ভুল ভাঙেন বছর বিয়াল্লিশের কেকা গোস্বামী। তিনি যে শিক্ষিকা নন, তাদেরই সহপাঠী, সে কথা নিজের সন্তানের থেকেও ছোট ছোট ওই ছাত্রছাত্রীদের জানিয়েছিলেন কেকাদেবী। পেশায় আশাকর্মী, ঘর-সংসারটাও দেখতে হয় তাঁকে। এ সব কিছু সামলে দু’বছর ক্লাস করে সেই কেকাদেবীই এ বার খয়রাশোল পাঁচড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের অন্যতম উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী! তাঁর এই অধ্যবসায় পথ দেখাচ্ছে বহু গৃহবধূকে। যাঁরা সংসারের টানে মাঝপথেই নিজেদের পড়াশোনা ছেড়েছেন।
কেকাদেবী বাপের বাড়ি এবং শ্বশুরবাড়ি পাঁচড়া গ্রামেই। স্বামী সুখময় গোস্বামী একটি বেসরকারি মোবাইল সংস্থার হয়ে কাজ করেন। এক মাত্র ছেলে সৌভিক ২০০৯ সালে উচ্চ মাধ্যমিকে ভাল ফল করে কলেজে ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু, সংসারের সাহায্যে প্রথমে সিভিক ভলান্টিয়ার্স ও পরে একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজের খোঁজে গ্রাজুয়েশন সম্পূর্ণ করেনি। অধিকাংশ সময়ই স্বামী ও ছেলে বাড়ির বাইরে থাকেন। কিন্তু, পরিবারের সমর্থনেই ফের পড়াশোনা শুরু করেন কেকাদেবী। আর পড়াশোনা চালাতে সমানে সাহায্য করেছে স্কুলও।
আবার পড়াশোনা শুরু করলেন?
রবিবার রান্না করতে করতে শেষ সময়ের প্রস্তুতির ফাঁকে কেকাদেবী জানান, ১৯৯০ সালে পাঁচড়া স্কুল থেকেই তিনি মাধ্যমিকে বসেছিলেন। কিন্তু, ইতিহাসে ব্যাক পান। সে বছরই তাঁর বিয়ে হয়ে যায়। তিনি বলেন, “কিন্তু, মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার ইচ্ছেটা কোথাও মনের মধ্যে ছিল। যদিও সংসার, সন্তান এই সব নিয়ে সেটা আর পেরে উঠতে পারিনি।” ২০০৯ সালে কেকাদেবী পাঁচড়া উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের অধীনে আশাকর্মী হিসাবে কাজে যোগ দেন। ওই কাজ করতে করতেই ২০১১ সালে রবীন্দ্র মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক সম্পূর্ণ করেন। কিন্তু, উচ্চমাধ্যমিক কী ভাবে হবে, এটা ভাবতে ভাবতেই তাঁর আরও দু’বছর গড়িয়ে যায়। কেকাদেবী বলেন, “পরে জানতে পারি, আমাদেরও নিয়মিত পরীক্ষার্থী হিসাবে উচ্চমাধ্যমিক করার সুযোগ রয়েছে। সেই ভেবে নিজের পুরনো স্কুলে ভর্তি হলাম। ভাই কৌশিকের কাছে টিউশনও নিতে শুরু করি।” কিন্তু, সারাদিন কাজের বাইরে পড়াশোনা, স্কুল, রান্নাবান্না সব ঠিক মতো করা সম্ভব হয় না। তার উপর বাড়িতে সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরে নিত্যপুজো, গোয়ালে গরু সবই তাঁকে সামলাতে হয়। এ সবের মধ্যেই চলছে কেকাদেবীর পরীক্ষার প্রস্তুতি। তিনি বলেন, “স্কুলের শিক্ষকেরা, সহপাঠীরা, স্বামী, ছেলে, ভাই সবাই খুব সাহায্য করেছেন। ওঁরা না থাকলে এতদূর এগোতেই পারতাম না।”
সহপাঠী, স্কুলের শিক্ষক, পরিবারের সদস্য থেকে সহকর্মী সকলেই নিশ্চিত পরীক্ষায় ভাল ভাবেই পাশ করবেন কেকা। তবে, তার থেকেও বড় কথা, দু’ দশকের বেশি সময় পরে সংসার ও কাজ সামলে এক জন মহিলা যে ভাবে পড়াশোনা শুরু করার সাহস দেখিয়েছেন, সেই সাহসটাকেই কুর্ণিশ জানাচ্ছেন সকলে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক সহদেব গোপের কথায়, “মনের জোর থাকলে এক জনের পক্ষে কোনও বাধাই বাধা নয়, বয়সটাও কোনও বিষয় নয়। সেটাই দেখিয়ে দিচ্ছে কেকা।” প্রথমটায় কিছুটা জড়তা থাকলেও সহপাঠীদের সেই জড়তা কাটিয়ে দিয়েছিলেন কেকাদেবীই। তবে, সহপাঠীদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটা মা এবং সন্তানই রয়ে গিয়েছে। সহপাঠীরা তাঁঁকে কেকা-মা বলেই ডাকেন। সহপাঠী অষ্টম কবিরাজ, অসীম মণ্ডলরা বলছেন, “আমরা একসঙ্গে টিউশন পড়ি, ক্লাস করি। তবে, ওঁর কাছে আমারাও শিখলাম পড়াশোনার কোনও বয়স নেই!” পিসি কেকাদেবীর সঙ্গে ভাইজি দিশা চট্টোপাধ্যায়ও এ বার উচ্চমাধ্যমিক দিচ্ছে। দিশা বলছে, “কার কেমন লাগছে জানি না। পিসির এই উদ্যোগে এক জন মেয়ে হিসেবে আমি দারুণ অনুপ্রাণিত।”
তাঁর এই অধ্যবসায় অনুপ্রাণিত করেছে কেকাদেবীর সহকর্মীদেরও। ইতিমধ্যেই দুই আশাকর্মীও প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হয়েছেন। আশাকর্মীদের বামপন্থী সংগঠন ‘পশ্চিমবঙ্গ আশাকর্মী ইউনিয়ন’-এর জেলা সভানেত্রী আয়েশা খাতুন বলছেন, “প্রথমত সংসারের কাজ রয়েছে। এর পাশাপাশি যে ভাবে আশাকর্মীদের কাজ করতে হয়, তার উপর কেউ যদি পড়াশোনা করতে পারেন, সেটা অবশ্যই বাকিদের কাছে অনুপ্ররণা জোগাবে।” কেকাদেবীর পড়াশোনার উদ্যোগকে প্রশংসা করেছেন খয়রাশোলের ভারপ্রাপ্ত পিএইচএন বনশ্রী ঘোষ কবিরাজও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy