Advertisement
E-Paper

চৌদল যাত্রা বন্ধ, সম্বল শুধু স্মৃতি

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৪ মার্চ ২০১৫ ০২:২৭
কৃষ্ণ-বলরাম।—নিজস্ব চিত্র

কৃষ্ণ-বলরাম।—নিজস্ব চিত্র

ভক্তদের কাঁধে ভর করে চৌদলে চড়ে রাতে নগর পরিক্রমা করতেন কৃষ্ণ-বলরাম। রাতের আঁধার দূর করতে নগর পরিক্রমায় জ্বালানো হত হ্যাজাক। কাতারে কাতারে মানুষ সেই শোভাযাত্রায় থাকতেন। সেই খুশিতে দোলের দু’দিন আগে থেকেই বাতাসে নানা রঙের ফাগ উড়ে বেরাত সিমলাপালের আকাশে-বাতাসে।

সিমলাপাল রাজবাড়ির দোল উৎসবের ‘ট্র্যাডিশন’-ই ছিল দোলের আগের দু’দিন কৃষ্ণ-বলরামের চৌদল যাত্রা। বর্তমানে প্রায় দু’দশক হতে চলল সেই শোভাযাত্রা বন্ধ। নগর পরিক্রমার বদলে এখন রাজবাড়ি থেকে কয়েকশো মিটার দূরের আটচালা পর্যন্ত এই যাত্রা করিয়ে কোনও মতে প্রথাটাকে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। যার জেরে দোল উৎসবের আমেজ এখন অনেকটাই ফিকে হয়ে গিয়েছে বলে মত বাসিন্দাদের একাংশের। এই শোভাযাত্রাকে ঘিরে সিমলাপাল ও জ্যোড়ষার সাধারণ মানুষের মধ্যে উন্মাদনা কম ছিল না। প্রবীণরা জানাচ্ছেন, গ্রামের প্রায় প্রতিটি ঘরে ঘরেই ইট-মাটি দিয়ে একটি বেদি গড়া হত ঠাকুরের জন্য। অলপনা এঁকে সাজানো হত বেদি। অনেকে বেদিতে ছড়িয়ে দিতেন আবির। চৌদলটিকে ওই বেদির উপরে নামিয়ে পুজো করা হত প্রতিটি বাড়িতে। এই চৌদলযাত্রা মূলত শুরু হত বিকেলের পরে। প্রথম দিন দক্ষিণবঙ্গীয় ব্রাম্ভ্রণ এই রাজপরিবারের তৎকালীন রাজধানী সিমলাপাল নগর পরিভ্রমণ করানো হত। পরের দিন চৌদল যেত পাশের জ্যোড়ষা গ্রামে। বাসিন্দাদের বিশ্বাস, বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুজো নিতেন কৃষ্ণ-বলরাম। হরিধ্বনী দিয়ে ঠাকুরকে স্বাগত জানাতেন গৃহস্থ। চৌদাল যাত্রা উপলক্ষে সুন্দর একটি শোভাযাত্রা বের হত গ্রামের রাস্তায়। যার আগেভাগে থাকত হ্যাজাকের আলো। ঢোল, ঢাকের সঙ্গে পরবর্তীকালে ব্যান্ডপার্টিও যুক্ত হয়েছিল এই শোভাযাত্রায়।

তবে চৌদল কাঁধে তোলার অধিকার ছিল শুধু ব্রাহ্মণদেরই। তবে সমস্ত সম্প্রদায়ের মানুষই পা মেলাতেন শোভাযাত্রায়। বর্তমানে চৌদল যাত্রার পরিবর্তে দোলের দু’দিন আগে বিগ্রহকে রাজবাড়ির দোলমঞ্চে রাখা হয়। এখন বাড়ি বাড়ি যাওয়ার প্রথায় ছেদ পড়েছে। তাই ঠাকুরের সঙ্গেই সাধারণ মানুষ দেখা করতে আসেন রাজবাড়ির দোল মঞ্চে। দোলের দিন নাম সংকীর্তন হয় ধুমধাম করে। সাধারণ মানুষ ফাগ ছড়িয়ে দেয় কৃষ্ণ-বলরামের গায়ে। কিন্তু চিরাচরিত চৌদল যাত্রার প্রথা কী ভাবে বন্ধ হয়ে গেলে তা নিয়ে আজও ধোঁয়াশা এলাকাবাসীর মধ্যে।

রাজবাড়ির বর্তমান উত্তরসূরী চিরঞ্জীব সিংহ চৌধুরীর কথায়, “ঠাকুরকে নিয়ে সন্ধ্যায় বের হতেন সবাই। পরের দিন সূর্য ওঠার আগেই মন্দিরে ঠাকুরকে ফিরিয়ে আনাই ছিল প্রথা। কিন্তু বর্তমানে জনবসতি এত বৃদ্ধি পেয়েছে যে ওই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সবক’টা বাড়ি ঘোরা সম্ভব নয়।” এই কারণেই চৌদল যাত্রা বন্ধ হয়ে গিয়েছে বলে যুক্তি তাঁর। অন্য দিকে, রাজপরিবারের সদস্য পেশায় চিকিৎসক অবনীরঞ্জন সিংহবাবুর কথায়, “চৌদল কাঁধে নেওয়ার অনুমতি কেবল দক্ষিণবঙ্গীয় ব্রাহ্মণদের ছিল। ব্রাহ্মণ পরিবারের বর্তমান প্রজন্মের অধিকাংশ ছেলের মধ্যে এই উৎসব নিয়ে আগ্রহ এখন কমে যাওয়াতেই চৌদলযাত্রা বন্ধ হয়ে গিয়েছে।’’ আবার জ্যোড়ষা গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা অনিল পতির কথায়, তাঁরা বছরভর দোলের এই চৌদল যাত্রায় পা মেলানোর অপেক্ষায় থাকতেন। তাঁর স্মৃতি এখনও উজ্জ্বল, “তখন চৌদল যাত্রায় কত আনন্দ হত। আজকাল দিন বদলেছে। প্রাচীন এই প্রথাকে বয়ে নিয়ে যাওয়ার মানসিকতার অভাব রয়েছে সর্বস্তরেই।” জ্যোড়ষার যুবক অভিজিৎ সিংহ মহাপাত্র ও সিমলাপালের যুবক অরিজিৎ খানদের কথায়, “ছোটবেলায় রাত জেগে বসে থাকতাম এই চৌদল যাত্রা দেখার জন্য। বড়রা বলত চৌদলের তলা দিয়ে গেলে নাকি পড়াশোনা ভাল হয়।” সেই চৌদল যাত্রা এলাকায় না বের হলেও এখনও স্মৃতি আর প্রচলিত বিশ্বাসের কথা দোলের সময় ফাগের মতোই ওড়ে সিমলাপালের আকাশে-বাতাসে।

tradition balaram chaudal yatra bankura
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy