Advertisement
E-Paper

ছৌ মুখোশেই মজে গেল ফরাসি বালিকা

রাসমঞ্চের সামনে এক দল ফরাসি শিল্পী। আর এক টুকরো শার্লি এবদো। কিন্তু সেটাই এক মাত্র কথা নয়। বরং গল্পের সুতোর বুনোট টান হয়ে উঠল যখন ঝাঁপান গানের তালে শিল্পী চন্দন বাউরির সর্বাঙ্গে পাক খেতে লাগল গোখরো, তেঁতুলাখরিশ, দুধাখরিশের মতো বিষধর সব সাপ। আর একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে সে দিকে চেয়ে থাকতে-থাকতে ফরাসি নাট্যদল ‘ক্রেয়া’র নির্দেশক তথা অভিনেত্রী ওদ মার্শ্যাল বলে ফেললেন— “এমন পারফরম্যান্স প্রথম দেখলাম। মানুষের সঙ্গে সাপের এ কী অদ্ভুত সম্পর্ক!”

সোহিনী মজুমদার

শেষ আপডেট: ২১ জানুয়ারি ২০১৫ ০২:০৭
পরিবারের সঙ্গে বসে ছৌ নাচ দেখছেন স্তিফেন। ছবি: শুভ্র মিত্র।

পরিবারের সঙ্গে বসে ছৌ নাচ দেখছেন স্তিফেন। ছবি: শুভ্র মিত্র।

রাসমঞ্চের সামনে এক দল ফরাসি শিল্পী। আর এক টুকরো শার্লি এবদো।

কিন্তু সেটাই এক মাত্র কথা নয়। বরং গল্পের সুতোর বুনোট টান হয়ে উঠল যখন ঝাঁপান গানের তালে শিল্পী চন্দন বাউরির সর্বাঙ্গে পাক খেতে লাগল গোখরো, তেঁতুলাখরিশ, দুধাখরিশের মতো বিষধর সব সাপ। আর একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে সে দিকে চেয়ে থাকতে-থাকতে ফরাসি নাট্যদল ‘ক্রেয়া’র নির্দেশক তথা অভিনেত্রী ওদ মার্শ্যাল বলে ফেললেন— “এমন পারফরম্যান্স প্রথম দেখলাম। মানুষের সঙ্গে সাপের এ কী অদ্ভুত সম্পর্ক!”

গড়জয়পুরের ছৌ দল অন্বেষা অ্যাকাডেমির ‘মহিষাসুরমর্দিনী পালা’ দেখেও সেই একই মুগ্ধতা। অত বড় মুখোশ নিয়ে লাফানো, ডিগবাজি, যুদ্ধ দেখে বেজায় খুশি ছোট্ট আর্থার, মেলিসা, অ্যালিসরা। প্রথম শ্রেণির পড়ুয়া অ্যালিস তো ছৌয়ের বাজনা বেজে ওঠা থেকেই লাফাচ্ছে। আসলে গত শুক্রবার বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর হাইস্কুল মোড়ের মাঠে রাজ্য পর্যটন দফতরের সহায়তায় ‘আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দ্যু বেঙ্গল’ এবং ‘ফ্রিড’ নামে একটি সংস্থার যৌথ আয়োজনের মূল সুরটাই ছিল তাই— ফরাসিদের সঙ্গে বাংলার লোকশিল্পকে মিলিয়ে দেওয়া। আর মুখের ভাষা নয়, মঞ্চে একের পর এক ফুটে ওঠা শরীরী ভাষাই বেঁধে দিল সেতু।

রাত তখন প্রায় ৯টা। মঞ্চে শুরু হল ফরাসি পুতুল-নাটক ‘পাকোতি’। যদিও কনকনে ঠান্ডায় দর্শকের ভিড় দেখে রাত বা শীত কোনওটাই বোঝার উপায় নেই। পার্কে বসে এক রাখাল ছেলের জাদুবাক্স পাওয়ার পরে নানা রহস্যজনক ঘটনার ঘনঘটা নিয়ে নাটক। খবরের কাগজের মণ্ড দিয়ে তৈরি মুখোশে মূকাভিনয়ের ভেল্কি। তা দেখে মুহূর্মুহূ হেসে গড়িয়ে পড়ল সামনের সারিতে বসা খুদের দল। কেউ আবার চকিতে মিল খুঁজে পেল মিস্টার বিনের সঙ্গে। ভিনদেশি দর্শকদের থেকে আশাতীত সাড়া পেয়ে ওদ বললেন, “রাসমঞ্চকে পিছনে রেখে খোলা আকাশের নীচে এই অনুষ্ঠান এক কথায় অভূতপূর্ব। বাক্ স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার বিরোধিতা করতেই সংবাদপত্র দিয়ে মুখোশ তৈরি করে নির্বাক অভিনয় করছি। এখন তা আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।”

“আমাদের নাচও তো ওঁদের মতোই মুখোশ পরে হয়। বাজনাও বাজে। কিন্তু কোনও সংলাপ নেই” — ধরতাইটা ধরিয়ে দিলেন ছৌশিল্পী ধনঞ্জয় মাহাতো। সহশিল্পী হিসেবে বিদেশিদের সঙ্গে মঞ্চ ভাগ করার অভিজ্ঞতা তাঁর বা স্থানীয় ধানগোড়া গ্রামের ঝাঁপান শিল্পী চন্দনবাবুর এই প্রথম। এর আগে তাঁরা রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে নাচ দেখানোর কোনও ডাক পাননি। মেলেনি বিদেশি শিল্পীদের সঙ্গে সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের সুযোগও। তাই তাঁরা চুটিয়ে উপভোগ করেছেন এই উৎসব। যেমন করেছেন এলাকার মানুষও। এমনকী বিষ্ণুপুর ঘুরতে আসা কিছু জার্মান পর্যটকও দলে ভিড়ে গিয়েছেন। স্থানীয় বাসিন্দা মানব রুদ্র, সূর্যকান্ত বিশ্বাস জানালেন, আগে হাইস্কুলের মাঠে বিষ্ণুপুর উৎসবে মার্গ সঙ্গীতের অনুষ্ঠান হত। দু’বছর হল তা বন্ধ। কাগজে এই অনুষ্ঠানের আগাম খবর পড়েই তাঁরা এসেছেন। তাঁদের দাবি, ঠিকঠাক প্রচার হলে মাঠে লোক ধরানো যেত না।

শার্লি এবদোর সঙ্গে সংহতিতে।

পর্যটন দফতর সূত্রে দাবি করা হচ্ছে, এলাকায় মাইকে প্রচার চালানো হয়েছে। পর্যটন মন্ত্রী ব্রাত্য বসুর কথায়, “আঞ্চলিক সংস্কৃতির সঙ্গে পর্যটনের যোগ ঘটাতেই এই উদ্যোগ। এ ভাবে আমরা সাংস্কৃতিক পর্যটনের একটা ধারা তৈরি করার চেষ্টা করছি।” যে কারণে বিষ্ণুপুরের মন্দির ঘুরিয়ে পরে গ্রামে নিয়ে গিয়ে বালুচরী শাড়ি তৈরি দেখিয়ে আনা হয়েছে বিদেশিদের। টেরাকোটার গ্রাম পাঁচমুড়া বাদ পড়েনি। ফ্রিড সম্পাদক সোমনাথ পাইন বলেন, “পর্যটনের সঙ্গে সংস্কৃতির এই যোগ ঘটানো গুরুত্বপূর্ণ।” আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ-এর ডিরেক্টর স্তিফেন আমালির বলেন, “আমাদের দেশের শিল্পীদের নিয়ে এ অনুষ্ঠান এই প্রথম করলাম। এতটুকু শহরে এত ভাল সাড়া পাব, ভাবতেই পারিনি।” প্রাণের সাড়ার ছোঁয়া বোঝা গিয়েছে বারে বারেই। ছৌয়ের পালার শেষে পুত্র-কন্যা-সহ সিংহাসীনা দুর্গার ছবি মোবাইলে ধরে রাখতে দর্শকদের হুড়োহুড়িতে ফের এক বার দৃশ্য মঞ্চস্থ করতে হল। ‘পাকোতি’র পরে আবার ফরাসি দলটিকে ভালবাসা জানাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল ঝিনুক-রুদ্রনীলেরা।

সময় থমকে গেল এক বারই। যখন নাটক শেষে নানা ভাষায় ‘জ্য সুই শার্লি’ লেখা পোস্টার নিয়ে সার দিয়ে দাঁড়ালেন ফরাসি অভিনেতারা।

বিষ্ণুপুর আঙুল ধরল প্যারিসের।

cultural tourism chhau dance sohini majumdar bishnupur
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy