Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
মুরারই

ডাক্তারবাবুকে ভোলেনি মুরারইবাসী

মিত্রপুর পাকা সড়কে উঠে ভাদিশ্বর মোড়ে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়েই যাচ্ছিলেন জাফারুজ্জামান মিলন। পাথর ওঠা রাস্তার গর্ত থেকে কোনও মতে পা সামলে, পরিচিত মুখ দেখে তাঁর খেদ, “সত্যি কথা বলতে কী জানেন, এখন মুরারইবাসীর চাওয়া-পাওয়ার সুরটাই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে! যদিও বা ডাক্তারবাবু বেঁচে থাকাকালীন প্রশাসনের কর্তারা ভয়ে হোক, ভক্তিতে হোক একটু নড়ে চড়ে বসতেন। উনিও গিয়েছেন, মুরারইয়ের উন্নয়নও শিকেয় উঠেছে!”

নেতা, কর্মী-সমর্থকদের মাঝে মোতাহার হোসেন (চালকের বাঁ দিকে)। —ফাইল চিত্র।

নেতা, কর্মী-সমর্থকদের মাঝে মোতাহার হোসেন (চালকের বাঁ দিকে)। —ফাইল চিত্র।

অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়
নলহাটি শেষ আপডেট: ১৮ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:১০
Share: Save:

মিত্রপুর পাকা সড়কে উঠে ভাদিশ্বর মোড়ে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়েই যাচ্ছিলেন জাফারুজ্জামান মিলন। পাথর ওঠা রাস্তার গর্ত থেকে কোনও মতে পা সামলে, পরিচিত মুখ দেখে তাঁর খেদ, “সত্যি কথা বলতে কী জানেন, এখন মুরারইবাসীর চাওয়া-পাওয়ার সুরটাই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে! যদিও বা ডাক্তারবাবু বেঁচে থাকাকালীন প্রশাসনের কর্তারা ভয়ে হোক, ভক্তিতে হোক একটু নড়ে চড়ে বসতেন। উনিও গিয়েছেন, মুরারইয়ের উন্নয়নও শিকেয় উঠেছে!”

তিন বছর হল চলে গিয়েছেন এলাকার উন্নয়নের সফল রাজনৈতিক মুখ, মুরারইয়ের ‘ডাক্তারবাবু’, মোতাহার হোসেন। কিন্তু এই তিন বছরে এলাকার মানুষ তাঁকে, তাঁর দেখানো উন্নয়নের দিশাকে ভোলেনি। ভাদিশ্বরের বাসিন্দা, মুরারই নাগরিক কমিটির সম্পাদক জাফারুজ্জামানের মতোই তাঁরা রোজকার দুঃখ-সুখে তাঁকে স্মরণ করেন।

পেশায় চিকিত্‌সক মোতাহার ২০০৬ সাল অবধি ভোটে লড়েছেন। কিন্তু জেলার রাজনীতিতে তাঁর গুরুত্ব ছিল রীতিমতো। ১৯৩০ সালে ২৯ অগস্ট মুরারই থানার ভীমপুরে জন্মগ্রহণ করেন প্রয়াত এই কংগ্রেস নেতা। মুরারই বিধানসভার ছ’বারের কংগ্রেস বিধায়ক থাকতেন, রামপুরহাটের ১০ নম্বর ওয়ার্ডে। ট্রেনের জন্য হাঁটতে হাঁটতে সে সব কথাই বলছিলেন জাফারুজ্জামান। জানা গেল, মুরারই স্টেশনে কলকাতা বা বর্ধমান যাওয়ার জন্য সকালের দিকে কোনও ট্রেন নেই। তিনি বলছিলেন, “সেই কবে ডাক্তারচাচার নেতৃত্বে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের স্টপেজ হয়েছে। তারপরে ট্রেনের সংখ্যা বেড়েছে, কিন্তু দীর্ঘ দিন ধরে কলকাতা-বালুরঘাট এক্সপ্রেস, হাওড়া-গয়া এক্সপ্রেস ট্রেনগুলির স্টপেজের জন্য আন্দোলন চালিয়েও কাজ হচ্ছে না। গতানুগতিক ভাবে দিন কাটছে মুরারইবাসীর।”

মোতাহার হোসেনের রাজনৈতিক ইতিহাস সুদীর্ঘ। ১৯৪৭ সালে স্কুল ফাইনাল পাশ করে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে এলএমএফ পড়েন। পরবর্তীতে তিনি কলকাতা থেকে এমবিবিএস পাশ করেন দীর্ঘ দিন তিনি রামপুরহাট শহরে একটি নার্সিংহোমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৬২ সালে প্রথম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন এই কংগ্রেস নেতা। ওই বছর মুরারই থানার আমডোল পঞ্চায়েতের প্রধান হন। এবং তত্‌কালীন আঞ্চলিক জেলা পরিষদের সদস্যও হয়েছিলেন তাঁর বাবা প্রয়াত কুরবান হোসেন। তিনি ছিলেন এলাকার দোর্দন্ড প্রতাপ জমিদার ও কংগ্রেস নেতা।

সে রাস্তা হোক অথবা, পানীয় জল, মুরারইয়ের উন্নয়নে ঘুরে ফিরে আসে এই পরিবারের নাম। ভাদিশ্বর থেকে ধীতোড়া পর্যন্ত পাইপ লাইনের মাধ্যমে প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর আগে পরিশ্রুত পানীয় জলের ব্যবস্থা হয়েছিল এই ‘ডাক্তারবাবু’-র হাত ধরেই। এখন তার বেহাল অবস্থা। এলাকার বাসিন্দা আসরাফুল হোসেন বললেন, “পানীয় জল প্রকল্প ধ্বংসের মুখে। আগে তিন বেলা জল আসত। এখন দু’বেলা দেয়। কিন্তু মুরারই বাজার থেকে ভাদিশ্বর, ধীতোড়া, হাসপাতাল পাড়া বিস্তৃর্ণ এলাকা জুড়ে জল সরবরাহের জন্য ট্যাপ থেকে আর জল পাওয়া যায় না। পানীয় জল প্রকল্পে জলশোধন করার যন্ত্রাংশ বিকল হয়ে গিয়েছে।” মুরারই পঞ্চায়েতে এখন প্রধান নির্বাচন উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত আছে। পরিশ্রুত পানীয় জল সরবরাহ ব্যবস্থার বেহাল দশা নিয়ে মুরারই ১ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি তৃণমূলের ধীমান সাহা বলেন, “সম্প্রতি বাড়িতে বাড়িতে জলের সংযোগ নেওয়ার জন্য ২০০০ টাকা করে জমা দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। কিন্তু কেউ এখনও জমা দিচ্ছে না। কাজ কী করে এগোবে।”

রাজনীতিতে এসে মোতাহার যে এলাকার জন্য কাজ করেছিলেন, বিরোধিরাও সে কথা মেনে নেয় একবাক্যে। ১৯৬৭ সালে প্রথম বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন ডাক্তারবাবু। তখন তিনি এসইউসি প্রার্থী বজলে আহমেদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে হেরে যান। ১৯৬৯ সালে ভোটে দাঁড়িয়ে ফের বজলে আহমেদের কাছে হেরে যান। ১৯৭২ সালে মুরারই কেন্দ্র থেকে প্রথম জেতেন মোতাহার। ২০০১ সাল পর্যন্ত তিনি বিধায়ক ছিলেন। ’৭২ সালের পর তাঁকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৯৭৪ সালে তিনি মন্ত্রী হন। আমৃত্যু তিনি রাজ্য সংখ্যালঘু কমিশনের সদস্য ছিলেন। ছিলেন প্রদেশ কংগ্রেসের সম্পাদকও। জেলার এক বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতার কথায়, “রাজনীতি করেও এখনকার দিনে ভাল কাজ করার জন্য মানুষের স্মরণে আসা যায়, সেটা কতিপয় নেতার ক্ষেত্রেই দেখলাম। মোতাহারদা তেমনই একজন নেতা ছিলেন।”

মুরারইয়ে কংগ্রেসের ‘জন্মদাতা’ হিসেবে পরিচিত মোতাহার ’৭৪ সালে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের মুখ্যমন্ত্রিত্বে স্বরাষ্ট্র দফতরের প্রতিমন্ত্রী হন। ওই সময়, তিনি অর্থ দফতরের অতিরিক্ত দায়িত্বও সামলেছেন। শেষ বারের মতো তাঁকে দেখা গিয়েছিল, গত বিধানসভা নির্বাচনে মুরারই কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী নুরে আলম চৌধুরীর হয়ে রোড-শো করতে। সেই সময় তাঁকে দেখতে প্রচুর মানুষ ভিড় করেছিলেন। এলাকার বাসিন্দা মানোয়ারা বিবি, রঞ্জিত বড়াল, খাইরুল বাসাররা স্মৃতি থেকে বলছিলেন সে দিনের কথা।

মুরারই এলাকায় পাথর খাদান শিল্পের শ্রমিক, বিড়ি শ্রমিকদের যক্ষা রোগের নিরাময়ের জন্য মোতাহারের উদ্যোগে প্রায় তিরিশ আগে মুরারই থানার পলসা গ্রামে যক্ষার চিকিত্‌সা জন্য একটি বর্হিবিভাগ হাসপাতাল খোলে। মুরারই ব্লক গ্রামীণ হাসপাতাল চত্ত্বরে যক্ষা রোগীদের জন্য ইন্ডোর হাসপাতালও খোলা হয়। দুটি হাসপাতালের ভবনে এখন জানালা-দরজা চুরি হয়ে গিয়েছে। পরিতক্ত্য ভবনের দেওয়ালে ঘুঁটে পড়ে রোজ। ‘ডাক্তারবাবু’-র স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি!

ঘটনা হল, তাঁরই জন্য রাজগ্রাম এলাকার পাথর শিল্প ফুলে ফেঁপে উঠেছে। শুধু তাই নয়, তাঁরই উদ্যোগে এলাকার কবি নজরুল কলেজ, মুরারইয়ের গ্রামে গ্রামে বিদ্যুতের ব্যবস্থা, মুরারই গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে পাইকর, ভীমপুর, রাজগ্রাম, চাতরা, পঞ্চহোড়-সহ মুরারই বিধানসভাকেন্দ্রের বেশিরভাগ স্বাস্থ্যকেন্দ্র তাঁরই উদ্যোগে নির্মাণ হয়। আদতে তিনি মানুষের সমস্যা কথা জানতেন। কেন না, এই প্রবীণ নেতার কাছে দলের নেতা-কর্মী, সমর্থক যেমন এক তেমনি সাধারণ মানুষ ও বিরোধী দলের নেতাকর্মীরাও সমান ছিলেন। তাঁর সঙ্গে সব স্তরের মানুষই বসে আড্ডাও দিতেন। কিন্তু কেন বন্ধ হয়ে গেল এলাকার যক্ষা চিকিত্‌সা ইউনিট?

মুরারই ১-এর বিএমওএইচ দেবাশিষ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “যক্ষা রোগীদের এখন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে ওষুধ দেওয়া হয়। তাই পলসা এবং মুরারই গ্রামীণ হাসপাতালে যক্ষা রোগীদের জন্য তৈরি হওয়া ভবন কাজে লাগেনি। তবে মুরারই গ্রামীণ হাসপাতালের আপ গ্রেডেশন হবে। পঞ্চাশ শয্যা থেকে ১০০ শয্যা করা হবে তখন ভবনগুলি কাজে লাগবে।”

শুধু স্বাস্থ্য পরিষেবা অথবা পানীয় জল নয়, ডাক্তারবাবুর স্বপ্ন দেখতেন এলাকার সামগ্রিক উন্নয়ন নিয়ে। এলাকার বিদ্যুত্‌ ব্যবস্থা, সাবস্টেশন, বোলপুর- রাজগ্রাম রাস্তা তৈরি, বাঁশলৈ নদীর উপর কল্যাণ সেতু, মুরারই-পাইকর রাস্তার উপর সেতু, মুরারই কবি নজরুল কলেজের ভবন নির্মাণের মতো নানা উদ্যোগে জড়িয়ে রয়েছে তাঁর নাম। এলাকার বিরোধী দল, সিপিএমের দু’বারের বিধায়ক কামরে ইলাহিকেও তাই ডাক্তারবাবুর স্মরণসভায় বলতে হয়, “মোতাহারবাবুর মতো একজন ব্যক্তিকে আমরা মুরারইয়ে পেয়েছিলাম। ব্যক্তিগতভাবে ওঁনাকে আমি শ্রদ্ধা করি। সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি রক্ষায় ওঁর ভূমিকা মনে রাখবে মুরারই।”

কেমন লাগছে আমার শহর? নিজের শহর নিয়ে
আরও কিছু বলার থাকলে আমাদের জানান।

ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ।

subject-এ লিখুন ‘আমার শহর বীরভূম’।

ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া জানান:

www.facebook.com/anandabazar.abp

অথবা চিঠি পাঠান

‘আমার শহর’, বীরভূম বিভাগ,

জেলা দফতর আনন্দবাজার পত্রিকা,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,

কলকাতা ৭০০০০১ ঠিকানায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

amar shahor murarai apurba chattopadhyay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE