Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

ধুঁকছে সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র, নেই বেসরকারি উদ্যোগও

চিকিৎসকের সঙ্কট আর পরিকাঠামোর অভাবে রুগ্ণ ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। তবু প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য সরকারি সেই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের উপরেই নির্ভরশীল পাত্রসায়র ব্লকের বিস্তীর্ণ এলাকার বাসিন্দারা। কারণ জনসংখ্যার পাল্লা যত বাড়ছে, ততই বাড়ছে রোগীর সংখ্যাও। কিন্তু কয়েক শতাব্দী প্রাচীন এই জনপদে এখনও গড়ে ওঠেনি বেসরকারি কোনও হাসপাতাল বা নার্সিংহোম। নেই একই ছাদের তলায় একাধিক চিকিৎসকের রোগী দেখার ব্যবস্থা (পলিক্লিনিক)। তাই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখানোর জন্য পাত্রসায়রের বাসিন্দাদের এখনও বিষ্ণুপুর, বাঁকুড়া বা বর্ধমানে ছুটতে হয়। সময়মতো চিকিৎসকের কাছে পৌঁছতে না পারায় অনেক রোগীর অকালমৃত্যুও ঘটছে।

স্বাস্থকেন্দ্রের ছাদে ওঠার সিঁড়ি দখল করেও বিছানা।

স্বাস্থকেন্দ্রের ছাদে ওঠার সিঁড়ি দখল করেও বিছানা।

দেবব্রত দাস
পাত্রসায়র শেষ আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০১৪ ০২:৩৭
Share: Save:

চিকিৎসকের সঙ্কট আর পরিকাঠামোর অভাবে রুগ্ণ ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। তবু প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য সরকারি সেই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের উপরেই নির্ভরশীল পাত্রসায়র ব্লকের বিস্তীর্ণ এলাকার বাসিন্দারা। কারণ জনসংখ্যার পাল্লা যত বাড়ছে, ততই বাড়ছে রোগীর সংখ্যাও।

কিন্তু কয়েক শতাব্দী প্রাচীন এই জনপদে এখনও গড়ে ওঠেনি বেসরকারি কোনও হাসপাতাল বা নার্সিংহোম। নেই একই ছাদের তলায় একাধিক চিকিৎসকের রোগী দেখার ব্যবস্থা (পলিক্লিনিক)। তাই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখানোর জন্য পাত্রসায়রের বাসিন্দাদের এখনও বিষ্ণুপুর, বাঁকুড়া বা বর্ধমানে ছুটতে হয়। সময়মতো চিকিৎসকের কাছে পৌঁছতে না পারায় অনেক রোগীর অকালমৃত্যুও ঘটছে। অথচ আশপাশের ব্লক সদরে নার্সিংহোম তো তৈরি হয়েইছে, বেসরকারি ভাবে চিকিৎসা পরিষেবারও অনেক উন্নতি হয়েছে। পিছিয়ে পাত্রসায়র। তাই পকেটে পয়সা থাকলেও এখানে থেকে উন্নত চিকিৎসা পরিষেবা পাওয়া প্রায় আকাশকুসুম ব্যাপার!

ফলে রোগীদের ভরসা ৪৫ কিলোমিটার দূরের বর্ধমান, ৪০ কিলোমিটার দূরের বিষ্ণুপুর বা ৬৫ কিলোমিটার দূরে বাঁকুড়া শহরের বিভিন্ন নার্সিং হোম। হাসপাতাল বা পলিক্লিনিক না থাকা নিয়ে আক্ষেপ রয়েছে এলাকাবাসীর মধ্যে। তাঁদের অভিযোগ, সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সে ভাবে চিকিৎসা মেলে না। প্রাথমিক চিকিৎসাটুকু মেলে। একটু বাড়াবাড়ি হলেই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে থেকে ‘রেফার’ করে দায় সারা হয়। তখন রোগীকে বাঁকুড়া বা বর্ধমানে নিয়ে যেতে হয়।

স্থানীয় ভাবে পাত্রসায়রের কিছু ওষুধ বিক্রেতা ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাইরে থেকে কয়েকজন চিকিৎসককে নিয়ে এসে এখানে বসাচ্ছেন। সেই সংখ্যাটাও যথেষ্ট কম। নির্দিষ্ট দিনে বা তারিখে কয়েক ঘণ্টার জন্য ওই চিকিৎসকদের নির্দিষ্ট ওষুধের দোকানের চেম্বারে পাওয়া যায়। বাকি সময়ে আর ওই চিকিৎসকদের এলাকায় পাওয়া যায় না। স্থানীয় বাসিন্দাদের ক্ষোভ, এলাকায় দিনের পর দিন রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। বিশেষ করে মহিলা ও শিশুদের রোগ বেড়েই চলেছে। কিন্তু এলাকায় স্ত্রী রোগ বা শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। বাঁকুড়া ও বর্ধমানের হাতে গোনা কয়েকজন চিকিৎসক নির্দিষ্ট দিনে চেম্বারে বসে কয়েক ঘণ্টা চিকিৎসা করে আবার চলে যান। রাত-বিরেতে সাধারণ রোগীদের দেখার জন্যও এলাকায় চিকিৎসক পাওয়া ভার।

স্থানীয় বাসিন্দা তথা পাত্রসায়র কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক জিয়ারুল ইসলাম বলেন, “কিছুদিন আগে আমার স্ত্রী শ্বাসকষ্টের সমস্যা ভুগছিল। তাকে ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি করেছিলাম। কিন্তু স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে অন্যত্র ‘রেফার’ করে দেওয়া হয়েছিল। বাধ্য হয়ে বাঁকুড়ায় একটি নার্সিংহোমে ভর্তি করেছিলাম। এলাকায় একটা নার্সিংহোম বা পলিক্লিনিক থাকলে আমাকে এতটা দুর্ভোগ হয়তো পোহাতে হতো না। স্ত্রী-র চিকিৎসা এখানেই করাতে পারতাম।” তাঁর মতোই অনেকেরই ক্ষোভ, “এতবড় এলাকা, অথচ একটা নার্সিংহোম নেই। নেই পলিক্লিনিক, যেখানে এক ছাদের তলায় বসে নানা রোগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের দেখা মিলবে।”

স্থানীয় বাসিন্দা মুকুল কুণ্ডুু বলেন, “দু-একটা প্যাথোলজি সেন্টার গড়ে ওঠেছে। সেখানে রক্তের মামুলি কয়েকটা পরীক্ষা আর এক্স-রে ছাড়া আর বিশেষ কিছু হয় না। স্পেশালিস্ট ডাক্তার দেখাতে বাঁকুড়া, বর্ধমান বা কলকাতায় ছুটতে হচ্ছে। এর পাশাপাশি রাতে এলাকায় ওষুধের সব দোকান বন্ধ থাকায় রোগীদের পরিজনদের ওষুধ জোগাড় করতে অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে।’’ স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, প্রতি রাতে যেন এলাকায় অন্তত একটা ওষুধের দোকান খোলা রাখার ব্যবস্থা করা হয়। পাত্রসায়র বাসষ্ট্যান্ড এলাকার ওষুধ ব্যবসায়ী সঙ্কলন দে অবশ্য বলেন, “এলাকার রোগীদের কথা ভেবে আমরা নিজেদের তাগিদে বাইরে থেকে বড় বড় ডাক্তারদের আনার ব্যবস্থা করেছি। তবে রোগীর সংখ্যা কম হওয়ায় অনেক বড় ডাক্তারই এখানে আসতে চাইছেন না। ফলে ডাক্তারের সমস্যা রয়েই গিয়েছে।” এলাকার ওষুধ ব্যবসায়ীদের দাবি, রাতে একটা ওষুধের দোকান খুলে রাখতে তাঁদের কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু এলাকার পরিস্থিতি যা তাতে রাতে দোকান খুলে রাখা রীতিমতো বিপজ্জনক। নিরাপত্তার অভাবেই দোকান খুলে রাখার সাহস পাওয়া যাচ্ছে না।”

স্বাস্থ্যকেন্দ্র চত্বরে অবাধে ঘুরছে শুয়োর। ছবি: শুভ্র মিত্র

বেসরকারি চিকিৎসা পরিষেবার উপর এই নির্ভরতা গড়ে উঠল কেন? বাসিন্দারা জানাচ্ছে, পাত্রসায়র ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ৩০টি মাত্র শয্যা। মূলত গ্রীষ্ম ও বর্ষায় রোগীর সংখ্যা এত বেড়ে যায় যে তখন মেঝেতে পর্যন্ত রোগীদের জায়গা করে দিতে হয়। চিকিৎসকও কম। চিকিৎসক থাকার কথা ৭, রয়েছেন মাত্র ৩ জন। নার্স থাকার কথা ১১ জনের, রয়েছেন ৯ জন। তার উপরে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসার সরঞ্জামও বিশেষ নেই। নিরাপত্তা নিয়ে যত কম কথা বলা যায় ততই ভালো।

তবে, পাত্রসায়রের ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক প্রিয়দর্শী যশ বলেন, “ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্র চালাতেই চার জন চিকিৎসকের প্রয়োজন। তাই তিনটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসক দেওয়া যাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে ফার্মাসিস্ট, নার্সরা কাজ চালাচ্ছেন। পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য বেশ কিছু প্রস্তাব জেলা স্বাস্থ্য দফতরের কাছে পাঠানো হয়েছে।” তিনি জানান, সমস্যার মধ্যেও রোগীদের চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন তাঁরা। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া রোগীদের অন্যত্র স্থানান্তর করা হয় না বলে তিনি দাবি করেছেন। পাত্রসায়র পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসক দেওয়ার জন্য জেলা স্বাস্থ্য দফতরকে জানিয়েছি। তবে আগের থেকে স্বাস্থ্য পরিষেবার মানের উন্নতি হয়েছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

debabrata das patrasayer amar sohor amar shohor
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE