Advertisement
E-Paper

নেই সংস্কার, সময়ের থাবায় হারিয়ে যাচ্ছে প্রাচীন মন্দির

কথিত আছে, কয়েক শতাব্দী পূর্বে একসময় জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা ও অসংখ্য শিব মন্দির নির্মাণ করা হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল, শৈব ধর্মের প্রচার ও মাহাত্ম্য ব্যক্ত করা। সেই সব মন্দিরের দেওয়ালে উৎকীর্ণ রয়েছে বিভিন্ন কারুকার্য, কোথাও কোথাও অলংকৃত ফলকে রয়েছে শিলালেখ। ভাস্কর্য দেখে, একদিকে যেমন সেই সময়ের শিল্পীদের শিল্পকর্মের শোভন রূপটি অনুমান করা যায়, ধারণা হয় তৎকালীন সমাজব্যবস্থা এবং মানুষের ধর্ম-বিশ্বাসের।

দয়াল সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ১৭ মার্চ ২০১৫ ০০:৪৮
ভেঙে পড়েছে মন্দিরের টেরাকোটা। নিজস্ব চিত্র।

ভেঙে পড়েছে মন্দিরের টেরাকোটা। নিজস্ব চিত্র।

কথিত আছে, কয়েক শতাব্দী পূর্বে একসময় জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা ও অসংখ্য শিব মন্দির নির্মাণ করা হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল, শৈব ধর্মের প্রচার ও মাহাত্ম্য ব্যক্ত করা। সেই সব মন্দিরের দেওয়ালে উৎকীর্ণ রয়েছে বিভিন্ন কারুকার্য, কোথাও কোথাও অলংকৃত ফলকে রয়েছে শিলালেখ। ভাস্কর্য দেখে, একদিকে যেমন সেই সময়ের শিল্পীদের শিল্পকর্মের শোভন রূপটি অনুমান করা যায়, ধারণা হয় তৎকালীন সমাজব্যবস্থা এবং মানুষের ধর্ম-বিশ্বাসের। তেমন সব মন্দিরই ঘিরে রয়েছে দুবরাজপুর শহরে।

মন্দিরগুলির অধিকাংশই ইটের নির্মাণ। মন্দির গাত্রের উপর চুনবালি ও পোড়ামাটির কাজে সমৃদ্ধ। তবে বাহ্যিক শিল্পকর্ম নয়, মন্দির তৈরির রীতিতেও চমক রয়েছে। কোনওটি দেউল রীতির(অষ্ট কোণাকৃতি), কোনওটি চারচালা, কোনওটি পঞ্চরত্ন (পাঁচটি চূড়া) বা নবরত্ন (নয়টি চূড়া)। রয়েছে ত্রয়োদশ রত্নের (তেরোটি চূড়া বিশিষ্ট) মতো নানা আকৃতির মন্দিরও। এছাড়াও উত্তর ভারতের নাগর রীতির কিছু মন্দির এবং উড়িশা রীতির রেখ দেউলের অনুকরণেও পাথরের তৈরি শিব মন্দিরও রয়েছে দুবরাজপুরে।

জেলার বিভিন্ন প্রান্তের প্রাচীন শিব মন্দিরগুলির মতোই প্রাচীন জনপদ দুবরাজপুরে চারটি জায়গায় ইটের তৈরি শিব মন্দির ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। এই সব মন্দিরে নিত্য পুজোর ব্যবস্থা রয়েছে। মন্দিরে দায়িত্বে থাকা শরিকেরা নিজেদের দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। কিন্তু অধিকাংশ মন্দির রক্ষানাবেক্ষনের অভাবে জীর্ণ। দেওয়ালের গায়ের বেশির ভাগ কারুকার্যই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। কোনও কোনও মন্দির আবার প্রায় ধংসের মুখে। সংস্কারের নামে সিমেন্টবালির পলেস্তরার নীচে চাপা পড়েছে বেশ কয়েকটি মন্দিরের সুদৃশ্য শিল্পকর্ম। মন্দির গাত্রে যেটুকু পোড়ামাটি এবং চুনবালির কাজ বেঁচে রয়েছে সেও দেখার মতো।

শরিকরা বলছেন, যে মন্দিরগুলি প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছে সেগুলিকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাঁচানোর কোনও রাস্তা নেই। কারণ, ব্যক্তিগত ভাবে সিমেন্ট, বালি দিয়ে সংস্কার করলে আসল কারুকার্যই ঢাকা পড়বে। আর সংস্কার না হলে মন্দিরগুলির আয়ু হয়তো খুব বেশি দিন নয়।

শহরে ত্রয়োদশরত্ন সমন্বিত শিব মন্দিরটি রয়েছে দুবরাজপুর বাজারের কাছেই। মন্দিরের মূল দরজার খিলানে শিবের কৈলাস আক্রমণের ঘটনা উৎকীর্ণ রয়েছে। এছাড়া মন্দিরের পাশের ফলকগুলিতে এবং অন্যান্য জায়গায় রয়েছে নানা প্রতিকৃতি, দেবদেবীর অবতার, সামাজিক ও পৌরাণিক দৃশ্যাবলী। দুবরাজপুরের ময়রাপড়ায় ৩টি ইটের তৈরি শিব মন্দির রয়েছে। সবকটি মন্দিরই দক্ষিণদুয়ারী। মাঝের মন্দিরটি ত্রয়োদশরত্ন এবং দু’ পাশে থাকা মন্দিরগুলি দেউল রীতির। দশাবতার, রামসীতা, প্রাত্যহিক জীবনের ঘটনাবলী, কৃষ্ণলীলা, শিববিবাহ রয়েছে মন্দিরে ফলকগুলিতে। তবে অধিকাংশ কাজই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। মন্দিরের সেবাইত বা শরিক সহদেব দাস এবং মহাদেব দাসেরা বলেন, “আমাদের সংসারই চলে ছোট্ট একটি খাবারের দোকান চালিয়ে। যেভাবে সংস্কার করলে মন্দিরের শিল্পকর্ম অক্ষত থাকবে, তেমন সংস্কার করানোও আমাদের সামর্থের মধ্যে নেই। আগেই কিছুটা অংশ সিমেন্টবালি দিয়ে পলস্তরা করে দিতে বাধ্য হয়েছিলাম। কিন্তু পুরোটাই সেভাবে করলে, মন্দিরের শিল্পকর্মগুলোই নষ্ট হবে।” নায়কপাড়ায়(মোঘলের কাছে) আরও তিনটি মন্দির রয়েছে। খুবই জীর্ণ দশা মন্দিরগুলির। একটি চারচালা(কুটির আকৃতির) এবং একটি দেউল রীতির মন্দিরের মধ্যে রয়েছে একটি নবরত্ন মন্দিরও। মন্দিরের দেওয়ালে শিব-বিবাহ, মহিষাসুরমর্দিনী, কালী ইত্যাদি পোড়ামাটির কাজের পাশাপাশি চারচালা মন্দিরটির দেওয়ালে চুনবালি দিয়ে জ্যামিতিক রেখাচিত্র করা রয়েছে। তবে সংক্ষণের অভাবে সবই প্রায় ধংসের মুখে। দুবরাজপুরের ওঝা পাড়ায় রয়েছে উত্তর দুয়রী শিব মন্দির। এলাকার সকলেই এই মন্দিরটা পঞ্চ শিবালয় বলে জানেন। সংস্কার করতে গিয়ে, দেউল আকৃতির দুটি মন্দিরের কাজ ঢাকা পড়েছে। অন্য দুটি দেউল রীতির মন্দিরে মাঝেই রয়েছে একটি ত্রয়োদশরত্ন মন্দির। অবস্থার নিরিখে এটিকেই সবচেয়ে ভাল বলা যায়। রামায়নের ঘটনাবলী, নরসিংহ অবতার, নারদ, নৌকা বিহার, হাতি ও ঘোড়ার পিঠে শিকারী ইত্যাদি নানান প্রতিকৃতিতে সজ্জিত মন্দিরটি এখনও নজরকাড়ে।

এলাকার দুটি স্কুলের ইতিহাসের শিক্ষক ভবানী প্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অনিমা মিশ্ররা বলছেন, সেনযুগের পরবর্তী কালে নির্মিত মন্দিরগুলির ওই কাজ তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থা ও ইতিহাসের সঙ্গে জুড়ে। কিন্তু রক্ষাণাবেক্ষনের অভাবে সেগুলি জীর্ণ। ভবিষ্যত প্রজন্মের সামনে তৎকালীন ইতিহাস ও স্থাপত্যরীতি তুলে ধারার জন্যই সেগুলিকে সংরক্ষণ করা উচিত। কিন্তু সেই কাজ কবে শুরু হবে, কেউ তা জানে না। তবে কোনওরকমে সংস্কার চাইছেন শরিকরা। দুবরাজপুরের ময়রা পড়ায় তিনটি মন্দিরে যেমন সংস্কার চাইছেন না শরিক ক্ষীরোদ রুজ, অশোক রুজেরা। দুবরাজপুর পুরসভা সংস্কার করার কথা বলেছিল। তাঁদের দাবি, মন্দিরের কাজ ঢেকে যাক তা আমরা চাইছি না। এলাকার ওঝা পাড়ায় থাকা পঞ্চ শিবালয়ের দুটি দেউলরীতির মন্দির সিমেন্টের আড়ালে যেমন ঢাকা পড়েছে ইতিমধ্যেই।

পুরপ্রধান পীযূষ পাণ্ডে বলেন, “মন্দিরগুলি ঐতিহ্যবাহী ও ভগ্নপ্রায়, দুটি বিষয়ই সত্যি। সংস্কার করতে হলে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। তবে ময়রাপাড়ার তিনটি মন্দিরকে সংস্কারের জন্য ইতিমধ্যেই পুরসভা টাকা বরাদ্দ করেছে। বাঁকুড়া থেকে পোড়ামাটির কাজ জানা শিল্পীদের নিয়ে এসে মন্দির সংস্কারের কাজে হাত দেওয়া হবে।”

heritage temple old temples amar shohor amar sohor dubrajpur dayal sengupta
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy