Advertisement
০৩ মে ২০২৪

পুজো ডাকছে তাঁকে, দূরে হোমের আড়ালে ডুকরে উঠছেন তরুণী

হ্যালো...হ্যালো মাইক টেস্টিং...। হোমের পাঁচিল উজিয়ে আস্ত পুজো মণ্ডপটা যেন ম্যাড়াপ সমেত হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়তে চাইছে। --মা আজ কী গো, পঞ্চমী? সস্তার ফিতে দিয়ে টান টান বাঁধা রুখু চুলে হাত বুলিয়ে মা বলছেন, “তা হবে, অত মন খারাপ করতে নেই।” শক্ত পাথরের মতো গলায় দলা পাকিয়ে আছে কান্নাটা।

লাভপুরের সুবলপুরে নির্যাতিতা তরুণীর পরিত্যক্ত বাড়ি। ছবি: সোমনাথ মুস্তাফি।

লাভপুরের সুবলপুরে নির্যাতিতা তরুণীর পরিত্যক্ত বাড়ি। ছবি: সোমনাথ মুস্তাফি।

অর্ঘ্য ঘোষ
লাভপুর শেষ আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০১৪ ০১:২১
Share: Save:

হ্যালো...হ্যালো মাইক টেস্টিং...।

হোমের পাঁচিল উজিয়ে আস্ত পুজো মণ্ডপটা যেন ম্যাড়াপ সমেত হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়তে চাইছে।

--মা আজ কী গো, পঞ্চমী?

সস্তার ফিতে দিয়ে টান টান বাঁধা রুখু চুলে হাত বুলিয়ে মা বলছেন, “তা হবে, অত মন খারাপ করতে নেই।”

শক্ত পাথরের মতো গলায় দলা পাকিয়ে আছে কান্নাটা।

হোমের পাঁচিল উজিয়ে ফের ডানা ঝাপটাতে থাকে--‘হ্যালো মাইক টেস্টিং ওয়ান, টু...।’

এর পরেও কান্না সামাল দেওয়া যায়?

ফোনের ওপার থেকে ধরা গলায় তরুণী বলছেন, “জানেন হোমের ভেতরেই পুজোর গন্ধ পাচ্ছি। কী মন খারাপ যে লাগছে।” গলা কাঁপছে তাঁর।

বড় মনে পড়ছে দুই দিদির কথা। পুজোর সময় জামাইবাবু আর ছেলেপুলেদের নিয়ে দিদিরা আসবেই। আর তখন, দাদা-জামাইবাবুদের সাইকেলের ‘ক্যারিয়ার’-এ চেপে টো টো। সেই কোথায়, নাড়ায় গেঁজে ওঠা মাঠ পেরিয়ে আমোদপুর। কিংবা আরও দূরে বড় রাস্তা, ট্রাকের ধুলো, ক্যানাল পেরিয়ে লাভপুরে ঠাকুর। ঠোঁট কামড়ে বলছেন, “সব হারিয়ে গেল। আর কিচ্ছু হবে না।” নিজের মনেই বলে উঠছে, “কী করেছি আমি, কী করেছি? কোনও অপরাধ করেছি কি? তা হলে পুজোর দিনেও কেন আমাকে বন্দির মতো কাটাতে হবে? আর যারা আমার উপর অত্যাচার করল তারা দিব্যি ঠাকুর দেখবে, হায় মা দুগ্গা!”

কম ওয়াটের টিমটিমে আলো, ট্যালট্যালে ডাল আর আধকাঁচা সব্জির সঙ্গে মোটা চালের ভাত--আশ্বিনের সন্ধ্যায় সিউড়ির হোমে মায়ের পাশে দু-চোখ জল নিয়ে বসে আছে সদ্য তরুণী। কেন?

গাঁয়ের মাতব্বরদের মুখে মুখে কথা বলে সে জানিয়ে দিয়েছিল ‘দোষ-টোষ’ তার কিছু নেই। ওই ছেলেটি তাকে ‘বিয়া’ করব বলেছিল তাই ঘুরছিল তার সঙ্গে। এতে অন্যায়ের কী আছে? পাল্টা প্রশ্ন রেখেছিল সে। ‘মেয়ে মানুষের’ মুখে এমন পাল্টা প্রশ্নে তো সড়গড় নয় তারা। সুবলপুরের মাতব্বরেরা তাই নিদান দিয়েছিল, ‘রাতভর ধর্ষণ কর ওকে!’

মাঝি-হাড়ামের নিদানের পরে যাঁকে গণধর্ষিতা হতে হয়েছিল। তাঁর ‘অপরাধ’? ভিন্ জাতের এক ছেলের সঙ্গে তাঁকে দেখা গিয়েছিল।

ওই ঘটনার পরে নিজেই সে গিয়েছিল থানায়। স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলা রুজু করেছিল দেশের সর্বোচ্চ আদালতও। ঘটনার পর থেকেই গ্রাম ছাড়া মেয়েটিকে রাজ্য সরকার লাভপুরেরই টালিপাড়া গ্রামে পুনর্বাসন প্রকল্পে ঘরও তৈরি করে দিয়েছিল। কিন্তু গাঁয়ে তাঁর ‘ঠাঁই’ হয়নি। টালিপাড়ায় নতুন ঘরে বসবাস শুরু করেছেন মেয়েটির তিন দাদা-বৌদি। কিন্তু ‘নিরাপত্তা’র কথা ভেবে সরকার তাঁকে পাঠিয়েছে সিউড়ির হোমে।

আর তাঁদের পুরনো ভিটেটা গোটা বর্ষায় জল খেয়ে আগাছার জঙ্গলে একেবারে ‘টপ্পুর’ হয়ে আছে। বাড়ির বারন্দায় মেয়েটির লাগানো সিনেমার পোস্টাররা ঝাপসা হয়ে গিয়েছে। দরজার মাথায় সেই শখ করে লাগানো ঝিনুকের ঝাঁক। এখনও আচমকা হওয়া দিলে টুং টাং শব্দ করে। নিঃশব্দে কাঁদে কী তারা?

ঠোঁট কামড়ে ডুকরে ওঠে মেয়েটি।

হ্যালো মাইক টেস্টিং...গ্রাম থেকে অনেক দূরে, সিউড়ির হোমে তার গুমরে ওঠা কষ্ট ঢাকা পড়ে যায় পুজোর সোল্লাশে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

luvpur arghya ghosh gangrape pujo
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE