Advertisement
E-Paper

বিঁধলই না নেপাল-কাঁটা

নেপাল-ফ্যাক্টর কোনও কাজই করল না! কাজ করল না ভোট ভাগাভাগির অঙ্কও। পুরুলিয়ার মাটিতে ফের দাপুটে জয় পেল তৃণমূল। দিনের শেষে পুরুলিয়া কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী মৃগাঙ্ক মাহাতো পেয়েছেন ৪,৬৮,২৭৭ ভোট।

প্রশান্ত পাল

শেষ আপডেট: ১৭ মে ২০১৪ ০১:৩৯
মৃগাঙ্ক মাহাতোকে নিয়ে উল্লাস। কর্মীদের মাঝে নেপাল মাহাতো। ছবি: সুজিত মাহাতো ও প্রদীপ মাহাতো।

মৃগাঙ্ক মাহাতোকে নিয়ে উল্লাস। কর্মীদের মাঝে নেপাল মাহাতো। ছবি: সুজিত মাহাতো ও প্রদীপ মাহাতো।

নেপাল-ফ্যাক্টর কোনও কাজই করল না! কাজ করল না ভোট ভাগাভাগির অঙ্কও।

পুরুলিয়ার মাটিতে ফের দাপুটে জয় পেল তৃণমূল। দিনের শেষে পুরুলিয়া কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী মৃগাঙ্ক মাহাতো পেয়েছেন ৪,৬৮,২৭৭ ভোট। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী, তথা কেন্দ্রের বিদায়ী সাংসদ ফরওয়ার্ড ব্লকের নরহরি মাহাতোকে ১,৫৩,৮৭৭ ভোটের ব্যবধানে হারিয়েছেন মৃগাঙ্ক। নরহরিবাবুর প্রাপ্ত ভোট ৩,১৪,৪০০। তবে, জেলা কংগ্রেসের প্রত্যাশার ফানুস চুপসে দিয়ে ২,৫৭,৯২৩ ভোট পেয়ে তৃতীয় স্থানে রয়েছেন দলের জেলা সভাপতি নেপাল মাহাতো।

অথচ কংগ্রেস নেতারা প্রথম থেকেই দাবি করে আসছিলেন, পুরুলিয়ায় এ বার নেপাল-ফ্যাক্টর বড় হয়ে দেখা দেবে। এমনকী, নেপালবাবুর খাসতালুকে জনসভা করে গিয়েছেন খোদ তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পাশাপাশি, নেপালবাবুর মতো প্রভাবশালী নেতা প্রার্থী হওয়ায় জেলার বাম শিবির আশায় ছিল, তিনি তৃণমূলের বাড়া ভাতে ছাই দেবেন। আর ফাঁক গলে বেরিয়ে যাবেন বাম প্রার্থী। কিন্তু, ভোটের ফলে স্পষ্ট, সে-সবের কিছুই হয়নি। এই কেন্দ্রের ভোটারেরা আস্থা রেখেছেন শাসক দলের উপরেই। গত বছরের পঞ্চায়েত ভোটের নিরিখে পুরুলিয়া লোকসভা এলাকায় তৃণমূলের প্রাপ্ত ভোট ছিল ৪,২৭,০০০। এ বার শাসক দল সেই ভোট বাড়িয়ে ৪,৬৮,২৭৭-এ নিয়ে গিয়েছে। অন্য দিকে, কংগ্রেসের পঞ্চায়েত ভোটে প্রাপ্ত ভোট ছিল ১,৬৮,০০০। নেপালবাবুর সৌজন্যে তা বেড়ে হয়েছে ২,৫৭,৯২৩। কমেছে বামফ্রন্টের ভোট। পঞ্চায়েত ভোটে প্রাপ্ত ৪,০২,০০০ ভোট এ বার কমে হয়েছে ৩,১৪,৪০০।

বস্তুত, সাড়ে তিন দশক পরে পুরুলিয়া লোকসভা কেন্দ্রটি বামেদের বা আরও নির্দিষ্ট করে বললে ফরওয়ার্ড ব্লকের হাতছাড়া হল। গত ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে পুরুলিয়া লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত ৭টি বিধানসভা আসনের মধ্যে ৪টিতে জয়ী হয়েছিল তৃণমূল। এ বার শাসকদলের পক্ষে সেই ফল ৫-২। নেপালবাবু যে কেন্দ্রের বিধায়ক, সেই বাঘমুণ্ডিতে কংগ্রেসের ‘লিড’ রয়েছে। আর পাড়ায় সামান্য ‘লিড’ পেয়েছে বামফ্রন্ট।

জিতেছি...। পুরুলিয়ায় শুক্রবার ভোটের ফল প্রকাশের পরে সুজিত মাহাতোর তোলা ছবি।

বস্তুত, ২০০৯ সালের লোকসভা ভোট থেকেই বোঝা গিয়েছিল, পুরুলিয়ায় হাওয়া ঘুরছে। সে বার নরহরি মাহাতো মাত্র ২০ হাজার ভোটে হারিয়েছিলেন তৃণমূল প্রার্থী, বর্তমানে রাজ্যের মন্ত্রী শান্তিরাম মাহাতোকে। তার পরের দু’টি ভোটে সেই ব্যবধান মুছে তৃণমূল শুধুই এগিয়েছে। এমনকী, যে জঙ্গলমহল এক সময় ছিল বামেদের শক্ত ঘাঁটি, সেখানেও উড়েছে ঘাসফুল। গত বছর পঞ্চায়েত নির্বাচনেও তৃণমূল এই জেলায় নিরঙ্কুশ জয় পেয়েছিল। সেই ধারাই অব্যাহত রয়েছে। জেলা তৃণমূল নেতাদের কাছে আরও সন্তুষ্টির বিষয়, কংগ্রেস ও তৃণমূলের মধ্যে ভোট ভাগাভাগি হওয়া সত্ত্বেও পঞ্চায়েত ভোটের নিরিখে এই লোকসভা আসনে শাসক দল যে পরিমাণ ভোট পেয়েছিল, এ বার তার চেয়েও বেশি পেয়েছেন মৃগাঙ্ক। রাজ্যে বিজেপি ভোটপ্রাপ্তির শতাংশে ভাল ফল করলেও এই কেন্দ্রে একেবারেই দাঁত ফোটাতে পারেনি। তাদের প্রার্থী বিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায় পেয়েছেন মাত্র ৮৫,৯৭৮টি ভোট।

এ দিন ভোটগণনা শুরু হওয়ার পর থেকেই বোঝা যাচ্ছিল পুরুলিয়া তৃণমূলের দখলেই আসতে চলেছে। দ্বিতীয় স্থানের জন্য লড়াই হয়েছে বাম ও কংগ্রেস প্রার্থীর মধ্যে। নেপাল মাহাতো পর পর কয়েক রাউন্ড নরহরিবাবুর ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেললেও পরের দিকে অবশ্য বামপ্রার্থী পিছনে ফেলে দেন নেপালবাবুকে।

মৃগাঙ্ক মাহাতোকে প্রার্থী করার পিছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল জেলা তৃণমূল সভাপতি শান্তিরাম মাহাতোর। প্রার্থী নির্বাচন নিয়ে জেলা তৃণমূলের অন্দরে একটা চোরাস্রোত ছিল। এ দিন কিন্তু রাউন্ড যত এগিয়েছে তৃণমূলের পাল্লাও ভারী হয়েছে ততই। আর ততটাই চওড়া হয়েছে শান্তিরামবাবুর মুখের হাসি। গণনা শুরু হওয়ার পরে দু-একটি টিভি চ্যানেল দেখাচ্ছিল নরহরি মাহাতো এগিয়ে রয়েছেন। বাইরে উপস্থিত তৃণমূল কর্মীদের চোখে মুখে তখন উদ্বেগ। পুরুলিয়া পলিটেকনিক কলেজের গণনাকেন্দ্রের ভিতর থেকে কেউ বাইরে বের হলেই পরিচিতরা জিজ্ঞেস করছেন ফল কী হচ্ছে। তিন রাউন্ড গণনার পরে ভিতর থেকে প্রথম বাইরে বের হলেন মৃগাঙ্কবাবু। বললেন, “এগিয়ে রয়েছি। এই তো মাত্র ছয় রাউন্ড হয়েছে। এখনও দশ রাউন্ড বাকি।”

পুরুলিয়া কেন্দ্রের ফল

সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন....

গণনাকেন্দ্রের উল্টোদিকেই তৃণমূলের শিবিরে সবুজ পাঞ্জাবি পরে বসেছিলেন শান্তিরাম মাহাতো। নয় রাউন্ডের পর ব্যবধান যখন ৭০ হাজার ছাড়িয়েছে, মুচকি হেসে বললেন, “দেখুন না ব্যবধান কোথায় গিয়ে থামে!” জেলা তৃণমূলের কাযর্করী সভাপতি সুজয় বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, “প্রত্যাশা মতোই আমাদের ভোট বেড়েছে। কেন না সবে মানুষ পঞ্চায়েতে আমাদের সমর্থন করেছেন। আমরা মানুষের জন্য কাজও করছি। আমাদের দায়িত্ব আরও বাড়ল।”

গণনা শেষ হবার আগেই গণনাকেন্দ্র ছেড়ে বেরিযে যান নরহরি মাহাতো। এই ফল কি প্রত্যাশা করেছিলেন। ফব প্রার্থীর জবাব, “গোটা রাজ্যে বামপন্থীদের ফল খারাপ হয়েছে। পুরুলিয়াও ব্যতিক্রম নয়। বামফ্রন্টকে মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছেন। আমরা এই রায় মাথা পেতে নিচ্ছি। এবার আমরা বিশ্লেষণ করব, কেন মানুষ আমাদের দিক থেকে মুখ ফেরালেন।” গণনাকেন্দ্রের বাইরে বামফ্রন্টের শিবিরে তখন ভাঙা হাট। সকালে যে ভিড় ছিল, তা অনেকটাই ফাঁকা। বসেছিলেন সিপিএমের জেলা সম্পাদক মণীন্দ্র গোপ। তাঁর হাতেই ফলের কাগজ তুলে দিয়ে নরহরিবাবু বললেন, “এখনও গণনা শেষ হয়নি। হয়তো তিন লাখের কিছু বেশি হবে।”

আরও আগেই বেরিয়ে গিয়েছিলেন নেপালবাবু। মোটামুটি দশ-বারো রাউন্ড গণনা শেষ হওয়ার পরে তিনি বুঝে যান, ফল কী হতে চলেছে। নিজেদের শিবিরে এসে গলায় ঢকঢক করে জল ঢাললেন তিনি। বললেন, “যেমন প্রত্যাশা করেছিলাম, তা হয়নি। আমাদের সংগঠন রয়েছে, এমন সব এলাকায় এ রকম ফল আশা করিনি। তবে, বলরামপুরে ভালো ভোট হয়েছে। যেখানেই গিয়েছি সেখানেই মানুষ বেরিয়ে এসে সমর্থন করেছেন। এ বার ফল নিয়ে পর্যালোচনা করতে হবে।” জেলা কংগ্রেসের সহ-সভাপতি রথীন্দ্রনাথ মাহাতো সান্ত্বনা খুঁজে পাচ্ছেন এই তথ্যের মধ্যে যে, তাঁরা বাঘমুণ্ডিতে এগিয়ে রয়েছেন আর বলরামপুর, জয়পুর ও পুরুলিয়া বিধানসভায় দ্বিতীয় স্থানে আছেন।

গণনা শেষে বেরিয়ে মৃগাঙ্কবাবু বলেন, “আমি এই জয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে উত্‌সর্গ করছি। তিনিই আমাকে প্রার্থী করেছিলেন। পুরুলিযার মানুষ তাঁকে এই আসনটি দিয়েছেন।” আর নেপাল-ফ্যাক্টর? জয়ী তৃণমূল প্রার্থী সটান বলে দিলেন, “ওই সব কিছুই নয়। এখানে আগে বামফ্রন্টের চিত্ত মাহাতো বা বীরসিংহ মাহাতোরা এত বেশি ভোটে জিততেন। কী ভাবে জিততেন। সংগঠন জেতাত। আমি মনে করি ভোট সংগঠনই জেতায়। কেউ কেউ নেপাল-নেপাল করছিলেন। এ বার তো দেখলেন!”

বাইরে তৃণমূলের কর্মীরা আবির নিয়ে ধৈর্যের পরীক্ষা দিচ্ছিলেন। তাঁদের তর আর সইছিল না। এক প্রৌঢ় গোটা শরীরে সবুজ আবির মেখে দলীয় পতাকা হাতে দুপুর থেকে অপেক্ষা করছিলেন। মৃগাঙ্কবাবু বেরোতেই তিনি তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন। বিজয়ী প্রার্থী তখন আক্ষরিক অর্থেই জনসমুদ্রের মাঝে।

পুরুলিয়ার রং তখন পুরো সবুজ!

prasanta pal purulia vote result
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy