Advertisement
E-Paper

বাসস্ট্যান্ড না আঁস্তাকুড়, প্রশ্ন যাত্রীদের

কথায় বলে একটা শহরের শ্রী বোঝা যায়, তার বাসস্ট্যান্ডের চেহারা দেখলে। আর গোবিন্দনগর বাসস্ট্যান্ডে নামলে মালুম হয়ে যায় বাঁকুড়া শহরের রূপ কেমন। বাসিন্দাদের ক্ষোভ, বছরের পর বছর ধরে বাসস্ট্যান্ডের হাল ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। অথচ ভোট এলেই সবাই সংস্কারের আশ্বাস দিয়ে যান। এখন দরজায় কড়া নাড়ছে পুরভোট। এ বারও ফের সেই বাসস্ট্যান্ড সংস্কারের আশ্বাস নিয়ে ভোট চাইতে আসবেন বিভিন্ন দলের নেতা-কর্মীরা।

রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১০ মার্চ ২০১৫ ০০:৪৩
যাত্রী প্রতীক্ষালয়ে ব্রাত্য যাত্রীরাই। দখল করে বসেছে বাজার। ছবি: অভিজিত্‌ সিংহ।

যাত্রী প্রতীক্ষালয়ে ব্রাত্য যাত্রীরাই। দখল করে বসেছে বাজার। ছবি: অভিজিত্‌ সিংহ।

কথায় বলে একটা শহরের শ্রী বোঝা যায়, তার বাসস্ট্যান্ডের চেহারা দেখলে। আর গোবিন্দনগর বাসস্ট্যান্ডে নামলে মালুম হয়ে যায় বাঁকুড়া শহরের রূপ কেমন। বাসিন্দাদের ক্ষোভ, বছরের পর বছর ধরে বাসস্ট্যান্ডের হাল ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। অথচ ভোট এলেই সবাই সংস্কারের আশ্বাস দিয়ে যান। এখন দরজায় কড়া নাড়ছে পুরভোট। এ বারও ফের সেই বাসস্ট্যান্ড সংস্কারের আশ্বাস নিয়ে ভোট চাইতে আসবেন বিভিন্ন দলের নেতা-কর্মীরা। কিন্তু বাসস্ট্যান্ডের হাল কি আদৌ বদলাবে?

বাসস্ট্যান্ডের যাত্রী প্রতীক্ষালয় কার্যত বেদখল হয়ে গিয়েছে। সেখানে খাবারের জিনিস থেকে জামা-কাপড়ের পসরা মেলে জমিয়ে ‘বাজার’ বসিয়ে দিয়েছেন হকাররা। যে টুকু ফাঁকা জায়গা অবশিষ্ট রয়েছে, সেখানে কোনওরকমে গুঁতোগুঁতি করে যাত্রীরা বসে থাকেন। তাও অল্প কয়েকজনের বেশি জায়গা হয় না। তার উপরে ওই যাত্রী প্রতীক্ষালয় দীর্ঘদিন সংস্কারের অভাবে জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। ওপর থেকে সিমেন্টের চাঁঙড় খসে পড়ে মাঝে মধ্যে। রডও বেরিয়ে গিয়েছে। সবার আশঙ্কা যে কোনও সময় পুরো ছাদটাই যেন না ভেঙে পড়ে!

তাই প্রচণ্ড গরমে বা বর্ষার মধ্যেও মাথা গোঁজার আর কোনও জায়গা খুঁজে পান না যাত্রীরা। খোলা আকাশের নীচে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয় তাঁদের। এদিক ওদিক বিক্ষিপ্ত ভাবে তল্পিতল্পা নিয়ে মানুষের জটলা থাকে পুরো বাসস্ট্যান্ড চত্বর জুড়ে। বাসের ধাক্কায় মাঝে মধ্যে ছোটখাটো দুর্ঘটনাও ঘটছে।

ময়লা আবর্জনা জমে জমে নর্দমা বুজে গিয়েছে। নোংরা জল ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে। আবর্জনা ফেলারও নির্দিষ্ট জায়গা নেই। যত্রতত্র জমে রয়েছে আবর্জনা, উচ্ছিষ্ট খাবার, প্যাকেট। যাত্রীদের ক্ষোভ, পা ফেলারও জায়গা নেই। বাতাসে ভাসছে দুর্গন্ধ। বাসস্ট্যান্ডের ভিতরে যে সুলভ শৌচালয়টি রয়েছে। সেটির পরিকাঠামোও কার্যত ব্যবহারের অযোগ্য। বাসকর্মীরা ছাড়া সাধারণ যাত্রী তাই শৌচালয়ের দিকে সাধারণত পা বাড়ান না। অভিযোগ, যাত্রীদের অনেকে খোলা আকাশের নীচেই বাসস্ট্যান্ডের ভিতরে প্রাকৃতিক কাজ সারেন। ফলে দূষিত হচ্ছে বাসস্ট্যান্ডের পরিবেশ। দূষণের আরও একাধিক কারণ রয়েছে। নালা-নর্দমাগুলিও নিয়মিত ঠিকঠাক পরিষ্কার করা হয় না। বাসস্ট্যান্ডের ভিতরে একাধিক খাবারের হোটেল রয়েছে। সেই হোটেলগুলির পরিত্যক্ত খাবার যেখানে সেখানে পড়ে থাকতে দেখা যায়। তাই বাস থেকে নেমেই নাকে রুমাল ঢাকা দিয়ে আরামবাগের বেনিয়াপুকুরের বাসিন্দা সুজয় পানের বিরক্তি, “এটা বাসস্ট্যান্ড, না আঁস্তাকুড়!”

পানীয় জলের জন্য যে কয়েক’টি জলছত্র বা কল আছে সেখানেও মাঝে মধ্যে জল পাওয়া যায় না বলে ক্ষোভ যাত্রীদের। টিউবওয়েলটি প্রায় খারাপ হয়ে থাকে। ফলে জলের জন্য হাপিত্যেশ করে এদিক ওদিক ছুটে বেরাতে হয় যাত্রীদের। একটি বেসরকারি গৃহঋণ সংস্থার কর্মী বড়জোড়ার শুভজিত্‌ ঘোষের ক্ষোভ, “পেশার তাগিদে প্রায়ই গোবিন্দনগর বাসস্ট্যান্ডে বাস ধরতে আসতে হয়। এখানে পানীয় জল বা শৌচালয় কিছুরই সুব্যবস্থা নেই। গ্রীষ্মকালে মাথা গোঁজার ঠাঁই পাওয়া যায় না। অব্যবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁচেছে যে জেলা সদরের বাসস্ট্যান্ড বলে মনেই হয় না।” তার উপরে এখানকার যান নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাও বেশ খারাপ। বাস ঢোকা বা বের হওয়ার মুখে প্রায়শই যানজট লেগে থাকে। বাসস্ট্যান্ডের সামনের রাস্তায় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ট্রেকারে যাত্রী তোলা নামা করা হয়। বাসস্ট্যান্ডের কয়েকশো মিটার দূরেই বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। এই যানজটের মধ্যে পড়ে আটকে যায় অ্যাম্বুলেন্সও। এ নিয়েও বাসিন্দাদের কম ক্ষোভ নেই। বাইরে থেকে আসা লোকজনের এ সব দেখে চোখ কপালে ওঠে। প্রশ্ন তোলেন উন্নয়ন নিয়েও। কিন্তু স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনিক আধিকারিকদের বাসস্ট্যান্ড সংস্কারের সে তাগিদই নেই— ক্ষোভ জেলাবাসীর।

তবে বাঁকুড়া পুরসভার দাবি, বছর খানেক আগে তারা বাসস্ট্যান্ডের উন্নয়নে প্রায় ৭০ লক্ষ টাকা খরচ করেছে। সেই টাকায় বাসস্ট্যান্ডের কিছুটা এলাকা ঢালাই করা হয়েছে এবং একটি আলোর স্তম্ভ বসানো হয়েছে। ওই ঢালাই করা জায়গাটি বর্তমানে বাসের গ্যারাজ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে এটাই যথেষ্ট নয় বলে জানাচ্ছেন বাস মালিক ও যাত্রীরা। পেশায় ছোট গাড়ির চালক বাপি বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “যাত্রীদের দাঁড়ানোর জায়গা নেই, পানীয় জলেরও সুব্যবস্থা নেই। এই সব কারণে প্রায়ই ক্ষোভ প্রকাশ করেন বাইরে থেকে আসা যাত্রীরা। পর্যটকরা এ নিয়ে নিন্দা করলে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায়।”

পরিকাঠামোর অভাবে নানা সমস্যায় পড়েন বাসকর্মীরাও। বহু বাস কর্মীকেই রাত কাটাতে হয় এই স্ট্যান্ডে। কিন্তু তাঁদের রাত্রিবাসের কোনও ব্যবস্থা নেই। ফেল বাসের মধ্যেই তাঁরা রাত কাটাতে বাধ্য হন। পানীয় জল, শৌচালয়ের অব্যবস্থার জন্য ভুগতে হয় তাঁদের। তাই পরিকাঠামোর মান উন্নয়নের দাবিতে গলা মিলিয়েছেন শাসক-বিরোধী সব কর্মী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। বাঁকুড়া জেলা মোটর মজদুর সঙ্ঘের জেলা সাধারণ সম্পাদক সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষোভ, “বাম আমলে বাসস্ট্যান্ডের ট্রেড ইউনিয়ন, বাসমালিক সমিতি ও ব্যবসায়ীদের নিয়ে একটি সমন্বয় কমিটি গড়া হয়েছিল। সেই সমন্বয় কমিটির হাতেই বাসস্ট্যান্ডের দেখাশোনার দায়িত্ব ছিল। কোথাও কোনও সমস্যা হলে এই কমিটিই কাজ করত। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে ওই সমন্বয় কমিটিকে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে।” তাঁর আক্ষেপ, এখন বাসস্ট্যান্ডের হাল আরও খারাপ হয়েছে। জলের পাইপ ফুটো হয়ে জল বের হয়ে গোটা বাসস্ট্যান্ড কাদায় ভরে যাচ্ছে। কিন্তু পাইপ মেরামত হচ্ছে না। পানীয় জলের কলগুলি দীর্ঘদিন ধরে খারাপ। দেখার কেউ নেই। জলছত্রগুলি নষ্ট হয়ে পড়েছে। কেউ দেখে না। বাঁকুড়া জেলা বাস শ্রমিক ইউনিয়ন (সিটু) জেলা সম্পাদক উজ্জ্বল সরকার বলেন, “বাসস্ট্যান্ড অবহেলার শিকার হওয়ায় ভুগতে হচ্ছে যাত্রী ও বাসকর্মীদের।” জেলা বাস ওয়াকার্স ইউনিয়ন (আইএনটিটিইউসি)-র জেলা সম্পাদক মহম্মদ নঈমের কথায়, “পরিষেবা ও পরিকাঠামোর উন্নয়ন তো করতেই হবে। আমাদের সরকার এ নিয়ে চিন্তা ভাবনা করছে।”

কার হাত ধরে উন্নয়ন হবে জেলা সদরের এই বাসস্ট্যান্ডের? এই বাসস্ট্যান্ড গড়ে তোলার পিছনে তৃণমূলের প্রয়াত বিধায়ক কাশীনাথ মিশ্রের একটা বড় অবদান ছিল। কাশীনাথবাবুর স্ত্রী মিনতি মিশ্র বর্তমানে বাঁকুড়া কেন্দ্রের বিধায়ক। গোবিন্দনগর বাসস্ট্যান্ডের হাল ফেরাতে কী চিন্তা ভাবনা করছেন তিনি? তাঁর জবাব, “বাসস্ট্যান্ডের সমস্যার কথা জানি। কী করা যায় চিন্তা ভাবনা করছি।” জেলা পরিষদের সভাধিপতি অরূপ চক্রবর্তীর কথায়, “গেবিন্দনগর বাসস্ট্যান্ডটি পুরসভা দেখাশোনা করে। এখানে জেলা পরিষদের সে ভাবে কিছু করার নেই। তবে বাঁকুড়া শহরের জন্য আলাদা একটি বাসস্ট্যান্ড গড়ার চিন্তাভাবনা করছি আমরা।” আর বাঁকুড়ার বিদায়ী পুরপ্রধান শম্পা দরিপা বলছেন, “বাসস্ট্যান্ডের উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ সে ভাবে মেলে না। যেটুকু পেয়েছি তার মধ্যেই কাজ করেছি। সুলভ শৌচালয়টি আমরা লিজে দিয়েছি। তারাই এ বার দেখভাল করবে।” বাসিন্দাদের আক্ষেপ, আশ্বাসের ফানুস ওড়াচ্ছেন নেতা-নেত্রী। কিন্তু বাসস্ট্যান্ডের হাল পাল্টানোর ন্যূনতম উদ্যোগ কেউ দেখাতে পারছেন না।

amar shohor bankura rajdeep bandopadhay bus stand
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy