Advertisement
E-Paper

মাঠ খুঁড়লেই ইট, দাবি সংরক্ষণের

এখনও খেলার মাঠের মাটি খুঁড়লে উঠে আসে পুরনো আমলের ইট। বেরিয়ে পড়ে প্রাচীন নির্মাণের নিশান। প্রায় পঞ্চাশ মিটার জায়গা জুড়ে ধাপে ধাপে ইটের দেওয়াল মাটির সঙ্গে মিশে রয়েছে এই মাঠেই। সেই দেওয়াল মাটিতে মিশেই হয়েছে উঁচু ঢিপি। উপরে কৃষ্ণচূড়া গাছ। এ দৃশ্যপট মুরারই গ্রামের। অনেকে অবশ্য মুরাডই বলে উচ্চারণ করে থাকেন। জনশ্রুতি, মুরারইয়ের এই খেলার মাঠের বেশ কিছুটা অংশ জুড়ে আগে ছিল রাজবাড়ির মধ্যে। রাজবাড়ির রাজার নাম থেকেই এলাকার নাম ভাদিশ্বর। শীতে রোদে পিঠ দিয়ে মুরারইয়ের সে সব শ্রুতির কথাই বলছিলেন গ্রামের যুবক জাফারুজ্জামান, মলয় রায়চৌধুরীরা।

অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০১৪ ০২:৩৬
ভাদিশ্বরের  ষষ্ঠীতলায় এ ভাবেই পড়ে রয়েছে প্রাচীন মূর্তি। ছবি: অনির্বাণ সেন

ভাদিশ্বরের ষষ্ঠীতলায় এ ভাবেই পড়ে রয়েছে প্রাচীন মূর্তি। ছবি: অনির্বাণ সেন

এখনও খেলার মাঠের মাটি খুঁড়লে উঠে আসে পুরনো আমলের ইট। বেরিয়ে পড়ে প্রাচীন নির্মাণের নিশান। প্রায় পঞ্চাশ মিটার জায়গা জুড়ে ধাপে ধাপে ইটের দেওয়াল মাটির সঙ্গে মিশে রয়েছে এই মাঠেই। সেই দেওয়াল মাটিতে মিশেই হয়েছে উঁচু ঢিপি। উপরে কৃষ্ণচূড়া গাছ।

এ দৃশ্যপট মুরারই গ্রামের। অনেকে অবশ্য মুরাডই বলে উচ্চারণ করে থাকেন। জনশ্রুতি, মুরারইয়ের এই খেলার মাঠের বেশ কিছুটা অংশ জুড়ে আগে ছিল রাজবাড়ির মধ্যে। রাজবাড়ির রাজার নাম থেকেই এলাকার নাম ভাদিশ্বর। শীতে রোদে পিঠ দিয়ে মুরারইয়ের সে সব শ্রুতির কথাই বলছিলেন গ্রামের যুবক জাফারুজ্জামান, মলয় রায়চৌধুরীরা। তাঁদের কথায়, “এই যে মাঠ আর ঢিপি, ওটাই গ্রামের ষষ্ঠীতলা। উঁচু ঢিপির নীচে গ্রামের বাসন্তী মন্দির তৈরি হয়েছে। প্রাচীন সেই রাজবাড়ির জায়গায় গড়ে উঠেছে খেলার মাঠ। রাজবাড়ির সে নিদর্শন বলতে কাঁসা দিঘি নামে বড় সরোবর এখনও আছে।”

ভদ্রেশ্বর রাজার অবশিষ্ট রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষ নিয়ে মুরারইয়ের ইতিহাসকে তুলে ধরতে চান কবি নজরুল কলেজের ইতিহাস বিষয়ে আংশিক সময়ের শিক্ষক অর্নিবান জ্যোতি সিংহ, মুরারইয়ের সাংস্কৃতিক কর্মী সুনীল সাগর দত্ত, মহম্মদ মাসিকুল ইসলাম সিবলিরাও। অর্নিবাণবাবু বলেন, “মুরারই শব্দটি সম্ভবত মুরাডিহি শব্দ থেকে সৃষ্টি। মুরা শব্দটি ফাঁকা মাঠ, জনহীন প্রান্তর অর্থে ব্যবহৃত হয়। দিহি শব্দটি দীঘি থেকে এসেছে। জনবসতিহীন এলাকায় জলাভূমি নিয়ে মুরারই জনপদ ছিল বলে, সেখান থেকেই মুরারই নামের সৃষ্টি।” এছাড়া লোকসংস্কৃতি গবেষক আদিত্য মুখোপাধ্যায়ের ‘বীরভূম সমগ্র’ বই থেকে জানতে পারা যায়, ভদ্রেশ্বর সেন নামে একজন রাজার নামে আজকের এই ভাদিশ্বর।

বীরভূমের গ্রামগুলির ইতিহাস থেকে জানতে পারা যায় একসময় মুরারই ছিল মুর্শিদাবাদ জেলার অর্ন্তভুক্ত। ১৮৭২ সালে বীরভূম জেলার মুরারই থানা আসে পলসা গ্রামে। পরে ১৯৩৫ সালে পলসা গ্রাম থেকে মুরারইয়ে থানা স্থানান্থরিত হয়। মুরারই রেলস্টেশনকে ঘিরে লাগোয়া মুর্শিদাবাদ জেলা এবং বর্তমানের ঝাড়খণ্ড রাজ্যের মহেষপুর, আমড়াপাড়া, রদিপুর এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। ১৮৫১ সাল থেকে ১৮৫৮ সালের মধ্যে মুরারই রেলপথ বসে। এবং ১৮৫৯ সালে বর্ধমান-সাহেবগঞ্জ লুপ লাইনে মুরারই স্টেশনের উপর দিয়ে হাওড়া থেকে রাজমহল ট্রেন চালু হয়। পরের দিকে এই লাইনের উপর দিয়েই দিল্লি যাওয়ার জন্য একমাত্র আপার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেস চালু ছিল। যার নাম এখন হয়েছে মোঘল সরাই এক্সপ্রেস। ইতিহাস বলছে, মূলত ভাদিশ্বর, মুরারই ও ধীতোড়া এই তিন গ্রামের মৌজা নিয়ে আজকের মুরারই। এই ভাদিশ্বর মৌজায় রয়েছে আজকের মুরারই স্টেশন।

বখতিয়ার খিলজির আমলে ভাদিশ্বর এবং রাজগ্রামের কাছে ভাটড়ায় ওই রাজার এলাকা। তবে মুরারই থেকে ৫-৬ কিমি দূরে পাইকরে সেন আমলে বিজয় সেনের শিলালিপির নিদর্শন এখনও বর্তমান। ভাদিশ্বর রাজবাড়ি থেকে পুরাতত্ত্ব বিভাগ মাটি খনন করে নিয়ে যায়। সেখানকার ইট পরীক্ষা করে জানা গিয়েছে সেই ইটগুলি একাদশ শতাব্দীর।

এলাকার প্রবীণ বাসিন্দা রণজিত সিংহ, মহম্মদ হাবিব, পান্নালাল দত্তরা বলেন, “আগে মুরারই এলাকায় ঘোড়ার গাড়িতে মানুষ যাতায়াত করত। কম ট্রেন চলত। বেশিরভাগ জনপথ ছিল খাল বিলে ভর্তি। জনবসতি না থাকার জন্য শিয়ালের ডাকও শুনতে পাওয়া যেত। কিন্তু এখন যোগাযোগ ব্যবস্থা বদলে গিয়েছে। এখানে সংরক্ষণ করে পর্যটনের বিকাশ সম্ভব।”

মুরারই থেকে পূর্ব দিকে ৫ কিমি দূরে পাইকর গ্রাম। পশ্চিম দিকে কনকপুর। পাইকর এবং কনকপুর গ্রাম দুটিতেই রয়েছে অনেক পুরাতাত্ত্বিক এবং ঐতিহাসিক নির্দশন। মলয়পুর গ্রামে জলবিভাজিকা প্রকল্প ঘিরে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার প্রকল্প এখনও সরকারী প্রকল্পের আওতাধীন। ওই তিনটি গ্রাম এবং মাঝে মুরারই এলাকার ভাদিশ্বরকে নিয়ে একটি পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার দাবি এলাকাবাসীর বহুদিনের। আদতে মুরারই কে ঘিরে পর্যটনের আশা নিয়ে মুরারইবাসী কিন্তু থেমেও নেই। আগামী ২৫ এবং ২৬ ডিসেম্বর এই প্রথম মুরারইয়ের ইতিহাস সবার কাছে পোঁছে দিতে শুরু হচ্ছে মুরারই উত্‌সব। এলাকার সাংস্কৃতিক কর্মী সুনীল সাগর দত্ত বলেন, “উত্‌সবে মুরারই এর অজানা ইতিহাসের নানা দিক নিয়ে আলোচনা হবে। প্রকাশিত হবে মুরারই এলাকা নিয়ে বইও। মানুষ এখানে আসুন। মুরারইকে জানুন, এখানে পর্যটনের বিকাশ হোক।”

amar shohor apurba chattapadhyay murarai
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy