রাস্তার উপর ঝুলে পড়েছে বিদ্যুতের তার।
কোথাও টান আলগা হয়ে মাথার উপর বিপজ্জনক ভাবে ঝুলছে বিদ্যুতের তার। তো কোথাও রাস্তা উঁচু হতে হতে কচিকাঁচাদের নাগালের মধ্যে পৌঁছে গিয়েছে সংলগ্ন ট্রান্সফর্মারের বাক্সহীন ‘ফিউজ’। কার্যত এভাবেই মরণফাঁদ সঙ্গে নিয়ে বাস করছেন ময়ূরেশ্বরের বাসিন্দারা। দফতরের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়ে তাঁদের অভিযোগ, বিদ্যুত্ দফতর এসব নিয়ে ভাবে না। আমাদের কে মরল, কে বাঁচল, তাতে ওদের মাথাব্যথা নেই। ফলে, চরম আশঙ্কার মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে।
বিদ্যুত্ দফতর এবং স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বছর খানেক আগে ময়ূরেশ্বর থানার কুলিয়াড়া পোষ্টঅফিস লাগোয়া ২২০ ভোল্ট বিদ্যুত্বাহী তারের একটি খুঁটির পিছনের টান কেটে যায়। কিন্তু দফতর আজও সেই তারের টান মেরামত করেনি। এর ফলে খুঁটি সামনের দিকে বেশ কিছুটা হেলে যাওয়ায় বিদ্যুত্বাহী তার প্রায় মানুষের সমান উচ্চতায় ঝুলে নেমে এসেছে। ওই তারের নীচেই রয়েছে রাস্তা। অন্যমনস্ক হয়ে চলাচল করলেই যে কোনও সময় বিদ্যুত্স্পৃষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, বারবার পরিস্থিতির কথা বিদ্যুত্ দফতরের সমস্ত স্তরে জানিয়েও কোনও লাভ হয়নি। অথচ তারের নীচ দিয়ে শুধু গ্রামবাসীরাই নন, বহিরাগত বহু মানুষও নানা কাজে পোষ্ট অফিসে যাওয়া আসা করেন।
শুধুমাত্র বড়রাই নন, বিপদের আশঙ্কা রয়েছে কচিকাঁচাদেরও। কারণ ওই তারের নীচেই অধিকাংশ সময় দাঁড়িয়ে থাকে মোটর কিংবা গরুর গাড়ি। আর বাচ্চারা নজর এড়িয়ে হামেশাই সেইসব গাড়ির ওপরে ওঠে খেলায় মেতে ওঠে। তাই অভিভাবকেরা বাচ্চাদের আটকাতে পালা করে গাড়ি পাহারা দেন। স্কুল শিক্ষক সুজিত গড়াই, সঞ্জয় দাসেরা বলেন, “এ ছাড়া উপায়ই বা কী, বারবার বলেও বিদ্যুত্ দফতর তার উঁচু করার কোনও উদ্যোগই নেয়নি। তাই বিপদের হাত থেকে বাঁচাতে আমরা বাচ্চা কিংবা গাড়ি পাহারা দিই।” পোষ্টমাস্টার অঞ্জলি দাস জানান, তাঁকেও মাঝে মধ্যে কাজ ফেলে রেখে অফিসে আসা লোকজনকে তার সম্পর্কে সর্তক করতে যেতে হয়।
গ্রামেরই বাসিন্দা, স্থানীয় ঢেকা পঞ্চায়েতের প্রধান তৃণমূলের মিঠু গড়াই এবং সংশ্লিষ্ট ময়ূরেশ্বর ২নম্বর পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি কল্যাণী দাস বলেন, “ভেবেছিলাম গ্রামবাসীরা পরিস্থিতির কথা জানানোর পর বিদ্যুত্ দফতর সজাগ হবে। কিন্তু এখন দেখছি আমাদেরই প্রশাসনিক পদক্ষেপ নিতে হবে।”
ছোটদের নাগালের মধ্যে ট্রান্সফর্মার।
আরও বিপজ্জনক পরিস্থিতির খবর মিলল ওই একই থানার তিলপাড়া গ্রামে। ওই গ্রামের ১৩৫ নং অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের পাশেই রয়েছে মহিষা চটি বাসস্ট্যান্ড যাওয়ার রাস্তা। আর অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র লাগোয়া সেই রাস্তার গায়েই রয়েছে একটি ট্রান্সফর্মার। গিয়ে দেখা গেল, ওই ট্রান্সফর্মারেও কোনও ফিউজ বাক্স নেই। তারে-তারে জোড়াতালি দিয়ে ফিউজ বাঁধার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু তার উচ্চতা কচিকাঁচাদের নাগালের মধ্যে। এর ফলে স্থানীয় বাসিন্দাদের দুশ্চিন্তার শেষ নেই।
কামাল শেখ, মানিকমোতি বিবিরা জানান, এক সময় ট্রান্সফর্মারের উচ্চতা ছোটদের নাগালের বাইরে ছিল। রাস্তায় মাটি পড়তে পড়তে লাগোয়া ট্রান্সফর্মারের উচ্চতা কমে গিয়েছে। অথচ রাস্তা নির্মাণকারী সংস্থা, পঞ্চায়েত, বিদ্যুত্ দফতর, কারও ট্রান্সফর্মার উঁচু করার কোনও উদ্যোগ নেই। অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী আফরোজা খাতুন বলেন, “ছেলেমেয়েরা ট্রান্সফর্মারের নিচে গিয়ে কখন বিপদ ঘটায়, সবসময় সেই আতঙ্কে থাকি। বিপদ না ঘটা পর্যন্ত তো কারও টনক নড়ে না।” অভিযোগের সত্যতা মিলেছে ওই থানারই বজরহাট গ্রামেও। গ্রামবাসীরা বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে গ্রাম সংলগ্ন মাঠে ১১০০০ ভোল্টের তার নিচু হয়ে ঝুলছিল। বারবার বলেও বিদ্যুত্ দফতর সে তার উঁচু করার কোনও ব্যবস্থা করেনি। মাস কয়েক আগে ধান কাটতে গিয়ে সেই তারে কাস্তে লেগে বিদ্যুত্স্পৃষ্ট হয়ে এক যুবকের মৃত্যু হয়।”
ওই ঘটনার পর দফতরের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়েন গ্রামের মানুষ। ক্ষোভের আঁচ পেয়ে রাতারাতি তার উঁচু করার ব্যবস্থা করে দফতর। বিদ্যুত্ দফতরেরই এক সূত্রে জানা যাচ্ছে, আসলে ট্রান্সফর্মার বসানোর সময় ভার বহন ক্ষমতা অনুযায়ী ফিউজ বাক্স লাগানো হয় না। সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারের সঙ্গে আর্থিক বোঝাপড়া করে কম ক্ষমতাসম্পন্ন ফিউজ বাক্সের ছাড়পত্র দেন দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক। আবার পরবর্তী কালে সংযোগ বৃদ্ধি পেলেও সেই অনুযায়ী অধিক ক্ষমতা সম্পন্ন ফিউজ বাক্স বদলানো হয় না। এর ফলে অল্প দিনেই বিকল হয়ে পড়ে ওই সব ফিউজ বাক্স। অন্য দিকে খুঁটির টান আলগা হতে হতে বিদ্যুত্বাহী তার ঝুলে পড়ে। আবার চাষ কিংবা বাড়ি নির্মাণের জন্য গ্রামবাসীরাও টানের তার কেটে ফেলেন। অনেক ক্ষেত্রে সময় মতো ওই টান বদলানো হয় না। ফলে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে। যার দায় দফতর এড়িয়ে যেতে পারে না। সংশ্লিষ্ট ময়ূরেশ্বর গ্রুপ ইলেকট্রিক সাপ্লাইয়ের স্টেশন ম্যানেজার তথা অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার গঙ্গাধর মালি বলেন, “বিষয়টি অমার জানা নেই। কেউ আমাকে জানাননি। খোঁজ নিয়ে দেখছি।” অন্য দিকে বিদ্যুত্ দফতরের সুপারিন্টেন্ডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার তপন কুমার দে বলেন, “বিষয়টি স্টেশন ম্যানেজারের দেখার কথা। এলাকার বাসিন্দারা যদি তাঁকে জানিয়ে থাকেন, তাহলে কেন উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হল না, তা খোঁজ নিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
ছবিগুলি তুলেছেন সোমনাথ মুস্তাফি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy