মাঠ থেকে ধান তোলার কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। কিন্তু রাজ্য সরকার এই জেলায় এখনও ধান কেনা শুরু করেনি। আবার বীরভূম কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্ক বন্ধ থাকায় সমবায় সমিতি থেকেও কোনও কৃষিঋণ মিলছে না। এমনকী, গচ্ছিত টাকাও তোলা যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে বিপাকে পড়েছেন এখানকার কয়েক হাজার প্রান্তিক চাষি। আসন্ন রবি শস্যের মরসুমে তাঁদের হাতে টাকা নেই। তাই বাধ্য হয়ে সরকারি সহায়ক মূল্যের থেকে অনেক কম দামে খোলা বাজারে নতুন ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন বলে জেলার একাংশের চাষিদের অভিযোগ। অনেকে আবার চাষের জন্য চড়া সুদে বাজার থেকে টাকাও ধার করছেন। এই পরিস্থিতিতে জেলা প্রশাসনের অবশ্য আশ্বাস, খুব শীঘ্রই চাষিদের থেকে ধান কেনার প্রক্রিয়া শুরু হবে।
এই জেলায় সংখ্যাগরিষ্ঠ চাষিই প্রান্তিক। এ ছাড়া রয়েছেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি মাপের চাষিরাও। সমস্যাটা এঁদেরই। যাঁদের অনেকেই বর্ষার ধান তুলে আলু, গম, সর্ষে বা রবি শস্যের চাষ করেন। কিন্তু রবি শস্য লাগানোর খরচ অনেক। তা জোগাড় করতে হিমসিম খেতে হয় ওই সব চাষিদের। ক্ষুদ্র চাষিদের বক্তব্য, রবি শস্য লাগানোর খরচ জোগানোর মূলত দু’টি উপায়। সমবায় বা ব্যাঙ্ক থেকে কৃষিঋণ নেওয়া অথবা বর্ষার ধান বিক্রি করে রবি চাষ করা। সমবায় ব্যাঙ্ক-সঙ্কটের জেরে জেলার সমবায়গুলি বন্ধের মুখে। তাই কৃষিঋণ পাওয়ার কোনও সম্ভবনা নেই। আর ব্যাঙ্ক থেকে কৃষি বা যে কোনও ঋণ পেতে বহু জটিলতা। তাই বাধ্য হয়েই নতুন ধান তুলে বিক্রি করে রবি শস্য লাগানোর খরচ জোগাতে হচ্ছে বলে চাষিদের দাবি। ময়ূরেশ্বরের কুণ্ডলার বুদ্ধদেব চট্টোপাধ্যায়, বাবু বন্দ্যোপাধ্যায়, বুঁইচা গ্রামের তরুণী মণ্ডল, ইটেহাটের রামু ঘোষ, সাঁইথিয়ার রায়হাটের খাতির মুর্মু, মতিপুরের প্রশান্ত মণ্ডল, কেন্দুয়ার বাপি মণ্ডল, প্রত্যেকেই বলছেন, “সমবায় থেকে কৃষিঋণ মিলছে না। রবি শস্য চাষ করতে গিয়ে আর্থিক ভাবে চরম সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। বাজার থেকে চড়া সুদে টাকা নিতে হচ্ছে। তা না পেলে তড়িঘড়ি ধান কেটে অল্প দামেই (প্রতি কুইন্টাল ১১০০-১১৫০ টাকা) বিক্রি করতে হচ্ছে।”
চাষিদের অভিযোগের সত্যতা মেনে নিচ্ছেন সমবায় সমিতিগুলির ম্যানেজারদের একটা বড় অংশই। বুঁইচা এলাকার কৃষ্ণনগর সমবায় সমিতির ম্যানেজার অপূর্ব মণ্ডল বলেন, “কৃষ্ণনগর, বুঁইচা, চট্টপারুলিয়া, নাদরা-সহ এলাকার বহু গ্রামের দেড়শো থেকে দু’শো গরিব কৃষিজীবি লোকজন চাষের ব্যাপারে, বিশেষ করে রবি শস্য চাষের ক্ষেত্রে সমবায়ের কৃষিঋণের উপর নির্ভরশীল ছিলেন। সমবায়ের কাজকর্ম এক রকম বন্ধই থাকায় ওই সব চাষিরা সত্যিই অসুবিধেয় পড়েছেন।” তাঁরই মতোই এই পরিস্থিতিতে সরকারি সহায়ক মূল্যে ধান কেনা শুরু হলে সমস্যা অনেকটা মিটবে বলে মত দিয়েছেন খরাসিনপুরের সমবায় সমিতির ম্যানেজার ফজলুল হকও।
চাষিরা কেন ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিচ্ছেন না?
বনগ্রামের হরেকৃষ্ণ মণ্ডল, মাঠপলসার শেখ বাকাই, গোবিন্দপুরের শেখ আসরাফ, মল্লারপুরের নরেশ মণ্ডল, নলহাটির যমুনা হাজরা, দুবরাজপুরের ঘোগা গ্রামের দিলীপ রায়দের মতো বহু চাষিরই কিন্তু এ ব্যাপারে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে। চাষিদের অভিযোগ, “ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ পেতে অনেক হ্যাপা। পদ্ধতিও খুব জটিল। ঋণ পেতে পেতেই চাষের সময় চলে যাবে। এমনিতেই চাষে ব্যস্ত থাকার জন্য নাওয়া-খাওয়ারও সময় পাই না। ব্যাঙ্কে গিয়ে ঋণ আদায় করার সময় কোথায়!” এই সঙ্কটের পরিস্থিতিতেও সরকার এখনও ধান কেনা শুরু না করায় তাঁরা আড়তদারদের দামি মতো জলের দরে ধান বিক্রি করতে দিতে বাধ্য হচ্ছেন বলে দাবি করেছেন। যদিও ব্যাঙ্কে হয়রান হওয়া নিয়ে চাষিদের বক্তব্যের সঙ্গে একমত হয়নি ব্যাঙ্কগুলি। একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের ব্যাঙ্কিং সহায়ক সাধন সিংহের দাবি, “ব্যাঙ্ক থেকে কৃষিঋণ পাওয়াও সহজ। শুধু পদ্ধতি অনুযায়ী আবেদন করতে হয়। খুব কম সুদে (মাত্র ৭ শতাংশ) কৃষিঋণ পাওয়া যায়। মল্লারপুরের ভেলিয়ান গ্রামের উদয়চন্দ্র মণ্ডল, গোয়ালা গ্রামের তরুণ মণ্ডল, ফতেপুরের অরূপ সরকার-সহ বহু কৃষিজীবি লোক জন এ বারও এ ভাবেই কৃষিঋণ পেয়েছেন।”
এ দিকে, ধানের আড়তদারদের একাংশ জানাচ্ছেন, এখন সাধারণত গোড্ডা, টেন-টেন, ৬৪, হাইলিং প্রভৃতি ধান ওঠা শুরু হয়েছে। এ সব ধানের গুনগত মান কম। তাই সরকারি দামে কেনা বা বিক্রি হয় না। চালকলেও সব সময় তা নিতে চায় না। তবে, হাইলিং ৩৬ সরকারি দামেই কেনাবেচা হচ্ছে বলেই ওই আড়তদারেরা দাবি করেন। বীরভূম জেলা মিল মালিক ওনার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি দীপক প্রামাণিক বলেন, “এখনও সরকারি ধান কেনার কোনও নির্দেশ পাইনি। তবে, চালকলগুলি প্রয়োজন মতো ধান কিনছে। ধানের মান অনুযায়ী কুইন্টাল প্রতি ১৪০০-১৫০০ টাকা অবধি দর উঠছে।”
অন্য দিকে, এ নিয়ে যোগাযোগ করা হলে জেলা কৃষি আধিকারিক প্রদীপ মণ্ডল বলেন, “জেলায় এখনও পর্যন্ত সরকারি সহায়ক মূল্যে ধান কেনা শুরু হয়নি। তবে, ঠিক কবে থেকে শুরু হবে, তা জেলা কৃষি বিপণন আধিকারিকই বলতে পারবেন।” মোবাইল ফোন বন্ধ থাকায় জেলা কৃষি বিপণন আধিকারিক আকবর আলির সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। তবে, জেলাশাসক পি মোহন গাঁধী বলেন, “সরকারি ভাবে ধান কেনার প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছে। খুব শীঘ্রই ধান কেনা শুরু হবে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy