Advertisement
E-Paper

সাক্ষর মিশনের টাকা খরচ করা নিয়ে বিতর্ক

জেলার ২৩ হাজারেরও বেশি সাক্ষরতা কেন্দ্রের অর্ধেকের বেশির বাস্তবে কোনও অস্তিত্বই নেই। আর যেগুলির অস্তিত্ব রয়েছে সেগুলির পরিকাঠামো বলেও কার্যত কিছু নেই। আবার প্রকল্পে নিযুক্ত প্রেরকরা নিয়মিত ভাতা পাচ্ছেন না। অধিকাংশকে প্রয়োজনীয় ট্রেনিংও দেওয়া হয়নি। অথচ খাতায়কলমে বীরভূমে ‘সাক্ষর ভারত মিশন’ প্রকল্পের কোনও সমস্যাই নেই। কিন্তু জেলায় প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের অধিকাংশেরই অভিজ্ঞতা কিন্তু ঠিক উল্টো।

অরুণ মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০১:১১

জেলার ২৩ হাজারেরও বেশি সাক্ষরতা কেন্দ্রের অর্ধেকের বেশির বাস্তবে কোনও অস্তিত্বই নেই। আর যেগুলির অস্তিত্ব রয়েছে সেগুলির পরিকাঠামো বলেও কার্যত কিছু নেই। আবার প্রকল্পে নিযুক্ত প্রেরকরা নিয়মিত ভাতা পাচ্ছেন না। অধিকাংশকে প্রয়োজনীয় ট্রেনিংও দেওয়া হয়নি। অথচ খাতায়কলমে বীরভূমে ‘সাক্ষর ভারত মিশন’ প্রকল্পের কোনও সমস্যাই নেই। কিন্তু জেলায় প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের অধিকাংশেরই অভিজ্ঞতা কিন্তু ঠিক উল্টো। অভিযোগ, প্রকল্পে আড়াই লক্ষেরও বেশি মানুষকে ‘নবসাক্ষর’ হিসেবে দেখানো হয়েছে। যাঁদের অধিকাংশই নিজের সইটুকুও করতে পারেন না। আর যাঁরা পারেন, তাঁদের কাছে স্রেফ তা ছবি আঁকা!

জনগণের কয়েক কোটি টাকা খরচের পরেও যে প্রকল্পের এমন হাল, যার ন্যূনতম পরিকাঠামোই আজও গড়ে তোলা যায়নি সেই প্রকল্পে একটি ‘অভিনব’ উদ্যোগ নিয়েছে বীরভূম জেলা প্রশাসন। আর তা নিয়েই দেখা দিয়েছে নয়া বিতর্ক। আজ, সোমবার ‘আর্ন্তজাতিক সাক্ষরতা দিবস’ পালনের অঙ্গ হিসেবে জেলায় এক দিনে ৯ লক্ষ টাকা খরচ করছে প্রশাসন। সেখানে কী হচ্ছে? কোনও সাক্ষরতা কেন্দ্রের জীর্ণ হয়ে পড়া ব্ল্যাকবোর্ড কিনতে বা কোনও অন্ধকার ক্লাবঘরের ক্লাস বসা ঘরে বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে সে টাকা খরচ হচ্ছে না। তার বদলে জেলার ৫০ হাজার নিরক্ষর মানুষের হাতে একটি করে রাখি পড়ানো হবে, সন্ধ্যায় তাঁরা একটি করে মোমবাতি জ্বালাবেন, জেলার ১৯টি ব্লকে সাক্ষরতার বিশেষ ট্যাবলো ঘুরবে, দিনভর জেলা জুড়ে এমনই নানা অনুষ্ঠান হবে। এবং ওই নিরক্ষরদের হাতেই তুলে দেওয়া হবে একটি করে বই। প্রশাসনের দাবি, নিরক্ষরদের মধ্যে পড়াশোনার আগ্রহ তৈরিতেই নেওয়া হয়েছে এমন উদ্যোগ। যা শুনে বিজেপির জেলা সভাপতি দুধকুমার মণ্ডলের কটাক্ষ, “যে দিদি উৎসব করে কোটি কোটি টাকা মাটি করেন, তাঁর ভাইদের থেকে এর বেশি কী আর প্রত্যাশা করা যায়!” আবার সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সাধন ঘোষের প্রতিক্রিয়া, “রাখি পরিয়ে আর মোমবাতি জ্বালিয়ে শিক্ষার কতটা উন্নতি হবে, জানি না। তবে, এখানে দেখছি বহিরঙ্গটাই আসল হয়ে গিয়েছে। বরং টাকাটা যদি প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত একদম নিচুতলার কর্মী অবধি পৌঁছত, তা হলে হয়তো কোনও উপকার হত।” এক দিনের এমন কর্মকাণ্ডে নিরক্ষরদের তেমন ভাবে আকৃষ্ট করা যাবে না বলেই তাঁর আশঙ্কা। প্রকল্পে যুক্ত কর্মীদের একাংশের মত, “এ সবের বদলে প্রকল্পের বুনিয়াদি পরিকাঠামো কীভাবে উন্নয়ন করা যায়, তা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করাটাই এখন বেশি জরুরি।”

প্রশাসন সূত্রে খবর, অনুষ্ঠানের জন্য ট্যাবলো এবং রাখি তৈরি করেছেন বোলপুরের কালিকাপুর গ্রামের শিল্পীরা। বিশেষ করে ওই দিনের জন্য তৈরি বড় আকারের রাখিগুলি সাধারণ রাখির তুলনায় বেশ অভিনব। রাখির মধ্যেই থাকবে একটি ছোট্ট স্লেট। যার মধ্যে বর্ণপরিচয়ের কয়েকটি অক্ষর লেখা থাকছে। প্রকল্পের জেলা আধিকারিক সম্রাট মণ্ডল বলছেন, “সমগ্র পরিকল্পনাটিই অতিরিক্ত জেলাশাসক (জেলা পরিষদ) বিধান রায়ের। অনুষ্ঠান করতে রাজ্য সরকার সাড়ে সাত লক্ষ এবং জেলা পরিষদ দেড় লক্ষ টাকা দিয়েছে। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বহু নিরক্ষর মানুষ সাক্ষর হতে উজ্জীবিত হবেন।” তবে শুধু সাক্ষর করাই নয়, সেই সঙ্গে নব সাক্ষরেরা যাতে স্বনির্ভর হন, তার জন্যও পদক্ষেপ করা হয়েছে। পলিটেকনিক কলেজে শালপাতার থালা তৈরি, বিউটিশিয়ান কোর্স, ওয়েলডিং প্রভৃতি বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যবস্থা করছে জেলা প্রশাসন। এই সব পরিসংখ্যানে অবশ্য ভুলছেন না নারাজ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত কর্মীরা।

২০০৯ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের ৭৫ শতাংশ ও রাজ্য সরকারের ২৫ শতাংশ অর্থ সাহায্যে ‘সাক্ষর ভারত মিশন’ প্রকল্পটি চালু হয়। লক্ষ্য ছিল ১৫-৬০ বছর বয়সী নিরক্ষরদের (মূলত মহিলা) সাক্ষর করা। তথ্য বলছে, জেলায় ৩ লক্ষ ৮০ হাজার ৬২৬ জন চিহ্নিত নিরক্ষর মানুষের মধ্যে ইতিমধ্যেই ২ লক্ষ ৬৩ হাজার ২৯৩ জনকে সাক্ষর করে তোলা সম্ভব হয়েছে। আর জেলায় এই মুহূর্তে প্রকল্পের অন্তর্গত ২৩,৩২৮টি সাক্ষরতা কেন্দ্র চালু রয়েছে। কিন্তু কাগজ-কলমের সেই হিসেব আর বাস্তব চিত্রের মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে বলে অভিযোগ। কারণ, প্রকল্পে যুক্ত কর্মীদের অভিজ্ঞতাই বলছে, অধিকাংশ নিরক্ষরই ছবির মতো সই আঁকতে শিখেছেন। আর অর্ধেক সাক্ষরতা কেন্দ্রই বন্ধ। যেমন, দুবরাজপুরের গোহালিয়াড়া পঞ্চায়েতেই একসময় ৩০টি সাক্ষরতা কেন্দ্রে ছিল। বর্তমানে চালু মাত্র ১০টি। আবার খয়রাশোলের পাঁচড়া পঞ্চায়েতের ৪৯টির মধ্যে ২৩টি সাক্ষরতা কেন্দ্রই বন্ধ। এমনকী এ-ও অভিযোগ, নিরক্ষর শিক্ষার্থীদের বদলে স্থানীয় প্রাথমিক স্কুল, এসএসকে বা এমএসকে থেকে পড়ুয়াদের দিয়ে কোনও ক্রমে প্রকল্পের নির্দিষ্ট মূল্যায়ন উতরে দেওয়া হয়। গোটা জেলা জুড়েই কার্যত এক চিত্র।

সমস্ত অভিযোগই অবশ্য সম্রাটবাবু উড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর দাবি, প্রকল্পের কাজ এই জেলায় ভাল গতিতেই এগোচ্ছে। আজকের সারাদিনের অনুষ্ঠানে সাফল্যের সেই কথা তুলে ধরেই নিরক্ষরদের মধ্যে শিক্ষার জ্যোতি জ্বালানো যাবে। অন্য দিকে, বিধানবাবুর প্রতিক্রিয়া, “জেলায় স্বনির্ভর গোষ্ঠীর বেশির ভাগ সদস্যই নিরক্ষর। মূলত তাঁদেরকে ঘিরেই এই সাক্ষরতা অভিযান। আমরা আজকের অনুষ্ঠান একটু অন্য রকম ভাবে সাজিয়েছি। ১৯টি ব্লক ছাড়াও জেলা সদরেও পদযাত্রা, নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে।” অনুষ্ঠান উপলক্ষে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের কাছে তাঁর আবেদন, “নিরক্ষর প্রতিবেশীদের অন্তত এক জনকে সাক্ষর করে তোলো।” সব বিতর্ক দূরে ঠেলে জেলা প্রশাসনের এই কর্মকাণ্ড জেলায় ‘সাক্ষর জ্যোতি’র নতুন সূচনা করতে চলেছে বলেই তাঁর আশা।

(সহ-প্রতিবেদন: দয়াল সেনগুপ্ত)

arun mukherjee national literacy mission dayal sengupta
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy