Advertisement
E-Paper

হকের ভোটে জয়ের কাঁটা, শান্তি নেই কেষ্টনামেও

গলায় পদ্ম ছাপ উত্তরীয়। কপালে লাল টিপ। মাথায় গেরুয়া ফেটি। ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনিটুকু যা নেই! চিত্রনাট্য বলছে আমি সৎ ব্রাহ্মণ পরিবারের ছেলে। মাকে দেবীর মতো পুজো করি। রাজনীতিতে এসে মানুষের সেবা যদি করতে না পারি, মা আমার মুখ দেখবেন না বলেছেন। জীবনে সব পেয়েছি। শুধু বাবা ডাক শুনিনি। বীরভূমকে সন্তান স্নেহে লালন করতে চাই। এত দিন সকালে বিকেলে রাতে ‘আই লভ ইউ’ বলেছি, আজ আপনাদের কাছে ‘আই লভ ইউ’ ফেরত চাইতে এসেছি।

জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০১৪ ০২:২৩

গলায় পদ্ম ছাপ উত্তরীয়। কপালে লাল টিপ। মাথায় গেরুয়া ফেটি। ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনিটুকু যা নেই!

চিত্রনাট্য বলছে আমি সৎ ব্রাহ্মণ পরিবারের ছেলে। মাকে দেবীর মতো পুজো করি। রাজনীতিতে এসে মানুষের সেবা যদি করতে না পারি, মা আমার মুখ দেখবেন না বলেছেন। জীবনে সব পেয়েছি। শুধু বাবা ডাক শুনিনি। বীরভূমকে সন্তান স্নেহে লালন করতে চাই। এত দিন সকালে বিকেলে রাতে ‘আই লভ ইউ’ বলেছি, আজ আপনাদের কাছে ‘আই লভ ইউ’ ফেরত চাইতে এসেছি।

অঞ্জন চৌধুরী আর হিন্দুত্বের এই হাইভোল্টেজ পালার নাম জয় বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘হি হি হি হি আই লভ ইউ’, অঞ্জনের ‘হীরকজয়ন্তী’ ছবির সংলাপ। নায়ক গ্রামের ছেলে হীরু, ওরফে জয়।

নলহাটির শীতলগ্রাম হাসপাতাল চত্বরে অন্তত হাজারখানেকের পিলপিলে ভিড়। তার মধ্যে কম করে ৬৫ শতাংশ সোমত্ত পুরুষ। ‘হি হি হি হি আই লভ ইউ’ হল, জনতা সোল্লাসে ফেটে পড়ল। ছবিটার এক বিন্দু বদল নেই গোপালচকে। সংখ্যালঘু গ্রাম এটা। কলকাতার পার্ক সার্কাসে শৈশব কাটানো জয়ের মুখে তৃপ্তির হাসি। সন্ধে নামছে। ছোট-বড় এলইডি টর্চ পথ আটকাচ্ছে। অঞ্জন পরপার থেকে দেখছেন, ১৯৯০ সালের ছবি আজ নতুন করে বেঁচে উঠেছে। রামপুরহাটের সিডি-ডিভিডির দোকানে খোঁজ নিয়ে জানলাম, ‘হীরকজয়ন্তী’র চাহিদা বেড়ে গিয়েছে।

দুবরাজপুরের লোবায় অবশ্য রোদ যত চড়া, ভোটের আঁচ তত নয়।

একটু এগোলেই খয়রাশোলের খোলামুখ কয়লা খনি। লোবাতেও মাটির নীচে কয়লা। দেড় বছর আগের নভেম্বরে জমি আন্দোলনে গুলি চলেছিল এখানে। গ্রামের মানুষের আটকে রাখা ডিভিসি-এমটার মাটি কাটার যন্ত্র ছাড়াতে এসেছিল পুলিশ। সেই যন্ত্র আজও মাঠের এক কোণে পড়ে। ক’দিন আগে সিউড়িতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনসভায় লোক ভরানোর জন্য গাড়ি এসেছিল।

লোবা আর বাবুপুর থেকে কেউ যায়নি। কৃষিজমি রক্ষা কমিটির নেতা ফেলারাম মণ্ডল বললেন, “সিপিএম সরকার নন্দীগ্রামে গুলি চালাল, তৃণমূল সরকার এখানে। আমরা আর কী বলব?’’ দোকানঘরের দেয়ালে জ্বলজ্বল করে তাকিয়ে আছে, সারদার বিজ্ঞাপন। জমি দিয়ে পাওয়া টাকা অনেকেই রেখেছিলেন সারদায়। পরিণাম যা হওয়ার হয়েছে। মনসা মন্দিরের দাওয়ায় বসে আজ আর এ সব নিয়ে হইচই করার মনও কারও নেই সে ভাবে।

দিশাহীন নির্লিপ্তির এই ছবিই কিছু ক্ষণ আগে দেখে এসেছিলাম সাগরবাঁধিতে। দ্বারকা ব্যারেজ পেরিয়ে সোঁতশালের রাস্তা দিয়ে একটু এগোলেই সাগরবাঁধি। এই গ্রামেই ২০০৯ সালে নিহত হন আদিবাসী যুবক মতিলাল। পাঁচামি পাথর খাদান শিল্পাঞ্চলে আদিবাসী আন্দোলনের উত্থান ওই ঘটনার পরেই। পাথরের ধুলো কুয়াশার মতো ঢেকে রাখে গোটা এলাকা। আন্দোলনের পরে রাস্তায় খানিক জল দেওয়া শুরু হয়েছে। কিন্তু খাদান শ্রমিকরা মাস্ক পাননি আজও। নাকে কাপড় বেঁধে ক্রাশারে পাথর ঢালা চলছে। মাঝখান থেকে খাদানে আদিবাসীদের কাজ পাওয়ার হার কমে গিয়েছে। সাগরবাঁধিতে ভরদুপুরে জনা পনেরো আদিবাসী যুবক মাচায় বসে। কর্মহীন। আন্দোলনের নেতৃত্ব দু’ভাগ। মাঝিমারাও গোষ্ঠী তৃণমূলপন্থী। আদিবাসী গাঁওতার দাবি, ২২ শতাংশ আদিবাসী ভোটের ১৭ শতাংশ এ বার বিজেপিতে যাবে। কিন্তু ভোটের সাত দিন আগেও সাগরবাঁধির ধুলোয় পা পড়েনি কোনও দলের।

সে দিক থেকে সামান্য ভাগ্যবান লোবা। শতাব্দী রায় না এলেও জয়কে চোখে দেখল সে। শ’চারেক লোক জমল। জয় ‘আই লভ ইউ’ করলেন না। বললেন, “অভিনেতা তো, আমি খুব ইমোশনাল! মমতা সিঙ্গুরে জমি ফেরত দিতে পারেননি। আমি ভুজুংভাজুং দেব না। আপনারা যখন খনির স্বার্থে তিনফসলি জমিও দিতে রাজি, আমি অন্তত দালালবাজিটা রুখব।’’

শতাব্দীর জোড়াফুলে অতএব দুশ্চিন্তার কাঁটা। একটা কাঁটা যদি হন আনকোরা জয়, অন্যটা কংগ্রেসের সৈয়দ সিরাজ জিম্মি। বীরভূমে একদা জয়ের মতোই আনকোরা অভিজিৎ মুখোপাধ্যায় যখন নলহাটিতে জিতেছিলেন, তার নেপথ্য কারিগর ছিলেন প্রণব-ঘনিষ্ঠ এই জিম্মিই। লিকার চা, লেবুর জল আর ল্যাবেঞ্চুসের স্টক সঙ্গে নিয়ে জিম্মি বীরভূম জুড়ে চরকি পাক দিচ্ছেন। রামপুরহাট থেকে নলহাটি, বিরাট বিরাট ফ্লেক্সে মুড়ে দিয়েছেন। রামপুরহাটেই বাড়ি। ছ’বারের পুরপিতা, তিন বারের পুরপ্রধান। সিউড়িতে জিম্মির মিছিলে তাক লাগানো ভিড় হয়েছে। আগের বার জোট ছিল, কংগ্রেস ভোট তৃণমূলের বাক্সে পড়েছিল। এ বার কী হবে? বীরভূম কেন্দ্রে ৩৫ শতাংশেরও বেশি সংখ্যালঘু ভোট। জিম্মির বিশ্বাস, সেটার সিংহভাগ তিনি পাবেন। বিজেপি একটাও পাবে না।

জেলা বিজেপি সহ-সভাপতি শুভাশিস চৌধুরী অবশ্য মনে করছেন, “মানুষের মনে ধারণা জন্মে গিয়েছে কেন্দ্রে মোদী আসছেন। এই অবস্থায় কেউ ভোট নষ্ট করতে চাইবেন না।” দাবি করলেন, দিনে ৫০০ লোক আসছেন পার্টি অফিসে। সংগঠন বাড়ছে। সংখ্যালঘু যুব সম্প্রদায়ও উন্নয়নের স্বার্থে বিজেপির সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন।

নিশ্চিন্ত আর থাকা গেল না রে তোপসে!

শতাব্দী আগের বার ৬২ হাজার ভোটে জিতেছিলেন। তারকা প্রার্থী হিসেবে সে বারই প্রথম তাঁর বীরভূমে পদার্পণ। এ বার সাংসদ শতাব্দীর মার্জিনে কতটা থাবা বসাবেন জয়, সেটা কর্মীদের ভাবিয়ে তুলছে। এতটাই যে, বিদগ্ধ অধ্যাপক বলে পরিচিত রামপুরহাটের বিধায়ক আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়কেও কিন্তু জয়কে নিয়ে চাঁছাছোলা আক্রমণে যেতে হচ্ছে। পরের পর জনসভায় সেলিব্রিটির বান ডাকাতে হচ্ছে তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্বকে। ও-তরফে রাজনাথ সিংহ নিজে ঘুরে গিয়েছেন যে! শতাব্দী অবশ্য বলছেন, মিডিয়া জয়কে নিয়ে বেশ একটু বাড়াবাড়ি করছে। “আমি জিতব, আগের চেয়ে মার্জিন বাড়িয়েই জিতব! দেখলেন না, লোকে তিন-চার ঘণ্টা ধরে আমাকে দেখবে বলে দাঁড়িয়ে থাকছে?’’

দেখেছি। পিনারগড়িয়া রেলগেট পেরিয়ে পাইকপাড়া-খড়িডাঙা-নারায়ণপুরচাইতে অবশ্যই পারেন। কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা সব সময় খুব ভাল হচ্ছে না যে। বেশ কিছু জায়গায় বিক্ষোভের মুখে পড়েছেন। সামগ্রিক ভাবে তাঁকে নিয়ে উন্মাদনা আগের চেয়ে কমেছে। তার উপর দলে জেলা জুড়ে এখন শেষ কথা ‘কেষ্ট’। সেটা শতাব্দীর জন্য আশীর্বাদ না অভিশাপ, বলা যাচ্ছে না। পোস্টারে মমতা-শতাব্দী-অনুব্রতর হাসিমুখ যতই পাশাপাশি থাকুক, শতাব্দীর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত যাঁরা, তাঁরা কেউই আবার অনুব্রতপন্থী বলে পরিচিত নন। বীরভূম জুড়ে তাই লু-এর সঙ্গে বইছে অন্তর্দ্বন্দ্বের চোরা স্রোত। আদি আর নব্যের সংঘাত, নেতৃত্বের নেকনজরে থাকার প্রতিযোগিতা, শিবির বদল সবই বর্তমান। বিশেষত সিউড়ি, মুরারই, খয়রাশোলে এগুলো বড় ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারে বলে স্বীকার করছেন দলের একাংশই।

এই সব জটিলতা আর কাটাকুটির অঙ্কে কি ‘সারপ্রাইজ ভিকট্রি’ ছিনিয়ে নেবেন সিপিএমের কামরে ইলাহি? নানা মহলে সে রকম একটা গুঞ্জনও কিন্তু আছে। প্রাক্তন বিধায়ক ইলাহি সাহেব ডাক্তার মানুষ। বিভিন্ন সরকারি পদে ছিলেন। এখন মুরারইয়ে নার্সিং হোম খুলেছেন। বীরভূম জুড়ে

বিস্তৃত তাঁর রোগীদের নেটওয়র্ক। প্রচারে গিয়েও রোগী দেখা চালিয়ে যাচ্ছেন কামরে। চুপচাপ প্রচার, জাঁকজমক কম। কিন্তু প্রভাবে আদৌ ফেলনা নয়। “হিসেবনিকেশের বাইরে গিয়ে ফল হবে”, মৃদু অথচ দৃঢ় শোনায় ইলাহির গলা।

বীরভূমে সব হিসেবনিকেশের নিয়ন্তা যিনি, সেই অনুব্রত মণ্ডল কি বলবেন কিছু? দলের কর্মীদের কাছে তিনি এখন ‘বীরভূমের অধীর চৌধুরী’। ফোনে কলারটিউন বাজছে, ‘ইতনি শক্তি হমে দেনা দাতা...।’ শতাব্দীর মার্জিন কত হবে? উত্তর আসে, “ও সব কিছু বলতে পারব না। ১৬ মে ব্যালট বাক্সে দেখে নেবেন।”

birbhum joy bandopadhay jagori bandopadhay
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy