ফাইল ছবি
লাভ-লোকসান ওই নোনা জলেই।
বিঘার পর বিঘা চাষজমিকে রাতারাতি মেছোভেড়িতে বদলে দেওয়ার ওটাই মোক্ষম অস্ত্র। চাষবাসের ভবিষ্যৎ না ভেবে, পরিবেশের তোয়াক্কা না করে এই পথেই ভেড়ি গজিয়ে উঠেছে কলকাতা সংলগ্ন কিছু জেলায়। চলছে কোটি কোটি টাকার বেআইনি কারবার। দলাদলিতে ঝরছে রক্ত।
কলকাতা লাগোয়া দুই ২৪ পরগনা এবং পূর্ব মেদিনীপুরের একটা বড় অংশে ভেড়িই অর্থনীতির মেরুদণ্ড। বহু মানুষ এর সঙ্গে জড়িত। তবে সেই বাম আমল থেকেই জমি জবরদখল করে পরের পর ভেড়ি তৈরির অভিযোগ উঠতে শুরু করে। পালাবদলের পরে সেই প্রবণতা বেড়েছে বই কমেনি। নিয়মমতো কোনও ভাবেই চাষজমির চরিত্র পাল্টে মেছোভেড়ি করা যায় না। তা-ও অবৈধ ভেড়ির বাড়বাড়ন্ত। কখনও অনিচ্ছুক কৃষকের জমিতে নোনা জল ঢুকিয়ে চাষের দফারফা করে বাধ্য করা হচ্ছে ভেড়ি করতে, কখনও নদীর বাঁধ কেটে দু’-তিন ফসলি জমিতে নোনা জল ঢোকানো হচ্ছে। সুন্দরবনে ম্যানগ্রোভ ধ্বংস করেও বাড়ছে ভেড়ি।
অভিযোগ, সর্বত্রই শাসক দলের নেতাদের প্রত্যক্ষ যোগসাজশে ভেড়ির এই রমরমা। পূর্ব মেদিনীপুরের ভগবানপুরে ২০১৮ সালে তৃণমূল নেতা নান্টু প্রধানকে তো জোর করে ভেড়ি নিয়ে জনরোষেই মরতে হয়েছিল। সাময়িক আলোড়ন, ধরপাকড় থিতোতেই ভেড়ি-কারবার ফিরেছে পুরনো চেহারায়। ভগবানপুর, কোলাঘাট, পাঁশকুড়ার পাশাপাশি পটাশপুরে-২ ব্লক ও এগরায় ভেড়ি বাড়ছে। বছর ছ’-সাত হল নন্দীগ্রামেও ভেড়ি হয়েছে। ‘‘জেলায় প্রচুর বেআইনি ভেড়ি রয়েছে’’, মানছেন পূর্ব মেদিনীপুরের অতিরিক্ত জেলাশাসক (ভূমি) অনির্বাণ কোলে। সঙ্গে দাবি, ‘‘লাগাতার অভিযান চলছে।’’ তবে তাতে লাভ হচ্ছে কই! তমলুক মহকুমা মাছের ঝিল বিরোধী কৃষক সংগ্রাম কমিটির উপদেষ্টা নারায়ণচন্দ্র নায়ক বলছেন, ‘‘ক্ষুদ্র চাষিরা ভেড়ির জন্য জমি দিতে চান না। তাও প্রলোভন এবং ভয় দেখিয়ে তাঁদের জমি দিতে বাধ্য করা হয়। লাগাতার রাসায়নিক প্রয়োগ করতে করতে কয়েক বছর পরে অবস্থা শোচনীয় হবে। তখন না ফলবে ফসল, না হবে মাছ।’’
উত্তর ২৪ পরগনার হাড়োয়া, মিনাখাঁ, সন্দেশখালির বিভিন্ন জায়গায় খাসজমি দখল করেও ভেড়ি হচ্ছে বলে অভিযোগ শাসকদলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। খুন-জখমও লেগে রয়েছে। মেছোভেড়ি নিয়ে গোলমালে বাম আমল থেকে এই সব এলাকায় অন্তত ৫০ জন খুন হয়েছেন। বসিরহাট মহকুমায় ভেড়ির দখল নিয়ে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে গত বছর খুন হন দু’জন। খুনে অভিযুক্তেরা গ্রেফতার হলেও অবৈধ ভেড়ির ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ হয় না বলেই অভিযোগ।
ভেড়ি-চক্রের শাখা-প্রশাখা শাসকদলের মাথা পর্যন্ত ছড়িয়ে। তাই নাকি পুলিশ-প্রশাসন, সব জেনেও চুপ। রীতিমতো ভেড়ি-সিন্ডিকেট গড়েই চলে কারবার। আর নেতাদের মুখে গরিব মানুষের স্বার্থের বুলি। হাড়োয়ার বিধায়ক হাজি নুরুল ইসলাম বলছিলেন, ‘‘ভেড়ি থেকে আয় হয় গরিব মানুষের। গ্রাম সভাপতি, বুথ সভাপতি এবং গ্রামের মানুষের উপস্থিতিতেই নিলাম-সহ ভেড়ির সব কাজ হয়। তাঁদের কেউ বঞ্চিত করলে সহ্য করা হবে না।’’ তবে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় শাসনে তৃণমূলের এক নেতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, মনে করালেন বিধায়ক।
উত্তর ২৪ পরগনায় কামদুনির বড় বিল অন্যতম উল্লেখযোগ্য ভেড়ি। গ্রাম কমিটির মাধ্যমে প্রতিবছর ভেড়ি লিজ় দেওয়া হয়। শাসনে যেমন ভেড়ি লিজ় দেওয়ার আগে মাইকে প্রচার চলে। ভেড়ির ‘ডাক’ (নিলাম) হয়। বছরে তিন বার টাকা শোধের সুযোগ মেলে। আর গ্রাম কমিটির মাথায় থাকেন তৃণমূলের অঞ্চল থেকে ব্লক সভাপতিরা। যার হাতে যত ভেড়ি, তার তত দাপট।
মুনাফাও বিস্তর। এক বিঘা জমি লিজ় দিয়ে ভ্যানামেই চাষে নাকি খরচ হয় ৮ লক্ষ টাকা। ঠিকমতো মাছ উঠলে দ্বিগুণ লাভ নিশ্চিত। সব মিলিয়ে বহু কোটির লভ্যাংশ ছড়িয়ে যায় স্তরে স্তরে। শাসনের সিপিএম নেতা কুতুবউদ্দিন আহমেদের অভিযোগ, ‘‘ভেড়ির নিলামে জমির মালিকেরাও প্রাপ্যটুকু পান না। ব্যবসায় ক্ষতির দোহাই দিয়ে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়।’’ অভিযোগ, এলাকায় বেআইনি অস্ত্র ঢোকা, অশান্তির পিছনেও ওই টাকাই। আইনশৃঙ্খলার স্বার্থে বারাসত থানা ভেঙে শাসন থানা হয়েছে। তবে ভেড়ি দখল নিয়ে খুনোখুনি, বোমাবাজি থামেনি। প্রতিবাদীকে মাসুল গুনতে হয়। কোলাঘাটে তো ভেড়ি বিরোধী আন্দোলনের এক নেতার হোসিয়ারি কারখানায় আগুনও দেওয়া হয়েছিল।
বেহাল নিকাশি, বন্যার শঙ্কা, বিপন্ন পরিবেশ— ভেড়ির শত বিপদ। তবু দক্ষিণ ২৪ পরগনায় বিভিন্ন নদীর চর থেকে ম্যানগ্রোভ কেটে ভেড়ি হচ্ছে। বাসন্তী, গোসাবা, ক্যানিংয়ে স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের মদতেই ম্যানগ্রোভ নিধন চলছে বলে অভিযোগ। বাসন্তীতে বেআইনি ভেড়ি তৈরি নিয়ে তৃণমূলের দুই গোষ্ঠীর বিবাদে কয়েক মাস আগেই এক জনের মৃত্যুও হয়েছে।
পুলিশের দাবি, নজরদারি চলে। অভিযোগ পেলে ধরপাকড়ও হয়। কালাম পৈলান নামে বাসন্তীর এক বাসিন্দা জনস্বার্থ মামলাও করেছিলেন। কমিটি গড়ে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিল হাই কোর্ট। তাতেও বিশেষ সুরাহা হয়নি। ভেড়ি আছে স্বমহিমাতেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy