পৌনে ৭টা নাগাদ আড্ডা ছেড়ে শৌচালয়ে যান সুব্রত। ফিরে আসেন মিনিট দশেক পর। তারপরই ছবিটা বদলে যেতে থাকে। ফাইল চিত্র।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা নাগাদ স্তব্ধ হয়ে গেল মনিটর। এসএসকেএমের উডবার্ন ওয়ার্ডের ১০২ নম্বর কেবিনে।
কিছু ক্ষণ আগেও বলছিলেন তাঁর চপ-মুড়ি খেতে ইচ্ছে করছে। এমনকি, হাসতে হাসতে চাউমিন খাওয়ার ইচ্ছের কথাও জানিয়েছিলেন একবার। তখন সন্ধ্যা সম্ভবত সাড়ে ৬টা। ‘সম্ভবত’, কারণ সময়টা শুক্রবার সকালেও ঠিক খেয়াল পড়ছিল না সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের আইনজীবী মণিশঙ্কর চট্টোপাধ্যায়ের। ঘটনার দ্রুত এবং আকস্মিক অভিঘাতে তিনি তখনও খানিক বিহ্বল।
মণিশঙ্কর আনন্দবাজার অনলাইনকে জানিয়েছেন, হাসপাতালের কেবিনে তখন রীতিমতো সুস্থ দেখাচ্ছিল মন্ত্রীকে। সুব্রতের সামনেই ছিলেন স্ত্রী ছন্দবাণী মুখোপাধ্যায়। একদিন পরেই শুক্রবার প্রবীণ রাজনীতিকের হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার কথা। সে সব নিয়েই সাত-পাঁচ গল্প হচ্ছিল। বাড়ি ফিরে কী কী করতে চান, তারই তালিকা শোনাচ্ছিলেন সুব্রত।
সন্ধ্যা পৌনে ৭টা নাগাদ আড্ডা ছেড়ে শৌচালয়ে যান সুব্রত। ফিরে আসেন মিনিট দশেক পর। তার পর থেকেই একটু একটু করে সুব্রতের কিছুক্ষণ আগের হালকা মেজাজের ছবিটা বদলে যেতে থাকে।
শুক্রবার দুপুরে মণিশঙ্কর বলেছিলেন, ‘‘প্রথমে দাদা জানান, তাঁর শরীরে একটা অস্বস্তি হচ্ছে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই বুকে ব্যথা অনুভব করেন। মুহূর্তের মধ্যে হাসপাতালের বেডে বসে ঢলে পড়েন। ততক্ষণে বৌদি (ছন্দবাণী) বিপদ বুঝে চিৎকার করতে শুরু করেছেন— ডাক্তার ডেকে আন! ডাক্তার ডেকে আন! আমি দৌড়ে রিসেপশনে যাই। দাদার বুকে ব্যথার কথা জানাতেই জুনিয়র ডাক্তার আর নার্সরা ছুটে চলে আসেন। ঘরে এসে বুকে পাম্প করতেও শুরু করেন তাঁরা।’’
কিন্তু তারপর আর সুব্রতের শরীরে তেমন কোনও প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। মণিশঙ্করের কথায়, ‘‘একবার মনিটরে সামান্য সাড়া পাওয়া গিয়েছিল। বুকে পাম্প করার সময় দাদা একবার হাতও তুলেছিলেন। সেটাও দেখলাম। কিন্তু সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে আর দাদার কোনও সাড়া পাওয়া যায়নি। মনিটরও স্তব্ধ! যে সবুজ রেখাটা ওঠানামা করে, সেটা একেবারে স্থির হয়ে গেল!’’
৩০ থেকে ৪০ মিনিট ধরে বুকে ‘পাম্প’ করা হয় সুব্রতের। যেমনটা আপৎকালীন পরিস্থিতিতে করে থাকেন চিকিৎসকেরা। একটা সময়ে সুব্রতের দাঁতে দাঁত লেগে যায়। কিন্তু চিকিৎসকেরা হাল না ছেড়ে মুখে নল ঢুকিয়ে বুকে ‘পাম্প’ করতে থাকেন।কিন্তু চিকিৎসকদের কোনও চেষ্টাই সফল হয়নি। মণিশঙ্কর জানাচ্ছেন, সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার কিছু আগে হাসপাতালের অধিকর্তা দৌড়ে আসেন সুব্রতের কেবিনে। কিন্তু রোগীর অবস্থা দেখে তিনি কেবিনের বাইরে গিয়ে বসে পড়েন।
তার পরেই সুব্রতকে দ্রত নিয়ে যাওয়া হয় উডবার্নের কার্ডিওলজি বিভাগের আইসিইউ-য়ে। তার মধ্যেই যোগাযোগ করা হয় মেডিক্যাল বোর্ডের সঙ্গে। যোগাযোগ করা হয় হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ সরোজ মণ্ডলের সঙ্গেও। তাঁরাও দ্রুত সেখানে চলে আসেন। আইসিইউ-তে মেডিক্যাল বোর্ডের পাঁচ সদস্যের তত্ত্বাবধানে সুব্রতকে বাঁচানোর সব রকম চেষ্টা করা হয়। তার মধ্যে ওষুধ, ইঞ্জেকশন তো ছিলই, শরীরের বাইরে থেকে সাময়িক ‘সাপোর্ট’ পেসমেকার বসানোরও চেষ্টা করা হয়। দেওয়া হয় ভেন্টিলেশনেও।
কিন্তু কিছুই কাজে আসেনি। ততক্ষণে হাসপাতালে পৌঁছেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শেষপর্যন্ত তিনিই দীর্ঘদিনের সহকর্মী সুব্রতের মৃত্যুসংবাদ জানান সকলকে। দৃশ্যতই বিধ্বস্ত মমতা জানান, রাত ৯টা ২২ মিনিটে সুব্রত শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেছেন।
অথচ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ-হওয়া মন্ত্রীর সিটি স্ক্যানের রিপোর্টেও কোনও ‘গোলমাল’ ছিল না। সুব্রত নিজেও যে সুস্থ বোধ করছিলেন, তা গত কয়েকদিনের কথাবার্তায় বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর আইনজীবী মণিশঙ্কর। সুব্রতর বিরুদ্ধে চলতে থাকা নারদ মামলার শুনানি ছিল আগামী ১৬ নভেম্বর। সুব্রত চেয়েছিলেন, যে করে হোক, আদালতে পৌছবেন। মামলা লড়ে যাবেন। হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘‘শেষটা দেখতে চাই। কী হবে? ফাঁসি দেবে? তা হলে তা-ই দিক! আমি শেষটা দেখতে চাই।’’
এতটাই আগ্রহী ছিলেন মামলার বিষয়ে যে, হৃদযন্ত্রে স্টেন্ট বসানোর পরও শুনানি পিছোতে আইনজীবীকে নিষেধ করেছিলেন সুব্রত। মণিশঙ্করকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, আদালতকে যেন সেই মর্মে কোনও চিঠি না দেওয়া হয়। নিশ্চিত ছিলেন, তিনি নিজে আদালতে যেতে পারবেন। এর পর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আচমকা কী করে অসুস্থ হয়ে পড়লেন এবং একেবারে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন, তা বুঝতে পারছেন না মণিশঙ্কর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy