Advertisement
E-Paper

অভিষেক-বৈঠকের অপেক্ষা না করেই কল্যাণের ইস্তফা গৃহীত! মহুয়া-কাঁটাই কারণ, কাকলি ও শতাব্দীর নিয়োগেও বার্তা স্পষ্ট

সোমবারের পর মঙ্গলবারেও দলীয় সতীর্থ মহুয়া মৈত্রকে নিশানা করেছেন কল্যাণ। মহুয়াকে বিঁধে লেখেন, “আজ উনি আমায় নারীবিদ্বেষী বলে ওঁকে সমর্থন করার প্রতিদান দিলেন। যাঁর ন্যূনতম কৃতজ্ঞতাবোধ নেই, তাঁকে সমর্থন করার জন্য আমি দেশের কাছে ক্ষমা চাইছি।”

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৫ অগস্ট ২০২৫ ১৫:৩১
(বাঁ দিক থেকে) কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মহুয়া মৈত্র।

(বাঁ দিক থেকে) কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মহুয়া মৈত্র। —ফাইল চিত্র।

কথা ছিল, বৃহস্পতিবার দিল্লি পৌঁছে তাঁর সঙ্গে কথা বলবেন লোকসভায় তৃণমূলের নবনিযুক্ত নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু তার অনেক আগেই মঙ্গলবার কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইস্তফা গ্রহণ করে নিলেন তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কল্যাণ সোমবার যে পদে ইস্তফা দিয়েছিলেন, লোকসভার সেই মুখ্য সচেতক পদে নিয়োগ করা হয়েছে কাকলি ঘোষ দস্তিদারকে। লোকসভায় দলের উপ দলনেতা নিযুক্ত করা হয়েছে শতাব্দী রায়কে। মঙ্গলবার তৃণমূল জানিয়েছে, কল্যাণের ইস্তফা গ্রহণ করে ওই পদে তাঁর অবদানের জন্য শ্রীরামপুরের সাংসদকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন দলনেত্রী মমতা।

তৃণমূলের ওই ঘোষণার পর থেকেই যে জল্পনা শুরু হয়েছে— এত দ্রুত কেন কল্যাণের ইস্তফা গৃহীত হল? বিশেষত, যখন সোমবার তাঁকে ফোন করে অভিষেক কথা বলতে চেয়েছিলেন? দ্বিতীয়ত, কল্যাণের পদে কাকলিকে নিয়োগ করে এবং পাশাপাশিই শতাব্দীকে উপ দলনেতা নিয়োগ করে তৃণমূল শীর্ষনেতৃত্ব কি কল্যাণকেই ‘বার্তা’ দিতে চাইলেন?

সম্ভাব্য জবাব হিসাবে যে তথ্যাদি সামনে আসছে, তার নির্যাস— মূলত মহুয়া-কাঁটায় বিদ্ধ হয়েছেন শ্রীরামপুরের সাংসদ। তার সঙ্গেই যোগ হয়েছে দলের মহিলা সাংসদদের একাংশের তাঁর ‘ব্যবহার’ সম্পর্কে অভিযোগ-অনুযোগ। এর আগে প্রকাশ্যে মহুয়া ছাড়া কেউই মুখ খোলেননি। কিন্তু একাধিক মহিলা সাংসদ দলের শীর্ষনেতৃত্বকে কল্যাণের ‘ভাষা প্রয়োগ’ এবং প্রকাশ্যে ‘অপশব্দ ব্যবহার’ নিয়ে অভিযোগ জানিয়েছিলেন বলে গত বেশ কয়েক মাস ধরে খবর পাওয়া যাচ্ছিল। সোমবার তার সঙ্গে যোগ হয় মহুয়া সম্পর্কে আবার প্রকাশ্যে পোস্ট, লোকসভায় কোন কোন সাংসদ আসেন, কারা নিয়মিত আসেন না, সে বিষয়ে তাঁর প্রকাশ্য আক্রমণ এবং সরাসরি বলা যে, দলনেত্রী মমতা সাংসদদের ভার্চুয়াল বৈঠকে ‘অসত্য’ বলেছেন। তদুপরি মুখ্য সচেতক পদে তাঁর ইস্তফা।

 Pramiti Banerjee daughter of tmc mp Kalyan Banerjee

কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আইনজীবী কন্যা প্রমিতি বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।

তবে তার পরেও কল্যাণের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার একটা পরিসর খোলা রাখা হয়েছিল। কিন্তু তা বন্ধ হয়ে যায় মঙ্গলবার সকালে কল্যাণ সমাজমাধ্যমে মহুয়াকে নিয়ে আরও একটি ভিডিয়ো পোস্ট করায়। ২০২৩ সালের ওই ভিডিয়োয় দেখা যাচ্ছে, লোকসভার প্রশ্ন-ঘুষকাণ্ডে মহুয়াকে সংসদ থেকে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বক্তৃতা করছেন কল্যাণ। পাশের আসনেই বসে আছেন মহুয়া। ৮ মিনিট ৫৮ সেকেন্ডের ভিডিয়োয় দেখা যাচ্ছে, মহুয়াকে লোকসভা থেকে বহিষ্কার করার প্রস্তাবকারী ‘এথিক্স কমিটি’ কেন মহুয়ার বক্তব্য না-শুনেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন কল্যাণ। পাশে বসে সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ছেন মহুয়া। ওই ভিডিয়োটি পোস্ট করে কল্যাণ বিঁধে লেখেন, “আজ উনি আমায় নারীবিদ্বেষী বলে ওঁকে সমর্থন করার প্রতিদান দিলেন। যাঁর ন্যূনতম কৃতজ্ঞতাবোধ নেই, তাঁকে সমর্থন করার জন্য আমি দেশের কাছে ক্ষমা চাইছি।” তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, কল্যাণ ওই পোস্টে ‘ট্যাগ’ করেছেন বিজেপি-কেও।

তৃণমূল সূত্রের খবর, জল তার পরেই দ্রুত গড়াতে শুরু করে। প্রসঙ্গত, কল্যাণের সোমবার এবং মঙ্গলবারের পোস্টের সমর্থনে সমাজমাধ্যমে নেমেছিলেন তাঁর আইনজীবী কন্যা প্রমিতি বন্দ্যোপাধ্যায়ও। সোমবার তিনি সমাজমাধ্যমে লিখেছিলেন, ‘‘মাত্র দু’টি মেয়াদের এক সাংসদের কাছ থেকে একজন চার দশকের অভিজ্ঞ রাজনীতিক, যাঁর রাজনীতি এবং আইনের জগতে অসামান্য অবদান আছে, কোনও শংসাপত্রের প্রয়োজন নেই। মহুয়া মৈত্র বিদ্বেষপূর্ণ এবং প্রতিহিংসাপরায়ণ মহিলা।’’ মহুয়ার সাম্প্রতিক একটি সাক্ষাৎকারের উল্লেখ করে সেই প্রসঙ্গেই প্রমিতি ওই বিশেষণগুলি ব্যবহার করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘‘শুধুমাত্র প্রমীলা ব্রিগেডের ধর্মযোদ্ধা বলেই কোনও মহিলার কোনও পুরুষের সম্পর্কে বিনা প্ররোচনায় এমন ভাষা ব্যবহারের অধিকার নেই। শ্রীমতী মৈত্র, আপনি যদিও তেমন কেউ নন। আপনি শুধু নজর কাড়ার জন্য ব্যস্ত।’’

মঙ্গলবার কল্যাণের পোস্টের প্রেক্ষিতে প্রমিতি আবার মহুয়ার উদ্দেশে লেখেন, ‘‘শ্রীমতী মহুয়া মৈত্র একজন সুযোগসন্ধানী এবং অকৃতজ্ঞ মানুষ!’’

সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে কল্যাণের প্রসঙ্গে প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে তাঁর নাম না-করে শূকরশাবকের সঙ্গে লড়াইয়ের পরিচিত উপমার উল্লেখ করেছিলেন মহুয়া। গত লোকসভা নির্বাচনে শ্রীরামপুরে কল্যাণের বিরুদ্ধে বামেদের প্রার্থী ছিলেন জেএনইউ-এর প্রাক্তনী দীপ্সিতা ধর। সেই সময়ে দীপ্সিতা সম্পর্কে কল্যাণের নানা মন্তব্যে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। সাক্ষাৎকারে কল্যাণের সেই আচরণ এবং মন্তব্য সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে মহুয়া বলেছিলেন, ‘‘শূকরশাবকের সঙ্গে কখনও লড়তে নেই। সে চাইবে লড়াই করতে। কিন্তু আপনি তার সঙ্গে যুদ্ধে নামলে নোংরাটা আপনার গায়েও লাগবে।’’ এর পরেই মহুয়া বলেছিলেন, ‘‘নারীবিদ্বেষী, হতাশাগ্রস্ত রাজনৈতিক নেতা সব দলেই রয়েছেন। সংসদেও তার প্রতিফলন রয়েছে।’’

মহুয়ার ওই সাক্ষাৎকারের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে কল্যাণ সোমবার লিখেছিলেন, “মানুষ দেখুক উনি কী কী শব্দ ব্যবহার করছেন। তার পর তাঁরাই বিচার করুন।” দীর্ঘ পোস্টে তিনি লিখেছিলেন, ‘‘সম্প্রতি মহুয়া মৈত্রের মন্তব্য শুনেছি। যেখানে তিনি সহ-সাংসদকে ‘শূকরশাবক’ বলেছেন। যা শুধু অবমাননাকর নয়, সাধারণ নাগরিক রীতির পরিপন্থী।’’

প্রসঙ্গত, সোম এবং মঙ্গলবার মহুয়া ওই বিষয়ে একটি মন্তব্যও করেননি। শুক্রবার তাঁর বিয়ের ‘রিসেপশন’ আছে দিল্লিতে। মহুয়ার ঘনিষ্ঠদের বক্তব্য, তিনি সেই প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত আছেন। তবে দলের তরফে কল্যাণকে যে বার্তা দেওয়া হয়েছে, তাতে তাঁর অখুশি হওয়ার কোনও কারণ রয়েছে বলে কৃষ্ণনগরের সাংসদের ঘনিষ্ঠেরা মনে করছেন না।

গত কয়েক মাস ধরেই মহুয়া-কল্যাণ খটাখটি চলছে। সাম্প্রতিক বাদল অধিবেশনের সময় তৃণমূলের বক্তা তালিকাতেও তার ছাপ পড়েছিল বলে সোমবার কল্যাণ নিজেই জানিয়েছেন। ‘অপারেশন সিঁদুর’ নিয়ে সংসদে আলোচনার প্রসঙ্গ তুলে কল্যাণ বলেছিলেন, ‘‘আমি দিদিকে জানিয়েছিলাম। দিদি মহুয়া মৈত্রের নাম বলেছিলেন। আমি তখন বলি, মহুয়া বললে আমি সংসদে থাকব না। তার পরে দিদিই সায়নী ঘোষের নাম বলেন।’’ তৃণমূলের অন্দরের অনেকের বক্তব্য, কল্যাণ যে ভাবে প্রকাশ্যে বলেছেন, তিনি দলনেত্রীকে জানিয়েছিলেন, মহুয়া বললে তিনি সংসদে থাকবেন না, তা ভাল ভাবে নেননি মমতা।

কয়েক মাস আগে জাতীয় নির্বাচন কমিশনের সামনে মহুয়া-কল্যাণের প্রকাশ্য বাদানুবাদ চরমে পৌঁছোয়। পরিস্থিতি এমন হয় যে, কল্যাণকে দেখিয়ে সেখানে কর্তব্যরত বিএসএফ, সিআইএসএফ জওয়ানদের উদ্দেশে মহুয়া বলেছিলেন, ‘‘ওঁকে অ্যারেস্ট করুন!’’ সেই ঘটনার পর কল্যাণের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন দমদমের প্রবীণ সাংসদ সৌগত রায়। তখন পাল্টা সৌগতকে ‘নারদার চোর’ বলেছিলেন কল্যাণ। তাঁর সঙ্গে যা ঘটেছিল, তা নিয়ে মহুয়া অভিযোগ জানিয়ে দলনেত্রী মমতাকে দীর্ঘ চিঠি লিখেছিলেন। পুরো বিষয়টি তিনি জানিয়েছিলেন অভিষেককেও। কিন্তু দু’জনের মধ্যে সম্পর্কের কোনও উন্নতি হয়নি। ঘটনাচক্রে, এত দিন দলের তরফেও কোনও উচ্চবাচ্য করা হয়নি। সোমবারেই প্রথম মমতা স্বয়ং লোকসভার সাংসদদের মধ্যে ‘সমন্বয়ের অভাব’ নিয়ে প্রকাশ্য বৈঠকে অনুযোগ প্রকাশ করেছিলেন। যার প্রেক্ষিতে মুখ্য সচেতকের পদ থেকে কল্যাণের ইস্তফা। অভিষেকের সঙ্গে বৈঠক পর্যন্ত আর অপেক্ষা না-করে যা গ্রহণ করে নিলেন মমতা।

Mahua Moitra TMC Kakali Ghosh Dastidar Shatabdi Roy
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy