Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

কোথাও অনাস্থা কোথাও ঝুলল তালা, দ্বন্দ্ব তৃণমূলে

শাসকদলের অন্তর্দ্বন্দ্বের তিন ছবি বাঁকুড়ায়। এক দিকে, দলের পরিচালিত জয়পুর পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতির বিরুদ্ধে অনাস্থা আনলেন তৃণমূলের সদস্যেরা। অন্য দিকে, কোতুলপুরে দলেরই বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর এক কর্মীকে মারধরের অভিযোগ উঠল ব্লক সভাপতির কিছু অনুগামীর বিরুদ্ধে।

আলোচনার পরেও খোলেনি পঞ্চায়েত অফিসের তালা। —নিজস্ব চিত্র

আলোচনার পরেও খোলেনি পঞ্চায়েত অফিসের তালা। —নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২৮ জুন ২০১৬ ০১:৪১
Share: Save:

শাসকদলের অন্তর্দ্বন্দ্বের তিন ছবি বাঁকুড়ায়। এক দিকে, দলের পরিচালিত জয়পুর পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতির বিরুদ্ধে অনাস্থা আনলেন তৃণমূলের সদস্যেরা। অন্য দিকে, কোতুলপুরে দলেরই বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর এক কর্মীকে মারধরের অভিযোগ উঠল ব্লক সভাপতির কিছু অনুগামীর বিরুদ্ধে। ইঁদপুরের ভেদুয়াশোল পঞ্চায়েতে দলেরই প্রধানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে পঞ্চায়েত অফিসে তালা ঝুলিয়ে দিলেন তৃণমূেলর এক সদস্যা-সহ কিছু বিক্ষুব্ধ কর্মী।

গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে রাশ টানতে চেষ্টার কসুর করছেন না তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব। কিন্তু, নিচুতলায় সেই বার্তা যে সব সময় মানা হচ্ছে না, এই ধরনের ঘটনাতেই তা স্পষ্ট। এক সময় জয়পুর ব্লকের যুব তৃণমূলের সভাপতি ছিলেন ইয়ামিন শেখ। পরে জয়পুর পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি হন। ফলে ব্লক যুব সভাপতির পদ থেকে ইয়ামিনকে সরিয়ে দায়িত্ব দেওয়া হয় বাবর আলি কোটালকে। তৃণমূল সূত্রের খবর, এর পর থেকেই দুই নেতায় মনোমালিন্য বাড়তে থাকে। কয়েক মাস আগে বাবর আলির উপরে হামলা চালানোরও অভিযোগ ওঠে ইয়ামিন-গোষ্ঠীর কর্মীদের বিরুদ্ধে। ওই ঘটনা থেকেই যুযুধান দুই নেতার মধ্যের তিক্ততা বাড়ে।

দল সূত্রে জানা যাচ্ছে, কিছু দিন হল ইয়ামিনকে পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতির পদ থেকে সরানোর তোড়জোড় শুরু করেন বাকি সদস্যেরা। এর পিছনে বাবর-গোষ্ঠীর হাত দেখছেন ইয়ামিনের অনুগামীরা। অবস্থা বেগতিক দেখে পঞ্চায়েতে আসা তাঁর অনিয়মিত হয়ে পড়ে বলে দাবি বাবর-শিবিরের। অবশেষে সোমবার দুপুরে ইয়ামিনের বিরুদ্ধে বিষ্ণুপুরের মহকুমাশাসকের কাছে অনাস্থার চিঠি জমা দিয়েছে সমিতির অধিকাংশ তৃণমূল সদস্য। ওই পঞ্চায়েত সমিতির মোট আসন ২৫। সব গুলিই তৃণমূলের দখলে। মহকুমাশাসক পার্থ আচার্য জানান, ২৫ জনের মধ্যে ২২ জন সই করেছেন এই অনাস্থাপত্রে। ফলে সরকারি নিয়ম মেনে ১৫ দিনের মধ্যেই সভা ডাকা হবে।

অনাস্থায় সই করা ওই পঞ্চায়েত সমিতির পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ রবিউল মিদ্যা এ দিন বলেন, ‘‘দলীয় কর্মীকে মারধরে নাম জড়ানোর পাশাপাশি এ বার বিধানসভা নির্বাচনে দলের প্রার্থীর হয়ে প্রচারে নামেননি ইয়ামিন শেখ। অফিসে আসাও বন্ধ করে দেন। ফলে পঞ্চায়েতের কাজে গতি আসছিল না। এই অবস্থায় বাধ্য হয়েই তাঁর বিরুদ্ধে অনাস্থা আনা হল।’’ যদিও অভিযোগ অস্বীকার করে ইয়ামিনের দাবি, ‘‘আমাকে সরানোর চক্রান্ত করা হচ্ছে। আমি জেলা নেতৃত্বকে বিস্তারিত জানিয়েছি।’’

দলেরই কোন্দলের জেরে কোতুলপুরে তৃণমূলের মদনমোহনপুর অঞ্চল কমিটির সভাপতি অশোক মণ্ডলকে মারধরের অভিযোগ উঠল কোতুলপুর ব্লক সভাপতি প্রবীর গরাইয়ের কিছু অনুগামীর বিরুদ্ধে। প্রহৃত কর্মী প্রবীর-বিরোধী হিসাবে পরিচিত, প্রাক্তন ব্লক সভাপতি নিমাই ঘোষের ঘনিষ্ঠ। অভিযোগ, রবিবার রাতে পার্টি অফিস থেকে অশোককে তুলে নিয়ে গিয়ে প্রবীরের লোকজন মারধর করে। প্রথমে স্থানীয় গোগড়া স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও পরে কলকাতায় চিকিৎসার জন্য তাঁকে পাঠানো হয়েছে। পুলিশে অভিযোগ হয়েছে। প্রবীরবাবু অবশ্য দাবি করেছেন, ‘‘এর মধ্যে রাজনীতি নেই। পারিবারিক ঝামেলায় অশোক মার খেয়েছেন। মিথ্যা রটনা করছেন প্রাক্তন ব্লক সভাপতির লোকজন। তা ছাড়া নিমাইবাবু আদৌ দলেই আছেন কিনা, আমার জানা নেই। উনি এ বার দলের প্রার্থীর হয়ে প্রচারেও নামেননি।’’ নিমাইবাবুকে এ দিন যোগাযোগ করা যায়নি। জেলা তৃণমূল সভাপতি অরূপ খাঁ বলেন, ‘‘বিষয়টি আমার জানা নেই। খোঁজ নিয়ে দেখব।’’

সোমবার ইঁদপুর ব্লকের ভেদুয়াশোল গ্রাম পঞ্চায়েতে দলের পঞ্চায়েত প্রধানের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও স্বজনপোষণের অভিযোগ তুলে পঞ্চায়েত অফিসে তালা ঝোলালেন তৃণমূলেরই একাংশ। প্রধানের অনুপস্থিতিতে এ দিন সকাল ১১টা থেকে তালা ঝুলিয়ে বিক্ষোভ শুরু হয়। দুপুর ৩টে নাগাদ ইঁদপুর থানার ওসি রাজীব পাল বাহিনী নিয়ে গিয়ে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে কথা বলেন। ব্লক প্রশাসনের এক আধিকারিকও ঘটনাস্থলে যান। কিন্তু তাঁরা বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে কথা বলেও তালা খোলাতে পারেননি। অন্যদিকে, তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন পঞ্চায়েত প্রধান মমতা বাউরি। এই ঘটনায় ফের শাসক দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে এল বলে মনে করছেন অনেকে।

ইঁদপুরে তৃণমূলের দু’টি শিবির রয়েছে। এক দিকে দলের বর্তমান ব্লক সভাপতি অসিত লায়েক। অন্যদিকে প্রাক্তন ব্লক সভাপতি প্রদীপ চক্রবর্তী। ভেদুয়াশোল পঞ্চায়েতের প্রধান মমতা বাউরি ব্লক সভাপতির অনুগামী বলেই দলের অন্দরে পরিচিত। তৃণমূল সূত্রের খবর, ১০০ দিন কাজের সুপারভাইজার নিয়োগ নিয়ে প্রাক্তন ব্লক সভাপতির অনুগামী এক পঞ্চায়েত সদস্যের সঙ্গে প্রধানের বিরোধ তৈরি হয়। কদমদেউলি গ্রাম সংসদ থেকে নির্বাচিত ওই তৃণমূল সদস্য কল্পনা টুডুই এ দিন বিক্ষোভের নেতৃত্বে ছিলেন। প্রায় ২০০ জন কর্মী সমর্থক ভেদুয়াশোল পঞ্চায়েত অফিসের সামনে জড়ো হন। প্রধান আসেননি শুনে তাঁরা কর্মীদের অফিস থেকে বের করে দিয়ে গেটে তালা ঝুলিয়ে দেন। কল্পনা টুডুর অভিযোগ, “১০০ দিন কাজের প্রকল্পে সুপারভাইজার নিয়োগ করার জন্য গ্রাম সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে এক জনের নাম প্রস্তাব করে প্রধানের কাছে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু প্রধান সেই প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে নিজের কাছের এক জনকে নিয়োগ করেন। ইন্দিরা আবাসের টাকাও সদস্যদের সুপারিশ অগ্রাহ্য করে নিজের পছন্দের লোকজনকে পাইয়ে দিয়েছেন।” তাঁর দাবি, এর প্রতিবাদ করতে এ দিন পঞ্চায়েতে গিয়েছিলেন। কিন্তু প্রধান না আসায় ক্ষুব্ধ কর্মীরা অফিসে তালা ঝুলিয়ে দেন। ভেদুয়াশোল অঞ্চল তৃণমূল নেতা সুদর্শন গোস্বামীরও অভিযোগ, “মমতা বাউরি প্রধান হলেও বকলমে পঞ্চায়েত চালান ওঁর স্বামী। কাজে দুর্নীতি হচ্ছে।”

যদিও দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করে মমতাদেবী বলেন, “পারিবারিক কাজে ব্যস্ত থাকায় এ দিন পঞ্চায়েতে যেতে পারিনি।” তাঁর দাবি, ‘‘সরকারি নিয়ম ও দলের নির্দেশ মেনে পঞ্চায়েতের কাজ স্বচ্ছ ভাবে করছি। কারও তাঁবেদারি করিনি বলেই স্থানীয় কিছু নেতা আমার বিরোধিতা করছেন। তাঁরাই এ দিন মিথ্যা অভিযোগ তুলে পঞ্চায়েতে গিয়ে এই কাণ্ড করেছেন। দুর্নীতির কোনও প্রমাণ দিতে পারলে আমি পদ ছেড়ে দেব।’’

এ দিন চেষ্টা করেও ইঁদপুর ব্লক তৃণমূল সভাপতি অসিত লায়েক ও প্রাক্তন ব্লক সভাপতি প্রদীপ চক্রবর্তীর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। তবে ব্লকের এক তৃণমূল নেতা বলেন, ‘‘এই ধরনের ঘটনায় আখেরে দলের ভাবমূর্তিই ক্ষুন্ন হচ্ছে। কিন্তু নেতৃত্ব কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

TMC inner conflict
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE