তিন বছরের মধ্যে বদলে গিয়েছিল অঙ্ক। ঘেঁটে গিয়েছিল হিসাব। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলের সঙ্গে ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের ফলাফলের তুলনা করলে দেখা যাচ্ছে, তৃণমূলের শিরঃপীড়ার কারণ রয়েছে।
ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন (এসআইআর) প্রক্রিয়ার দ্বিতীয় পর্ব চলাকালীন সেই হিসাব থেকে নানা আশঙ্কা করছেন শাসকদলের প্রথম সারির নেতৃত্বের অনেকে। আর সে কারণেই গোটা সংগঠনকে সতর্ক করে নির্দিষ্ট কৌশলে এই দফায় মাঠে নামাতে চাইছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই রূপরেখা দলের সামনে তুলে ধরতে আগামী রবিবার ভার্চুয়াল বৈঠক ডেকেছেন অভিষেক। তৃণমূল সূত্রে জানা গিয়েছে, বৈঠকে বুথস্তর থেকে রাজ্যস্তর— সব মিলিয়ে এক লক্ষ নেতাকর্মী যোগ দেবেন।
কোন অঙ্কে আশঙ্কা?
রাজ্যের উত্তর থেকে দক্ষিণ বিধানসভাওয়াড়ি হিসাব কষলে দেখা যাচ্ছে, ২০২১ সালে যে বিধানসভায় তৃণমূল বিপুল ভোটে জিতেছিল, তেমন অসংখ্য বিধানসভা কেন্দ্রে লোকসভা ভোটে ‘হোঁচট’ খেয়েছে। কোথাও ব্যবধান অর্ধেকের বেশি কমে গিয়েছে। কোথাও আবার জেতা আসনে পিছিয়ে পড়তে হয়েছে। ১০ হাজারের কম ব্যবধান রয়েছে, এমন আসনগুলিকে চিহ্নিত করে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করতে চাইছে তৃণমূল। এই ধরনের আসনকে নির্দিষ্ট কোনও বিন্যাসেও ফেলতে পারছে না শাসকদল। বিধানসভায় জেতা আসনে লোকসভা ভোটের সময়ে হয় ব্যবধান অর্ধেকের বেশি কমে গিয়েছে অথবা পিছিয়ে পড়েছে, এমন আসন গ্রাম-মফস্সল-শহর মিলিয়েই রয়েছে। ফলে সাংগঠনিক ওষুধ প্রয়োগের ক্ষেত্রে কোনও অভিন্ন ফর্মুলা তৈরি করতে পারছে না শাসকদল।
তালিকায় রথী-মহারথীরা
নামী মুখ থেকে বড় মন্ত্রীদের আসনেও ভোটে ধস নেমেছিল লোকসভা নির্বাচনে। যেমন কলকাতার রাসবিহারী আসনে দেবাশিস কুমার ২০২১ সালে জিতেছিলেন ২১ হাজার ভোটে। লোকসভায় সেই ব্যবধান নেমে হয়েছে এক হাজারেরও কম। বিধাননগরে মন্ত্রী সুজিত বসু জিতেছিলেন ৯ হাজার ভোটে। বারাসত লোকসভার অন্তর্গত এই বিধানসভায় ২০২৪-এর ভোটে তৃণমূল পিছিয়ে রয়েছে ১১ হাজারে। উত্তর কলকাতার শ্যামপুকুর রাজ্যের শিল্প, নারী ও শিশুকল্যাণমন্ত্রী শশী পাঁজার আসন। বিধানসভায় তাঁর জয়ের ব্যবধান ছিল ২২ হাজারের বেশি। লোকসভার নিরিখে শ্যামপুকুরে তৃণমূল এক হাজারের সামান্য কম ভোটে পিছিয়ে। আবার লাভলি মৈত্রের কেন্দ্র সোনারপুর দক্ষিণে তৃণমূলের বিধানসভায় জয়ের ব্যবধান ছিল ২৬ হাজার। লোকসভায় সেটা নেমে এসেছে ১০ হাজারে। মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেনের চন্দননগরে ২০২১ সালে তৃণমূল জিতেছিল ৩১ হাজার ভোটে। লোকসভায় সেই ফরাসডাঙাতেই ব্যবধান কমে দাঁড়িয়েছে সাত হাজার। গ্রামীণ এলাকা উত্তর ২৪ পরগনার সন্দেশখালিতে তৃণমূল বিধানসভা ভোটে জিতেছিল ৪০ হাজারে। লোকসভায় সেই ব্যবধান ঘুচিয়ে তৃণমূলকে পিছনে ফেলে প্রায় সাড়ে আট হাজার ভোটে এগিয়ে রয়েছে বিজেপি। এই রকম গুচ্ছ গুচ্ছ আসন রয়েছে সারা রাজ্য জুড়ে।
মিশন কমিশন
তৃণমূল মনে করছে, ভোটে বিজেপি-র বিরুদ্ধে লড়াইয়ের থেকেও নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে তাদের বেশি যুঝতে হবে। শাসকদলের এক প্রথম সারির নেতার আশঙ্কা, ‘‘বিজেপি-র যেখানে গণভিত্তি পোক্ত, সেখানে কমিশন কোনও ‘ভূমিকা’ নেবে না। তৃণমূলের যেখানে একচেটিয়া আধিপত্য রয়েছে, সেখানেও কমিশন বিশেষ কিছু করতে পারবে না। তবে যে যে আসনে দুই দলের ভোটশক্তি কাছাকাছি, সেখানে কলকাঠি নাড়তে পারে কমিশন।’’ তৃণমূল সূত্রের খবর, আগাম সেই আশঙ্কা করেই সাংগঠনিক স্তরে কৌশল নিতে চাইছে তৃণমূল। রবিবারের বৈঠকে সেই বার্তাই দেবেন অভিষেক। এসআইআর শুরুর আগে এবং এসআইআর চলাকালীন জোড়া ভার্চুয়াল বৈঠক করেছিলেন অভিষেক। জেলা ধরে ধরে ‘খামতি’ চিহ্নিত করে প্রথম দফায় শেষ ১৫ দিন ১৩ জন নেতাকে ব্যাগ গুছিয়ে জেলায় জেলায় চলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় দফায় আবার তেমন নজরদারির জন্য নেতাদের পাঠানোর পথে তিনি হাঁটলে অবাক হওয়ার মতো কিছু থাকবে না।
নজর গ্রামে
লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলে দেখা গিয়েছিল, রাজ্যের শহর এবং মফস্সলে (পুরনিগম এবং পুরসভা এলাকায়) তৃণমূল ‘ধাক্কা’ খেয়েছে। কিন্তু গ্রামের জনসমর্থন দিয়ে শহরকে ঘিরে ফেলতে পেরেছিল শাসকদল। ফলস্বরূপ এক ধাক্কায় পদ্মফুলকে ১৮ থেকে ১২-তে নামিয়ে দিয়েছিল জোড়াফুল। কিন্তু এসআইআরের দ্বিতীয় পর্বে সেই গ্রামীণ জনতাকে বিড়ম্বিত করা হচ্ছে বলে মনে করছে তৃণমূল। এ বিষয়ে শাসকদলের নিশানায় রয়েছে নির্বাচন কমিশন। এসআইআরের দ্বিতীয় পর্বে শুনানি শুরু শনিবার থেকে। তৃণমূলের বক্তব্য, গ্রামীণ এলাকায় এসডিও বা বিডিও অফিসে শুনানির স্থান নির্ধারিত করেছে কমিশন। কিন্তু শহর এলাকায় অনেক জায়গায় শুনানি হবে। অর্থাৎ, শহরের ভোটারেরা একাধিক জায়গায় শুনানিতে হাজির হতে পারবেন। ফলে তাঁদের হয়রানি কম হবে। পক্ষান্তরে, গ্রামীণ জনতাকে যেতে হবে হয় এসডিও অথবা বিডিও দফতরে। যা তাদের ‘হয়রানির কৌশল’ বলে মনে করছে তৃণমূল। সূত্রের খবর, দু’দিন আগে কমিশনে গিয়ে গ্রাম-শহরের ক্ষেত্রে পৃথক নিয়ম নিয়ে তৃণমূলের হয়ে সবচেয়ে বেশি সরব হন ব্যারাকপুরের সাংসদ পার্থ ভৌমিক। দ্বিতীয় দফায় সেই গ্রামীণ অংশে জোর দিতে চাইছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। যাতে শহরে ‘ক্ষত’ তৈরি হলেও তাতে গ্রামের ভোট দিয়ে প্রলেপ দেওয়া যায়।
সমান্তরাল কর্মসূচি
২০২১ সালের ভোটে বিজেপি সম্পর্কে ‘বাংলা-বিরোধী’ প্রচারকেই অস্ত্র করেছিল তৃণমূল। তুলে ধরেছিল বাংলা এবং বাঙালির গরিমার ভাষ্য। ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে সেই ধারা বজায় রেখেই কেন্দ্রের সরকার সম্পর্কে ‘বঞ্চনা’কে প্রচারের বর্শাফলক করেছিল জোড়াফুল শিবির। ২০২৬-এর ভোটে বাংলা এবং বাঙালি গরিমার সেই পরীক্ষিত পথ ছাড়ছে না তৃণমূল। তবে সমান্তরাল ভাবে ১৫ বছরের কাজের খতিয়ান তুলে ধরতেও বিশেষ কর্মসূচি নিতে চাইছে শাসকদল। ইতিমধ্যেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আনুষ্ঠানিক ভাবে ‘উন্নয়নের পাঁচালি’ প্রকাশ করেছেন। কী কী কাজ হয়েছে, আগামী ১০ বছর রাজ্যের শাসক হিসাবে তৃণমূলের অভিমুখ কী, সে বিষয়েও স্থানীয় স্তরে কর্মসূচি নিচ্ছে শাসকদল। শুক্রবার সেই সংক্রান্ত ভার্চুয়াল বৈঠক করবেন অভিষেক। অর্থাৎ, এক দিকে ভোটার তালিকায় নামরক্ষা এবং অন্য দিকে সরকারের কাজের খতিয়ান জনমানসে তুলে ধরতে প্রচার— সমান্তরাল ভাবে এই দুই কর্মসূচিকেই বাস্তবায়িত করার প্রয়াস শুরু করছে তৃণমূল।