বাংলায় ব্যালট-যুদ্ধের ময়দানে এ বার অস্ত্র বেকারত্ব।
তৃণমূল জমানায় রাজ্যে বেকারত্বের সমস্যা বহু গুণ বেড়েছে বলে আক্রমণ শানাতে শুরু করল বিজেপি। অভিযোগ তুলল, পশ্চিমবঙ্গে কাজের সুযোগ যথেষ্ট না-থাকায় রুজি-রুটির খোঁজে ভিন্ রাজ্যের পথে পা বাড়াতে বাধ্য হচ্ছেন বহু কর্মী। গত এক দশকে তাই অনেকখানি বেড়েছে এ রাজ্য থেকে যাওয়া পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা। পাল্টা আক্রমণে মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগ, হঠাৎ করে বিভিন্ন কেন্দ্রীয় প্রকল্প বন্ধ করে দিয়ে আসলে কর্মহীনের সংখ্যা বাড়াচ্ছে মোদী সরকারই। তার পরেও এই করোনা কালে রাজ্যে কাজের বাজারের ছবি দেশের বাকি অংশের তুলনায় ঢের ভাল বলে তাঁর দাবি।
সোমবার বিজেপির আইটি শাখার প্রধান তথা পশ্চিমবঙ্গের সহকারী দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা অমিত মালব্যের টুইট, “সরকারের মেয়াদ ফুরোনোর মুখে এসে এখন ৩৫ লক্ষ চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অথচ বাস্তব হল, যা চাকরি ছিল, তা-ও কেড়ে নিয়েছে দুর্নীতি এবং সিন্ডিকেট-রাজ। যুব সমাজের স্বপ্ন চুরমার করে দিয়েছে তৃণমূল।” তাঁর দাবি, সিএমআইই-র তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের অক্টোবরের মধ্যে এ রাজ্যে বেকারত্বের হার বেড়েছে ২১৭ শতাংশ। একই সঙ্গে তাঁর কটাক্ষ, “সিপিএমের ৩৪ বছরের অপশাসনের পরে ‘পিসির’ জমানায় আরও রসাতলে গিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি। তার প্রমাণ, লকডাউনের সময়ে এ রাজ্যে ফিরেছেন প্রায় ১০.৫ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক। অথচ ২০০১-১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, তার সংখ্যা ছিল ৫.৮ লক্ষ।” অর্থাৎ ইঙ্গিত, এ রাজ্যে বিনিয়োগ নেই। নতুন কল-কারখানা বাড়ন্ত। বাধ্য হয়েই চাকরির খোঁজে ভিন্ রাজ্যে যেতে হচ্ছে নতুন প্রজন্মের বড় অংশকে।
আরও পড়ুন: সৌগত-শুভেন্দুর ৯০ মিনিট বৈঠকে ম্যাচ অমীমাংসিত, রিপোর্ট নেবেন দিদি
বাঁকুড়ার খাতরায় মমতার জবাব, “আসলে বেকারত্বের সমস্যা বাড়াচ্ছে কেন্দ্র। তারা ছ’মাসের জন্য এক-একটা প্রকল্প চালু করে। সেই মেয়াদ শেষে তা বন্ধ হয়ে গেলে, তখন কাজ যায় লোকজনের।… এ দিনই বাঁকুড়ায় কিছু ছেলে-মেয়ে রাস্তায় আমাকে জানিয়েছেন, ২০১৫ সাল থেকে ‘সাক্ষর ভারত সেবক’ হিসেবে কাজ করছিলেন তাঁরা। কেন্দ্র প্রকল্প বন্ধ করায় সেই কাজ চলে গিয়েছে।” কেন্দ্রের মতো কোনও প্রকল্পে হঠাৎ তালা ঝুলিয়ে দিয়ে তাঁর সরকার যে কারও কাজ কাড়েনি তা-ও দাবি করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “এ রাজ্যে একটি প্রকল্প দেখান, যেখানে কারও চাকরি খেয়েছি। …বরং চুক্তিতে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের ৬০ বছর করে দিয়েছি।”
মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগ, কেন্দ্র পশ্চিমবঙ্গের প্রাপ্য করের ভাগ সময়ে দেয় না। ১০০ দিনের কাজের টাকাও আসে অনেক পরে। বিআরজিএফ প্রকল্পের টাকা হাতে না-আসায় সেখানে কাজ করা ছেলে-মেয়েরা চাকরি খুইয়েছেন। তৃণমূলের প্রশ্ন, বছরে ২ কোটি চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে দিল্লির মসনদ দখল করেছিলেন মোদী। অথচ তাঁর সময়ে দেশে বেকারত্বের হার সাড়ে চার দশকে সর্বোচ্চ! এর পরে কোন মুখে রাজ্যের বেকারত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলে বিজেপি? মমতার দাবি, “অনেক রাজ্যে সরকারি কর্মীদের বেতন ৩০ শতাংশ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।… বেসরকারি ক্ষেত্রের অবস্থা তথৈবচ।… ভারতে যখন করোনার সময়ে বেকারত্ব ৪০ শতাংশ বেড়েছে, তখন বাংলায় তা কমেছে ৪০ শতাংশ।” রাজ্যে ফেরা পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রসঙ্গে বলেছেন, “শুধু বাঁকুড়া জেলায় ৩২ হাজার পরিযায়ী শ্রমিককে কাজ দেওয়া হয়েছে। মুর্শিদাবাদে সব থেকে বেশি শ্রমিক ফিরেছেন। সব থেকে বেশি কাজ দেওয়া হয়েছে সেখানে।”
আরও পড়ুন: রাজ্যের ভোটে ৮০০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী, চর্চা নির্বাচন কমিশনে
বাংলার ভোট-যুদ্ধে যে শিল্প, লগ্নি এবং কাজের সুযোগের অভাব নিয়ে রাজনৈতিক তরজা হবে, তা প্রত্যাশিত। উপদেষ্টা সংস্থা সিএমআইই-র পরিসংখ্যানেও এ বিষয়ে মশলা মজুত দু’পক্ষের জন্য। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, অগস্ট থেকে অক্টোবরে রাজ্যে বেকারত্বের হার সারা দেশের তুলনায় বেশি। তেমনই আবার এই সময় বাদে বাকি বছরে বেকারত্বের সমস্যা এই রাজ্যে বরং তুলনায় কম ।
দিল্লি স্কুল অব ইকনমিক্সের অধ্যাপক দিব্যেন্দু মাইতির কথায়, “পশ্চিমবঙ্গে বড় বিনিয়োগ, শিল্প এবং সেই সূত্রে চাকরির সুযোগ যে বেশ কয়েকটি রাজ্যের তুলনায় কম, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু তা বলে শুধু সিএমআইই-র তথ্যের মাপকাঠিতে বেকারত্বের সমস্যা বোঝা শক্ত। কারণ, বাংলায় অনেকেই অফিস-কাছারিতে বসে কাজের বাইরে তেমন কিছু করতে চান না। বিশেষত কায়িক পরিশ্রম। নিজের ব্যবসা শুরুর প্রবণতাও এখানে তুলনায় কম। তাই বেকারত্ব কম মানেই যে অন্য রাজ্যে শুধু চাকরিই বেশি, এমনটা ভাবা অযৌক্তিক।”