প্রেসিডেন্সি সংশোধনাগারের ভিতরে পাঁচিলে ঘেরা বিস্তৃত বাগান। গাছে গাছে যত্নের ছাপ। দৈনিক মজুরিতে সেই বাগানেই কাজ পেয়েছেন তিনি। আদালত তাঁকে আজীবন কারাবাসের নির্দেশ দিয়েছে। বছর ঘুরে গিয়েছে। প্রেসিডেন্সির ৬ নম্বর সেল এখন তাঁর স্থায়ী ঠিকানা। জেলে তিনি বাগান পরিচর্যার কাজ করেন। দৈনিক মজুরি ৮০ টাকা।
তিনি আরজি কর হাসপাতালে ঢুকে কর্তব্যরত মহিলা চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় দোষী কলকাতা পুলিশের প্রাক্তন সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়।
শাস্তি পাওয়ার পরে জেলে সাড়ে ছ’মাস কাটিয়ে ফেলেছেন সঞ্জয়। তাঁর গতিবিধি সম্পর্কে ওয়াকিবহালেরা জানাচ্ছেন, প্রথম দিকে মনমরা হয়ে থাকতেন। কারও সঙ্গে তেমন কথা বলতেন না। সেলের বাইরেও বেরোতেন না। নিজের ভাবনায় ডুবে থাকতেন। তবে এখন কিছুটা সড়গড় হয়েছেন। অন্য কয়েদিদের সঙ্গে কথাও বলছেন টুকটাক। ক্যারম খেলছেন। সকাল-সন্ধ্যা বাগানে কাজ করতে যাচ্ছেন। দিনের বেশ খানিকটা সময় কাটাচ্ছেন টিভি দেখেও। ধীরে ধীরে জেলজীবনে অভ্যস্ত হতে শুরু করেছেন আরজি করের ধর্ষক-খুনি।
আরও পড়ুন:
জেলের একটি সূত্রের দাবি, সঞ্জয়ের তেমন কোনও ‘চাহিদা’ নেই। ফলে তাঁকে নিয়ে কর্তৃপক্ষের তেমন মাথাব্যথাও নেই। সাধারণ কোনও খাবার বা ছোটখাটো অন্য চাহিদা যতটা সম্ভব কর্তৃপক্ষের তরফেই মেটানো হচ্ছে। বাড়তি কিছু দাবি এখনও পর্যন্ত করেননি সঞ্জয়। তাঁর সঙ্গে জেলে তেমন কেউ দেখাও করতে আসেন না। এক বারও খোঁজ নিতে আসেননি পরিবার বা আত্মীয়দের কেউ। আজীবন কারাবাসের নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে সম্প্রতি কলকাতা হাই কোর্টে বেকসুর খালাসের আবেদন জানিয়েছেন সঞ্জয়। মামলা বিচারাধীন। মাঝেমধ্যে তাই আইনি পরামর্শের জন্য আসেন আইনজীবীরা। সঞ্জয় তাঁদের সঙ্গে কথা বলেন।
কলকাতা পুলিশের ৪ নম্বর ব্যাটেলিয়নের বি১৪কে ব্যারাকে বছরখানেক আগেও প্রায়ই যাওয়া-আসা করত সঞ্জয়ের নীল-কালো বাইক। সামনে বড় বড় হরফে লেখা থাকত ‘পুলিশ’। ব্যারাককেই একপ্রকার ‘ঘর’ বানিয়ে নিয়েছিলেন আদতে ৫৫/বি, শম্ভুনাথ পণ্ডিত স্ট্রিটের বাসিন্দা সিভিক ভলান্টিয়ার। কিন্তু গত এক বছরে ছবিটা আমূল বদলে গিয়েছে। প্রেসিডেন্সির গরাদ আর বাগানের চৌহদ্দির বাইরে তাঁর যাতায়াতের সুযোগ নেই। রাতের শহরে ‘পুলিশ’ লেখা বাইক নিয়ে চড়ে বেড়ানোর সুযোগ নেই। আপাতত জেলই তাঁর ভবিতব্য।
আরও পড়ুন:
সঞ্জয়ের সঙ্গে আরও কয়েক জন কয়েদি বাগান পরিচর্যার কাজ করছেন। প্রাথমিক ভাবে প্রথম তিন মাস কয়েদিদের পর্যবেক্ষণ করেন জেল কর্তৃপক্ষ। তার পর তাঁদের জন্য ‘উপযুক্ত’ কাজ বরাদ্দ করা হয়। সঞ্জয়ের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। পরে ‘কর্মদক্ষতা’ বিবেচনা করে তাঁকে অন্য কাজও দেওয়া হতে পারে। বাগানের পাশাপাশি জেলে নিজের সেল পরিচ্ছন্ন রাখাও সঞ্জয়ের অন্যতম দায়িত্ব। তবে দৈনিক কাজের জন্য অর্জিত অর্থ সঞ্জয় হাতে পাচ্ছেন না। মজুরি ঢুকছে তাঁর নির্দিষ্ট করে দেওয়া ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে।
রোজগারের সম্পূর্ণ টাকা সঞ্জয় এখন খরচও করতে পারবেন না। নিয়ম অনুযায়ী, মোট রোজগারের ৫০ শতাংশ জেলে থাকাকালীন নিজের বিবিধ প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারেন কয়েদিরা। বাকি টাকা প্রয়োজন হলে অনুমতিসাপেক্ষে তাঁদের পরিবারকে দেওয়া হয়। অথবা কারাদণ্ডের মেয়াদ শেষ হলে সম্পূর্ণ টাকা তুলে দেওয়া হয় ওই কয়েদির হাতে। সঞ্জয়ের ক্ষেত্রে মজুরির টাকা আপাতত তাঁর অ্যাকাউন্টেই থেকে যাচ্ছে। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত আসামি তিনি। জেল থেকে বেরোনোর প্রশ্ন এখনও পর্যন্ত নেই। এখনও পর্যন্ত যা পরিস্থিতি, তাতে তাঁর কারাবাসের মেয়াদ শেষ হবে তাঁর জীবন শেষের সঙ্গে সঙ্গে। ফলে তাঁর উপার্জিত অর্থ তাঁর হাতে আসবে, সে সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। পরিবারের সঙ্গেও তাঁর বনিবনা নেই। ফলে তাঁর অর্জিত অর্থ পরিজনেরা নিয়ে যাবেন, তেমন পরিস্থিতিও তৈরি হয়নি।
আরও পড়ুন:
জেলে মাঝেমধ্যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। তাতে সঞ্জয়ের খুব একটা উৎসাহ নেই। নিজের জন্য নির্দিষ্ট কাজ ছাড়া আনুষঙ্গিক কাজেও তাঁর বিশেষ আগ্রহ কারও চোখে পড়েনি। জেলের বাইরে তিনি যে জীবন যাপন করতেন, এক বছরে সে জীবনের চাকা ঘুরে গিয়েছে। সিভিক ভলান্টিয়ার হিসাবে তাঁর যতটা না ক্ষমতা ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল দাপট। নিয়মিত বক্সিং করতেন। কলকাতা পুলিশের ‘ওয়েলফেয়ার সেল’ থেকে বাইক আদায় করে নিয়েছিলেন। খাতায়কলমে অধিকার না থাকলেও ব্যারাকে থাকতে কেউ তাঁকে বাধা দেননি কখনও। আরজি কর থেকে এনআরএস কিংবা এসএসকেএম— শহরের প্রথম সারির সরকারি হাসপাতালগুলিতে অবাধে যাতায়াত করতেন। যাতায়াত ছিল যৌনপল্লিতেও। গত ৮ অগস্ট আরজি করের রাতের নিরাপত্তাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছিলেন সেই দাপটে ভর করেই। প্রেসিডেন্সির ৬ নম্বর সেলে গরাদের ওপারে সেই দাপট আর কোথায়!
দৈনিক মজুরিতে খেটে খেতে হচ্ছে। আর সকাল-সন্ধ্যা জেলের বাগানে ফুল ফোটাতে হচ্ছে। সঞ্জয় কি জানেন, সে ঘটনার পরে গোটা একটা বছর ঘুরে গিয়েছে?
(লেখা: অঙ্গীরা চন্দ। তথ্য: সারমিন বেগম। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ)