Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
Netaji Subhas Chandra Bose

নেতাজি কার! জন্মদিনে সুভাষ-পূজার ছলে রাজনৈতিক টানাটানি কেন? আড়ালে জটিল পার্টিগণিত

দিল্লিতে মোদী, কলকাতায় মমতা— দু’জনেই পালন করলেন নেতাজি জয়ন্তী। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কোথায় যেন রয়ে গেল রাজনৈতিক লড়াই। যা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে আরএসএস-এর কর্মসূচি।

ভোট রাজনীতির টানাটানিতে নেতাজি।

ভোট রাজনীতির টানাটানিতে নেতাজি। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

পিনাকপাণি ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ জানুয়ারি ২০২৩ ২০:০৮
Share: Save:

কলকাতা শ্যামবাজার মোড় চেনে নেতাজির মূর্তি দেখে। ঘোড়ায় চড়া নেতাজিকে দেখেই অনেকে বোঝেন ডাইনে যেতে হবে না বাঁয়ে। রাজনীতির ডান-বামের মধ্যেও আছেন নেতাজি।

নেতাজিকে নিয়ে রাজনীতি কম দিনের নয়। একটা সময় পর্যন্ত সুভাষচন্দ্র বসু ‘ব্রাত্য’ ছিলেন সিপিএমের চোখে। পরে লাইন বদলায় আলিমুদ্দিন স্ট্রিট। তবে বাম শরিক ফরওয়ার্ড ব্লক ‘দেবতা’-র চোখেই নেতাজিকে দেখে এসেছে বরাবর। স্বাধীনোত্তর ভারতে নেতাজিকে অসম্মান না করলেও জওহরলাল নেহরুকে এগিয়ে রেখেছে গান্ধী পরিবার শাসিত কংগ্রেস। তবে বাংলায় তৃণমূল বরাবরই নেতাজিকে মহাপুরুষের চোখেই দেখেছে। তৃণমূল গঠনের প্রথম থেকেই নেতাজির জন্মজয়ন্তী পালনের চল থেকেছে দলে। তবে নেতাজি পুজোর ক্ষেত্রে একেবারে নতুন গেরুয়া শিবির।

ভোটের রাজনীতিতেও এখন নেতাজি অন্যতম ‘হাতিয়ার’। সকলেই দাবি করতে চায়, তারাই নেতাজির ‘প্রকৃত উত্তরাধিকারী’। সেটা স্পষ্ট হল সোমবারও। ২০১৮ সালে আন্দামান সফরের সময় রস আইল্যান্ডের নামকরণ নেতাজির নামে করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। আর সোমবার আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের ২১টি বড় অনামী দ্বীপের নামকরণ করলেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। পরমবীরচক্র প্রাপকদের নামে সোমবার ওই ২১টি দ্বীপের নামকরণ করা হয়। এর পরেই বাংলার বিজেপি নেতারা বলতে শুরু করেন, ‘‘নেতাজিকে অতীতে কেউ এত সম্মান দেয়নি। বিজেপি নেতৃত্ব এবং নরেন্দ্র মোদীই সেটা শুরু করেছেন।’’

পিছিয়ে নেই তৃণমূলও। দলনেত্রী তথা বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সোমবার বলেন, ‘‘এখন অনেকে নাম দিচ্ছেন। কিন্তু ‘শহিদ’ এবং ‘স্বরাজ’ দ্বীপের নাম নেতাজিই দিয়েছিলেন। অন্য কেউ দেননি।” আবার তৃণমূলই যে নেতাজির সবচেয়ে বড় ভক্ত, সেই দাবি করতে গিয়ে দলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেন, ‘‘আমরাই তো নেতাজির পরিবারের দু’জনকে (কৃষ্ণা বসু এবং সুগত বসু) সাংসদ করেছি। অন্য কেউ করেনি।’’ সেই চেষ্টা যে বিজেপি করেনি তা নয়। নেতাজির পরিবারের সদস্য চন্দ্র বসুকে দলের সাংগঠনিক দায়িত্ব দেওয়া থেকে প্রার্থী করাও হয়েছিল। যদিও চন্দ্র-বিজেপি সম্পর্ক বেশি দিন স্থায়ী হয়নি।

নেতাজিকে নিজেদের শিবিরের করে তোলার উদ্যোগ অবশ্য বিজেপি আগেই দেখিয়েছে। অনেকেই মনে করেন, ভারতের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে জওহরলাল নেহরুর ভূমিকাকে খাটো করে দেখানোর জন্যই নেতাজিকে তুলে ধরার উদ্যোগ। একই কাজ বিজেপি সর্দার বল্লভ ভাই পটেলকে দিয়েও করেছে। তবে এটা মানতেই হবে যে, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে পটেলের যত ভূমিকাই থাকুক না কেন গোটা দেশে জনপ্রিয়তার ক্ষেত্রে এগিয়ে নেতাজি।

বিজেপির বিরুদ্ধে নেতাজিকে অসম্মানের অভিযোগ ওঠে যোজনা কমিশন ভেঙে মোদী নীতি আয়োগ গঠনের পরেই। ১৯৩৮ সালে কংগ্রেসের সভাপতি থাকার সময়ে নেতাজিই প্ল্যানিং কমিটি তৈরি করেন। চেয়ারম্যান করেন নেহরুকে। স্বাধীনতার পরে দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে নেতাজির তৈরি প্রতিষ্ঠান ‘প্ল্যানিং কমিশন’ (যোজনা কমিশন) চালিয়ে যান। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে সেই কমিশন ভেঙে দেন মোদী। ২০১৫ সালের ১ জানুয়ারি চালু হয় ‘নীতি আয়োগ’।

এর পরেও বিজেপি বুঝেছে, পটেলের বিশাল মূর্তি তৈরি করে গুজরাতে রাজনৈতিক সুবিধা মিললেও গোটা দেশে সেটা হবে না। সম্প্রতি দিল্লির ইন্ডিয়া গেটে নেতাজির মূর্তি বানানোয় সেই বোধেরই প্রকাশ। বাংলার ক্ষেত্রে তা আরও বেশি। ২০২১ সালের ২৩ জানুয়ারি ভোটমুখী বাংলায় বলা যেতে পারে প্রচারপর্বই শুরু হয়েছিল নেতাজি পূজার ছলে। যদিও প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীর শারীরিক উপস্থিতিতে সেই অনুষ্ঠান চলতে চলতেই নেতাজির থেকে বেশি আলোচ্য হয়ে ওঠেন শ্রীরাম। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বক্তৃতা শুরু করতে যাওয়া মাত্র বিজেপি কর্মীরা ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি তুলতে শুরু করেন। তা নিয়ে জলঘোলাও হয় বিস্তর।

এ বার আরও এক ধাপ এগিয়ে গেল আরএসএস। কলকাতায় এই প্রথম নেতাজির জন্মদিনে সঙ্ঘের কুচকাওয়াজ। উপস্থিত স্বয়ং সঙ্ঘপ্রধান মোহন ভাগবত। শহিদ মিনারের অনুষ্ঠানে ভাগবত বলেন, ‘‘নেতাজি যে উদ্দেশ্য নিয়ে স্বাধীনতার লড়াইয়ে নেমেছিলেন, এখন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘও সেই একই উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করে চলেছে।’’ ভাগবতের এই বক্তব্য নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্কও হয়েছে। যদিও সঙ্ঘ দাবি করে থাকে, নেতাজির সঙ্গে সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠাতা কেশব বলিরাম হেডগেওয়ারের সুসম্পর্ক ছিল। দেখা হয়েছিল দু’বার। প্রথম সাক্ষাৎ ১৯২১ সালে কলকাতায় কংগ্রেসের অধিবেশনে। তখন হেডগেওয়ার বিদর্ভ কংগ্রেসের সচিব ছিলেন। আর দ্বিতীয় বার ১৯৪০ সালের জুন মাসে নাগপুরে। সম্প্রতি সঙ্ঘ এক প্রেস বিবৃতিতে দাবি করেছে, ‘অনেক ঐতিহাসিকের মতে নেতাজি, ডাক্তারজির (হেডগেওয়ার) সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন আজাদ হিন্দ বাহিনীর সঙ্গে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সংযুক্তির অভিপ্রায় নিয়ে। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে সেই সময় ডাক্তারজি গুরুতর অসুস্থ ছিলেন এবং এমত অবস্থায় ডাক্তারজির সঙ্গে নেতাজির খুব অল্পই সাক্ষাৎ হয়। সেই সপ্তাহেই ডাক্তারজির তিরোধান ঘটে।’

আরএসএস সাধারণ ভাবে ব্যক্তিপূজায় বিশ্বাসী নয় বলেই দাবি করে থাকে। যে ছ’টি উৎসব আরএসএস পালন করে সেগুলি মূলত হিন্দু ক্যালেন্ডার মেনে। ঐতিহাসিক গুরুত্বের থেকে যা বেশি করে ‘তিথি’ (বর্ষ প্রতিপদা, মকর সংক্রান্তি, হিন্দু সাম্রাজ্য দিবস, গুরুপূর্ণিমা, রাখিপূর্ণিমা এবং বিজয়া দশমী)। এর বাইরে বিশেষ অনুষ্ঠান হয় না। কিন্তু এ বার অন্য রকম। কলকাতায় ভাগবত যখন ‘নেতাজি লহ প্রণাম’ অনুষ্ঠানে, তখন সঙ্ঘে পদাধিকারী হিসাবে তাঁর পরেই যাঁর স্থান সেই সরকার্যবাহ দত্তাত্রেয় হোসবলে মণিপুরের মৈরাঙে একটি নেতাজি জয়ন্তী অনুষ্ঠানে যোগ দেন।

তবে কি গেরুয়া শিবির এ বার নতুন করে নেতাজির মূল্যায়ন শুরু করল? ২০২৪ সালে লোকসভা নির্বাচন। ২০২৫ সালে সঙ্ঘের শতবর্ষ। ঠিক তার আগে আগে হিন্দুত্বের পাশাপাশি নেতাজি আবেগকেও কি হাতিয়ার করতে চাইছে গেরুয়া শিবির?

সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা শুরু হয়েছে। তবে এটাও অনেকে বলছেন, ইদানীং রাজনৈতিক দলগুলি আর দেশের অর্থনীতি, বিদেশনীতি নিয়ে সে ভাবে চিন্তা করে না। পরস্পরের নীতি নিয়ে সমালোচনাও সে ভাবে নেই। অর্থনীতি মানে মূলত সাধারণ মানুষকে টাকা ও অন্যান্য সুবিধা দেওয়ার বিভিন্ন প্রকল্পকে জনপ্রিয় করা। এই পরিস্থিতির কারণেই ব্যক্তিপূজা প্রাধান্য পাচ্ছে। বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা থেকে নেতাজির মূর্তি স্থাপন নিয়ে রাজনীতি বেশি হচ্ছে।

অর্থনীতিবিদ অভিরূপ সরকার যেমন বলছেন, ‘‘নেতাজির কিন্তু একটা অর্থনৈতিক বক্তব্যও রয়েছে। কিন্তু সে সব নিয়ে বিশেষ আলোচনার আগ্রহ নেই কারও মধ্যেই।’’ রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে অর্থনীতির মতো বিদেশনীতি নিয়ে আলোচনার তাগিদ না থাকাটাকেও ‘হতাশাজনক’ মনে করেন অভিরূপ। তবে রাজ্য বিজেপির সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের বক্তব্য, ‘‘বিশ্বের সর্বত্র অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে। করোনার পরে সেই পরিস্থিতিতেও মোদীজি ভারতের অর্থনীতির হাল ধরে রেখেছেন। বিদেশনীতি নিয়ে তো কারও সমালোচনা করারই নেই। কারণ, তিনি ভারতকে যে উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন, তা অতীতে কখনও হয়নি। আর দেশের বেশির ভাগ দলের তো নিজস্ব কোনও অর্থনৈতিক বা বিদেশনীতি নিয়ে ভাবনাই নেই।’’ নেতাজি নিয়ে তাঁরা যে রাজনীতি করছেন না, বরং আন্তরিক ভাবেই শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন সেই দাবিও করেছেন সুকান্ত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Netaji Subhas Chandra Bose TMC BJP
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE