Advertisement
E-Paper

৩২ হাজার প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি থাকবে? হাই কোর্ট রায় দেবে দুপুরেই, দিল্লিতে থাকা অভিজিতেরও নজর কলকাতায়

বুধবার হাই কোর্টের রায়ই ঠিক করবে ৩২ হাজার শিক্ষকের চাকরি থাকবে, না বহাল হবে তৎকালীন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশই! দু’বছর আগে প্রাথমিক মামলায় কী রায় দিয়েছিলেন তিনি?

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫ ১২:৪২
Will 32,000 primary school teachers have jobs, Calcutta High Court division bench to rule on Wednesday afternoon

৩২ হাজার প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি বাতিলের নির্দেশ দিয়েছিলেন কলকাতা হাই কোর্টের তৎকালীন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

প্রাথমিকের ৩২ হাজার শিক্ষকের চাকরি থাকবে কি? বুধবার দুপুরে কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তী এবং বিচারপতি ঋতব্রতকুমার মিত্রের ডিভিশন বেঞ্চ রায় দেবে। তার পরেই স্পষ্ট হবে ৩২ হাজার শিক্ষকের ভবিষ্যৎ। হাই কোর্ট কী রায় দেয়, সেই দিকে তাকিয়ে রয়েছেন প্রাক্তন বিচারপতি তথা বিজেপির সাংসদ অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। বছর দুই আগে তাঁর নির্দেশেই বাতিল হয়েছিল ওই ৩২ হাজার শিক্ষকের চাকরি! তার পর জল অনেক দূর গড়িয়েছে। চাকরি বাতিল করে তৎকালীন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় যে রায় দিয়েছিলেন, আদালতের নির্দেশে আপাতত তা স্থগিত রয়েছে।

বুধবার হাই কোর্টের রায়ই ঠিক করবে ৩২ হাজার শিক্ষকের চাকরি থাকবে, না বহাল হবে তৎকালীন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশই! ২০১৪ সালের ‘টেট’-এর ভিত্তিতে ২০১৬ সালে প্রাথমিকে প্রায় ৪২৫০০ শিক্ষক নিয়োগ হয়েছিল। ওই নিয়োগপ্রক্রিয়াতেই বেনিয়মের অভিযোগ ওঠে। পরে ২০২৩ সালের মে মাসের ১২ তারিখ ওই মামলার রায় ঘোষণা করেছিলেন হাই কোর্টের তৎকালীন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। দু’বছর আগে প্রাথমিক মামলায় কী রায় দিয়েছিলেন তিনি?

‘বঞ্চিত’ চাকরিপ্রার্থী প্রিয়াঙ্কা নস্কর-সহ ১৪০ জন হাই কোর্টে ২০১৪ সালের প্রাথমিকে নিয়োগপরীক্ষায় (টেট) দুর্নীতির অভিযোগ তুলে মামলা দায়ের করেছিলেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল, ২০১৪ সালের টেট উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। ২০১৬ সালের নিয়োগপ্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাঁদের ইন্টারভিউয়ে ডাকা হয়েছিল। কিন্তু তাঁরা চাকরি পাননি। মামলাকারীরা যে নিয়মের কথা বলেছিলেন সেটা অনুযায়ী, এনসিটিই-এর (জাতীয় শিক্ষক শিক্ষণ পর্ষদ) নিয়ম মেনে শিক্ষক হওয়ার জন্য ন্যূনতম যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। মামলাকারীদের বক্তব্য, ২০১৬ সালের নিয়োগপ্রক্রিয়ায় যে প্যানেল তৈরি করা হয়েছে, তাতে একাধিক অনিয়ম রয়েছে। নিয়মে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চাকরিপ্রার্থীদের অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হলেও দেখা গিয়েছে, ওই প্যানেলের বেশির ভাগ চাকরিপ্রার্থী প্রশিক্ষণহীন। ফলে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যোগ্য চাকরিপ্রার্থীরা নিয়োগপ্রক্রিয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।

শুনানি চলাকালীন আদালত প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের কাছে ২০১৬ সালের নিয়োগপ্রক্রিয়ার প্যানেলের নম্বর বিভাজন-সহ তালিকা তলব করে। পর্ষদ তৎকালীন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাসে তালিকা জমা দিয়ে জানায়, প্যানেলের চাকরি প্রাপকদের সর্বনিম্ন নম্বর ১৪.১৯১! পর্ষদের এই বক্তব্যে ভুল রয়েছে বলে দাবি করেন মামলাকারীরা। তাঁদের চেয়ে ১৩ নম্বর কম পেয়েও চাকরি পেয়েছেন ৮২৪ জন চাকরিপ্রার্থী। ওই ৮২৪ জনের নাম প্যানেলে রয়েছে। তার প্রেক্ষিতে আদালত পর্ষদের কাছে তথ্য চেয়ে পাঠায়। কিন্তু তা দিতে পারেনি তারা। শুধু তা-ই নয়, শুনানি চলাকালীন মামলাকারীরা তফসিলি জাতি (এসসি), তফসিলি উপজাতি (এসটি) এবং অন্যান্য অনগ্রসর জাতির (ওবিসি) প্রার্থীদের প্যানেল প্রকাশের দাবিও জানিয়েছিলেন। তাঁদের বক্তব্য, প্যানেল প্রকাশ করলেই স্পষ্ট হবে ওই প্রার্থীদের সর্বনিম্ন নম্বর কত। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও পর্ষদ নীরব থেকেছে। সেই তথ্য আদালতে জমা করতে পারেনি।

শুনানির সময় আদালতকে পর্ষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান জানিয়েছিলেন, অ্যাপটিটিউড টেস্ট নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু হুগলি, উত্তর দিনাজপুর, কোচবিহার এবং মুর্শিদাবাদের পরীক্ষক এবং চাকরিপ্রার্থীরা জানান, কোনও অ্যাপটিটিউড টেস্ট নেওয়া হয়নি। মামলাকারীদের আরও বক্তব্য, চাকরিপ্রার্থীদের ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্য অফিশিয়ালি কোনও চিঠি দেওয়া হয়নি। শুধুমাত্র ফোন করে ডাকা হয়েছিল ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্য। অ্যাপটিটিউড টেস্টের নম্বর দেওয়ার জন্য কোনও নির্দেশিকা ছিল না।

তৎকালীন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় শুনানির সময় এক পরীক্ষকের কাছে জানতে চান, অ্যাপটিটিউড টেস্ট কী। তাঁর প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, অ্যাপটিটিউড টেস্ট হল একজন চাকরিপ্রার্থীর শারীরিক ভাষা, যা বিতর্কের জন্ম দেয়। মামলাকারীদের অভিযোগ, সম্পূর্ণ বেআইনি ভাবে অ্যাপটিটিউড টেস্টের নম্বর দেওয়া হয়। তাঁদের দাবি, অনেক চাকরিপ্রার্থীকে ১০ নম্বরের মধ্যে ৯.৫ দেওয়া হয়েছে। যেখানে ওই প্রার্থীদের অ্যাকাডেমিক স্কোর এবং টেটের নম্বর খুবই কম। কেন তাঁদের বেশি বেশি নম্বর দেওয়া হয়েছে, তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। আদালতে কোনও সদুত্তর দিতে পারেনি পর্ষদ।

মামলাকারীদের আরও দাবি ছিল, অনেক চাকরিপ্রার্থী মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, টেট পরীক্ষায় খুবই কম নম্বর পেয়েছেন। কিন্তু ইন্টারভিউ এবং অ্যাপটিটিউড টেস্টে ১০ নম্বরের মধ্যে ৯.৫ নম্বর দেওয়া হয়েছে। অথচ অ্যাপটিটিউড টেস্ট হয়নি। তার পরেও কী ভাবে এত বেশি বেশি নম্বর দেওয়া হল?

কী ভাবে অ্যাপটিটিউড টেস্টে নম্বর দেওয়া হয়? মাধ্যমিক পরীক্ষার নম্বরের ভিত্তিতে নিয়োগপ্রক্রিয়ায় কোনও প্রার্থীকে সর্বোচ্চ ৫ নম্বর দেওয়া যেতে পারে। এ ছাড়াও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার নম্বরের ভিত্তিতে ওই নিয়োগপ্রক্রিয়ায় কোনও প্রার্থীকে সর্বোচ্চ ১০ নম্বর দেওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি, টেটের নম্বরের ভিত্তিতে নিয়োগপ্রক্রিয়ায় কোনও প্রার্থীকে সর্বোচ্চ ৫ নম্বর দেওয়া যেতে পারে। কোনও প্রার্থী তিনটি পরীক্ষায় খুবই ভাল ফল করলে সর্বোচ্চ ২০ (৫+১০+৫) নম্বর পেতে পারেন।

মামলাকারীদের প্রশ্ন, অনেক প্রার্থী এমন রয়েছেন যাঁদের ওই তিনটি নম্বরে যোগফল ৭.৩৭৮। কিন্তু ইন্টারভিউয়ে তাঁদের ৯.৫ নম্বর দেওয়া হয়েছে। কেন তাঁদের বেশি নম্বর দেওয়া হল তা নিয়ে পর্ষদ কোনও জবাব দিতে পারেনি। ২০১৬ সালের নিয়োগপ্রক্রিয়ার রুল সেভেন অনুযায়ী সিলেকশন কমিটি তৈরি বাধ্যতামূলক ছিল। যোগ্য প্রার্থীদের নিয়ে প্যানেল তৈরি এবং নিয়োগ দেওয়ার কাজ করে ওই সিলেকশন কমিটি। অভিযোগ, এ ক্ষেত্রে কোনও সিলেকশন কমিটি গঠন করা হয়নি।

চাকরিপ্রার্থীদের মূল্যায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল একটি তৃতীয় সংস্থাকে। ওই সংস্থাকে পর্ষদ ‘কনফিডেনশিয়াল সেকশন’ বলে অভিহিত করেছিল। অভিযোগ, পর্ষদের এই সিদ্ধান্ত নিয়োগপ্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণ ভাবে লঙ্ঘন করে। আদালতের প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে এই বিষয়টি নিয়েও পর্ষদ কোনও উত্তর দিতে পারেনি।

টাকার বিনিময়ে চাকরি দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। সেই বিষয়ে তদন্ত শুরু করে ইডি। পাশাপাশি, এই মামলার তদন্তভার ছিল সিবিআইয়ের হাতেও। মামলায় প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়, পর্ষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান মানিক ভট্টাচার্য এবং কয়েক জনের নাম উঠে আসে। রায় দেওয়ার সময় তৎকালীন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, পার্থ, মানিক, এবং কয়েক জন মিডলম্যান টাকার বিনিময়ে চাকরি বিক্রি করেছেন বলে প্রাথমিক ভাবে মনে করছে আদালত। সিবিআই এবং ইডির তদন্তে এমনই তথ্য উঠে এসেছে। তাঁর মন্তব্য, ‘‘এই পুরো নিয়োগপ্রক্রিয়া কলুষিত। দুর্গন্ধে ভরা। প্রচুর বেকার যুবক চোখের জল ফেলছে এই দুর্নীতির কারণে, তাই সাংবিধানিক আদালত চোখ বন্ধ করে থাকতে পারে না।’’

তৎকালীন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় চাকরি বাতিলের রায় দেওয়ার সময় জানান, ২০১৬ সালের নিয়োগপ্রক্রিয়ায় যাঁরা যোগ দিয়েছিলেন তাঁদের নিয়ে তিন মাসের মধ্যে নতুন নিয়োগপ্রক্রিয়া শুরু করতে হবে পর্ষদকে। নতুন কোনও চাকরিপ্রার্থীকে এই নিয়োগপ্রক্রিয়ায় নিতে দেওয়া যাবে না। এ-ও জানান, ইন্টারভিউ এবং অ্যাপটিটিউড টেস্টের ভিডিয়োগ্রাফি করতে হবে এবং তা সংরক্ষণ করে রাখতে হবে। রায় দেওয়ার সময়ে তৎকালীন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় জানান, আগামী চার মাস প্রাথমিকের সব শিক্ষক স্কুলে যেতে পারবেন। পার্শ্বশিক্ষকের সমকক্ষ বেতন তাঁরা পাবেন। নতুন নিয়োগপ্রক্রিয়ায় সফল হলে চাকরি থাকবে, না হলে নয়। তিনি বলেন, ‘‘পর্ষদের প্রাক্তন সভাপতি মানিক ভট্টাচার্যের জন্য এই নিয়োগপদ্ধতিতে এত দুর্গতি হয়েছে। তাই রাজ্য সরকার চাইলে নতুন নিয়োগপদ্ধতি পরিচালনার জন্য খরচ মানিক ভট্টাচার্যের থেকে নিতে পারবে।’’

সিঙ্গল বেঞ্চের ওই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে হাই কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে যায় পর্ষদ। তৎকালীন বিচারপতি সুব্রত তালুকদার এবং বিচারপতি সুপ্রতিম ভট্টাচার্যের ডিভিশন বেঞ্চ সিঙ্গল বেঞ্চের চাকরি বাতিল সংক্রান্ত রায়ের উপর অন্তর্বর্তী স্থগিতাদেশ জারি করে। তবে একই সঙ্গে ওই ডিভিশন বেঞ্চ জানায়, সিঙ্গল বেঞ্চের নির্দেশমতো নতুন করে নিয়োগপ্রক্রিয়া পর্ষদকে শুরু করতে হবে। হাই কোর্টের ওই দুই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে যায় রাজ্য এবং পর্ষদ। সেখানে আবেদন জানান চাকরিহারাদের একাংশ। তাঁদের বক্তব্য, সিঙ্গল বেঞ্চ শুনানিতে সব পক্ষকে বলার সুযোগ দেয়নি। সব পক্ষের বক্তব্য শোনেনি আদালত। ওই বছর শীর্ষ আদালত হাই কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চকে সব পক্ষের বক্তব্য শুনতে নির্দেশ দিয়েছিল। এর পরে মামলা যায় বিচারপতি চক্রবর্তী এবং বিচারপতি মিত্রের ডিভিশন বেঞ্চে। ১২ নভেম্বর হাই কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে শুনানি শেষ হয়। রায় স্থগিত রেখেছিল হাই কোর্ট। বুধবার দুপুর ২টোয় সেই মামলায় রায় দেবে ডিভিশন বেঞ্চ।

বুধবার হাই কোর্ট যখন রায় দেবেন, তখন দিল্লিতে রয়েছেন প্রাক্তন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। সংসদে অধিবেশনে যোগ দেওয়ার জন্য রাজধানীতে গিয়েছেন তমলুকের বিজেপি সাংসদ। ফোনে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘‘রায় নিয়ে এখন কোনও মন্তব্য করব না। আগে রায় বার হোক। কী রায় হয় তা দেখার পরই যা বলার বলব।’’

Primary Recruitment Case Abhijit Ganguly
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy