Advertisement
E-Paper

‘দাতা’ মমতা, ‘ডাটা’ অভিষেক! ভোটের আগে পেশাদার মোড়কে দেওয়া-নেওয়ার আখ্যান লিখছে শাসক তৃণমূল, স্পষ্ট ২৪ ঘণ্টায়

সোমবার মহেশতলা থেকে গত ছ’সাতটি অর্থবর্ষের তথ্য উল্লেখ করে অভিষেক বোঝাতে চেয়েছিলেন, রাজ্য থেকে কেন্দ্রীয় সরকার করের টাকা নিয়ে গেলেও বাংলার প্রাপ্য দিচ্ছে না। মঙ্গলবার নবান্ন থেকে মমতা বার্তা দিলেন, কেন্দ্র না-দিলেও তিনি দিয়ে যাচ্ছেন। যাবেনও।

শোভন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫ ১০:৪৭
Abhishek Banerjee creating political narrative with data, Mamata Banerjee highlighting state government’s delivery system

(বাঁ দিকে) মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় (ডান দিকে)। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

সাড়ে ৫৪ মিনিটের পর ৬২ মিনিট। সোমবারের পর মঙ্গলবার। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

সোমবার সাড়ে ৫৪ মিনিটের বড় অংশ জুড়ে অভিষেক গড়গড় করে তথ্য-পরিসংখ্যান বলেছিলেন। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ডাটা’। মঙ্গলবার ১৫ বছরের কাজের খতিয়ান হিসাবে ‘উন্নয়নের পাঁচালি’ পেশ করতে গিয়ে ৬২ মিনিটে মুখ্যমন্ত্রী মমতাও তথ্য বলেছেন বটে। কিন্তু তার চেয়ে‌ও বেশি তুলে ধরেছেন গত দেড় দশকে তাঁর সরকার কী কী করেছে তার খতিয়ান। মহিলা থেকে পরিযায়ী শ্রমিক, ছাত্র-যুব থেকে বৃদ্ধ, কৃষক থেকে তফসিলি জাতিভুক্ত, সংখ্যালঘুদের কী কী দিয়েছে তাঁর নেতৃত্বধীন সরকার। অর্থাৎ, ‘দাতা’র ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।

গত কয়েক বছর ধরেই তৃণমূল রাজনৈতিক ভাবে বলতে চাইছে, কেন্দ্রীয় সরকার মানুষের হাত থেকে সব কিছু কেড়ে নিচ্ছে। পক্ষান্তরে, মমতা সেই মানুষের হাতেই সাধ্যমতো দেওয়ার চেষ্টা করছেন। সোম এবং মঙ্গলবার ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে সেই ‘দেওয়া-নেওয়া’র সাতসতেরো উপস্থাপিত হল পেশাদার মোড়কে। যা থেকে স্পষ্ট হয়ে গেল ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোটের লক্ষ্যে তৃণমূলের রাজনৈতিক অভিমুখও।

তাঁর ঘনিষ্ঠেরা জানেন, অভিষেক দৈনিক আট থেকে সাড়ে আট ঘণ্টা মোবাইল ঘাঁটেন (পরিভাষায় যাকে বলে ‘স্ক্রিন টাইম’)। খুঁটিয়ে তথ্য দেখেন এবং তা থেকে রাজনৈতিক ভাষ্যের অবয়ব তৈরি করেন। সোমবার মহেশতলায় তাঁর লোকসভা কেন্দ্র ডায়মন্ড হারবারের জন্য স্বাস্থ্য শিবির ‘সেবাশ্রয় ২’-এর উদ্বোধন করতে গিয়েছিলেন অভিষেক। সেখানেও মোবাইল ঘেঁটে তথ্য বলতে শুরু করেন তিনি। শেষ ছ’সাতটি অর্থবর্ষে জিএসটি এবং সরাসরি কর বাবদ পশ্চিমবঙ্গ থেকে কত টাকা কেন্দ্রীয় সরকার সংগ্রহ করেছে, তার উল্লেখ করেন। সেই সঙ্গেই উল্লেখ করেন, ২০২১ সালের পর থেকে আবাস যোজনা, সড়ক যোজনা, ১০০ দিনের কাজ, জলজীবন মিশনের মতো কেন্দ্রীয় প্রকল্পে রাজ্যের কত অর্থ বকেয়া। সমান্তরাল ভাবে জুড়ে দেন, এই সময়ের মধ্যে মমতার সরকার সামাজিক প্রকল্পে ঠিক কত টাকা খরচ করেছে, সেই তথ্যও।

তার ২৪ ঘন্টা পর মঙ্গলবার নবান্ন সভাঘরে ‘উন্নয়নের পাঁচালি’ পেশ কর্মসূচিতে মমতা তুলে ধরেন পরিষেবা প্রদানের খতিয়ান। যাতে তথ্যের থেকেও বেশি ছিল ‘বার্তা’। যে বার্তার মূল প্রতিপাদ্য, এই ‘সঙ্কটের’ মধ্যেও তিনি দিয়ে গিয়েছেন। কোভিডের মতো ক্রান্তিকালে‌ও তা থামেনি। প্রসঙ্গত, সাংসদ হিসাবে অভিষেক ফি বছর তাঁর লোকসভায় ‘রিপোর্ট কার্ড’ পেশ করে জানান, তিনি কী কী কাজ করেছেন। কিন্তু রাজ্য সরকারের ক্ষেত্রে তেমন রেওয়াজ ছিল না। মঙ্গলবার নবান্নের কর্মসূচি ছিল দৃশ্যতই পেশাদারিত্বে মোড়া। যা দেখে অনেকেরই ধারণা, এর নেপথ্যে পরামর্শদাতা সংস্থা আইপ্যাকের ভূমিকা রয়েছে। কাজের খতিয়ান পেশকে নির্দিষ্ট নাম দেওয়া, তার আবহ তৈরি করতে জাতীয় পুরস্কারজয়ী গায়ক ইমন চক্রবর্তীকে দিয়ে পাঁচালি পাঠ করানোর মতো ঘটনা তেমনই বলছে। যদিও সম্পূর্ণ তথ্যপঞ্জি এখনও তৈরি করতে পারেনি নবান্ন। তা করতে আরও সাত-দশ দিন লেগে যাবে বলে জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী নিজেই।

২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের আগে ১০০ দিনের কাজের বকেয়া মজুরি নিজেদের কোষাগার থেকে মিটিয়েছিল রাজ্য। সে বার তৃণমূলের প্রচার ছিল ‘মোদী নিচ্ছেন, দিদি দিচ্ছেন’। এ বার হাই কোর্টের নির্দেশের পরেও রেগার টাকা এখনও দেয়নি দিল্লি। ফের সেই অপ্রাপ্তিকে প্রচারে রেখেই বকেয়া প্রাপ্তির কথা তুলে ধরা হচ্ছে তৃণমূল এবং নবান্নের তরফে। সন্দেহ নেই গ্রামীণ অর্থনীতিতে ১০০ দিনের কাজ গুরুত্বপূর্ণ। লোকসভা ভোটের আগে ৫৯ লক্ষ শ্রমিকের অ্যাকাউন্টে বকেয়া মজুরি পৌঁছেছিল বলে দাবি করেছিল রাজ্য। নির্বাচনের মুখে নগদ অর্থ পাওয়ার প্রভাবও ভোটে পড়েছিল বলে অভিমত অনেকের। যার ফলস্বরূপ বিজেপি ১৮ থেকে ১২ আসনে নেমে গিয়েছে।

লক্ষ্মীর ভান্ডারের মতো প্রকল্পের পাশাপাশি এ বার ‘বাংলার বাড়ি’ প্রকল্পকেও দৃঢ় ভাবে বাস্তবায়িত করতে চাইছে রাজ্য। লোকসভা ভোটের পরে ১২ লক্ষ পরিবার বাড়ি তৈরির টাকা পেয়েছে। চলতি ডিসেম্বরে নতুন ১৬ লক্ষ পরিবারের হাতে আবাসের প্রথম কিস্তির ৬০ হাজার টাকা পৌঁছে দেওয়ার ঘোষণা ইতিমধ্যেই করে রেখেছেন মমতা। পরের কিন্তি যাবে মে মাসে। তখন ভোট হয়ে যাবে ঠিকই। কিন্তু তৃণমূল মনে করছে, আসলে ২৮ লক্ষ মানুষের মাথার উপর ছাদ তৈরি করে ভোটের ‘ভিত’ তৈরি করতে চাইছে শাসকদল। এখানেও মমতাকেই ‘দাতা’ হিসাবে সামনে রাখছে তৃণমূল। এক দিকে ‘দিচ্ছে না’র তথ্য দিচ্ছেন অভিষেক। অন্য দিকে ‘দিচ্ছি’র মুখ হিসাবে নিজেকে তুলে ধরছেন মমতা। যাকে তৃণমূলের নেতাদের একাংশ ‘ডবল ব্যারেল গান’ বা দোনলা বন্দুকের সঙ্গে তুলনা করছেন। অভিজ্ঞেরা বিলক্ষণ জানেন, দোনলা বন্দুকের দু’টি নল পরস্পরের পরিপূরক। একটি থেকে গুলি ছুড়লে অন্যটি গরম হয়ে ওঠে। তার পরে দু’টি নল থেকেই মসৃণ ভাবে স্থির লক্ষ্যে গুলি ছোড়া যায়। শাসক শিবিরের ব্যাখ্যায়, মমতা-অভিষেক এ ভাবেই বিধানসভা ভোটের লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছেন।

তা যে খুব কষ্টকল্পনা নয়, তার প্রমাণ মিলেছে অভিষেকের ‘সেবাশ্রয় ২’ শিবিরের পর পর দু’দিনের পোস্টারে। সোমবার শিবিরের প্রথম দিনের পরিসংখ্যান সংক্রান্ত গ্রাফিক কার্ডে শুধু অভিষেকের ছবিই ছিল। মঙ্গলবার রাতে সেবাশ্রয়ের দ্বিতীয় দিনের পরিসংখ্যানের পোস্টারে অভিষেকের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে মমতার ছবিও। তৃণমূলে এমন ধরনের ‘ছবি বিতর্ক’ নতুন নয়। দু’দিনের দু’রকম পোস্টার ঘিরে মৃদু গুঞ্জনও শুরু হয়েছিল দলের অন্দরে। কিন্তু ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে যে ভাবে অভিষেক এবং মমতা নিজেদের ভূমিকা উপস্থাপিত করলেন, তাতে ‘দোনলা বন্দুক’-এর তত্ত্বই প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। একটি নল ‘দাতা’। অন্যটি ‘ডাটা’। লক্ষ্য বিজেপি।

Mamata Banerjee Abhishek Banerjee TMC
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy