Advertisement
E-Paper

মঞ্জুলের হাত ধরে ভাঙন সরকারেও

এক মন্ত্রীকে ডেকে সিবিআই এবং ইডি জেরা করেছে। এক মন্ত্রী জেলে। আর এক মন্ত্রী রাতারাতি ইস্তফা দিয়ে বিজেপি দফতরে গিয়ে মুণ্ডপাত করলেন মুখ্যমন্ত্রী তথা শাসক দলের! সারদা-বিধ্বস্ত তৃণমূলের নতুন বিড়ম্বনা হিসেবে বৃহস্পতিবার বিজেপি দফতরে পুত্র-সহ আবির্ভাব হল রাজ্যের ত্রাণ ও উদ্বাস্তু পুনর্বাসন মন্ত্রী মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুরের!

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৬ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:১৯
বিজেপি দফতরে রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংদের সঙ্গে মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুর ও সুব্রত ঠাকুর।—নিজস্ব চিত্র।

বিজেপি দফতরে রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংদের সঙ্গে মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুর ও সুব্রত ঠাকুর।—নিজস্ব চিত্র।

এক মন্ত্রীকে ডেকে সিবিআই এবং ইডি জেরা করেছে। এক মন্ত্রী জেলে। আর এক মন্ত্রী রাতারাতি ইস্তফা দিয়ে বিজেপি দফতরে গিয়ে মুণ্ডপাত করলেন মুখ্যমন্ত্রী তথা শাসক দলের! সারদা-বিধ্বস্ত তৃণমূলের নতুন বিড়ম্বনা হিসেবে বৃহস্পতিবার বিজেপি দফতরে পুত্র-সহ আবির্ভাব হল রাজ্যের ত্রাণ ও উদ্বাস্তু পুনর্বাসন মন্ত্রী মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুরের!

রাজনৈতিক প্রভাবের নিরিখে মঞ্জুল তেমন ‘ওজনদার’ নন ঠিকই। কিন্তু তাঁকে দলে নিয়ে আপাতত এক ঢিলে দুই পাখি মারল বিজেপি। এমনিতেই টালমাটাল তৃণমূলে এ বার সত্যি সত্যিই ভাঙনের কাঁপন ধরিয়ে দেওয়া গেল। শাসক দলে আতঙ্ক আরও বাড়িয়ে দেওয়ার জন্যই বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ এ দিন বলেছেন, “এই তো সবে শুরু! তৃণমূলের বিদায়-যাত্রার প্রথম ফিতেটি কাটলেন মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুর! এর পরে তিন দিনের নোটিসে তৃণমূলের অন্য মন্ত্রীকে আমাদের দলে যোগদান করাতে চাই।” আর দ্বিতীয়ত, তৃণমূলের উপর তলায় ভাঙনের সূচনা এমন এক জন মন্ত্রীকে দিয়ে শুরু করাতে পারল বিজেপি, যাঁর এলাকায় সামনেই লোকসভা উপনির্বাচন। ঠাকুরবাড়ির যে বিভাজনের প্রভাব মতুয়া-অধ্যুষিত বনগাঁ কেন্দ্রের লোকসভা উপনিবার্চনে পড়া প্রায় অবধারিত! সেই লক্ষ্যেই মঞ্জুল এবং তাঁর পুত্র সুব্রত ঠাকুরের নাম বনগাঁর প্রার্থী হিসেবে বিজেপির বিবেচনায় রয়েছে। যে আসনে তৃণমূলের প্রার্থী ঠাকুরবাড়িরই বধূ এবং মঞ্জুলের বৌদি মমতাবালা ঠাকুর!

সারদা এবং আরও নানা ঘটনায় বিব্রত তৃণমূলে এখন অস্থিরতা চরমে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় হোক বা অন্য কোনও প্রসঙ্গে দলের বর্ষীয়ান মন্ত্রী বা সাংসদেরা মাঝে মাঝেই ভিন্ন সুর গাইছেন। দলীয় অনুশাসন দেখিয়ে মুখ বন্ধ করাতে চাইলেও কেউ বলে ফেলছেন, শুভবুদ্ধি চেপে রেখেই দলে আছেন! মুকুল রায়ের মতো শীর্ষ নেতা সিবিআইয়ের নোটিস পেয়ে প্রথমে বলছেন কলকাতায় ফিরেই জেরার মুখোমুখি হবেন, কলকাতায় ফিরে আবার সময় চেয়ে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাকে চিঠি দিচ্ছেন। আবার তার পরের দিনই আচমকা ফিরে যাচ্ছেন দিল্লি! তবে এত অস্থিরতার মধ্যেও এ যাবৎ কালে যা হয়েছে তৃণমূলে, সবই বিদ্রোহের আভাস মাত্র! এ বার মঞ্জুলের হাত ধরে সেই বিদ্রোহই বদলে গেল সরাসরি ভাঙনে!

এবং এই ধাক্কার জেরে তৃণমূল এখন এতটাই বেসামাল, যে মঞ্জুলের বেনজির আক্রমণের পরেও তেমন জোরালো প্রত্যাঘাত আসেনি তৃণমূলের তরফে। সঙ্গে সঙ্গে কোনও কড়া ব্যবস্থার ঘোষণাও হয়নি। তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় শুধু বলেছেন, “তৃণমূলের গঠনতন্ত্রে বিধিসম্মত যে ব্যবস্থা আছে, সেই মোতাবেক দু’জনের ক্ষেত্রেই ভবিষ্যতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” তবে পার্থবাবু বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, মঞ্জুলেরা দল ছাড়ায় তৃণমূল স্বস্তিই পেয়েছে! তাঁর কথায়, “বহু দিন ধরে ওঁরা দলের উপরে চাপ সৃষ্টি করে ক্ষমতায়নের চেষ্টা করছিলেন। সে চেষ্টা সফল হয়নি। এত দিন তলায় তলায় এ সব করছিলেন। আজ প্রকাশ্যে করেছেন!”

দলের বাঁধন ছেড়ে বেরোনোর সিদ্ধান্ত নিয়ে মঞ্জুলও অবশ্য রাখঢাক করেননি। বিজেপি দফতরে গিয়ে রাহুলবাবুর পাশে বসে তিনি জানিয়েছেন, এ দিনই নিজের ইস্তফাপত্র ফ্যাক্স করে মুখ্যমন্ত্রীকে পাঠিয়েছেন। পরে মন্ত্রিসভাও তাঁকে বরখাস্ত করেছে। মঞ্জুলের অভিযোগ, “মন্ত্রী হলেও আমাকে মতুয়াদের জন্য কোনও কাজ করতে দেওয়া হয়নি। তৃণমূলের যা অবস্থা, সারদা থেকে শুরু করে যা হচ্ছে, তাতে কোনও ভাল লোক ওই দলে থাকতে পারবে না!” যে মঞ্জুল তৃণমূলের মন্ত্রী হওয়ার আগে মমতাকে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করেছিলেন, এ দিন তাঁর মুখে শোনা গিয়েছে, “অটলবিহারী বাজপেয়ী, লালকৃষ্ণ আডবাণী দেশের সেবায় এই মনীষীদের ত্যাগ আমাদের অনুপ্রাণিত করে!”

এখানেই থামেননি মঞ্জুল। তাঁর আরও ক্ষোভ, “তৃণমূলের ইদানীং যা দুর্নাম রটেছে, তাতে ওই দল করলে লোকে টিটকিরি দিচ্ছে। মানুষের পক্ষে তা সহ্য করা সম্ভব নয়।” এক ধাপ এগিয়ে তাঁর পুত্র সুব্রত বলেন, “তৃণমূলে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কাজ হয় না। তারা জনগণের আশা ভঙ্গ করেছে।” বস্তুত, তৃণমূলের অন্দরে বহু লোকেরই এটাই মনের কথা। সকলে তা প্রকাশ্যে আনতে পারছেন না। মঞ্জুল পথ দেখানোর পরে এ বার সেই চাপা ক্ষোভ ভাঙন হয়ে ফুটে উঠবে বলেই বিজেপি নেতাদের দাবি। ঘটনাপ্রবাহ দেখে বিরোধী দলনেতা, সিপিএমের সূর্যকান্ত মিশ্রও মন্তব্য করেছেন, “এই তো সবে শুরু! মুখ্যমন্ত্রী নিজের ঘর সামলান! এ রাজ্যে বিজেপি থেকে তৃণমূলে রূপান্তর (উদাহরণ, পরশ দত্ত) হয়েছে, তৃণমূল থেকে বিজেপিতে রূপান্তরও হবে।”

স্বয়ং মমতাকেও এ দিন রেয়াত করেননি মঞ্জুল। তাঁর মন্তব্য, “ওঁর দম্ভ আছে! উনি কারও কথাই শোনেন না। নিজের খুশিমতো চলেন।” কিন্তু এই মমতার নেতৃত্ব মেনেই তো এক দিন তিনি তৃণমূলে গিয়েছিলেন? মঞ্জুলের জবাব, “হ্যাঁ, গিয়েছিলাম। তার মানে তো এই নয় যে, দল নীতিবিরুদ্ধ কাজ করলেও সেখানে থাকতে হবে!”

উত্তর ২৪ পরগনার মতুয়া-অধ্যুষিত বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্র থেকেই গত বছর তৃণমূলের সাংসদ হয়েছিলেন মঞ্জুলের দাদা কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর। তাঁরই মৃত্যুতে ওই আসনে উপনির্বাচন হচ্ছে। মঞ্জুল-সুব্রতের বিজেপি-তে যোগদানের দিনই ওই কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থী হিসাবে কপিলের স্ত্রী মমতাবালার ঘোষণা করেছেন দলীয় নেতৃত্ব। ওই কেন্দ্রে মতুয়া সম্প্রদায়ের ভোটে ঠাকুর পরিবারের প্রভাব মাথায় রেখেই প্রার্থী বাছাইয়ে ঠাকুরবাড়িকে গুরুত্ব দিচ্ছে যুযুধান দুই শিবির। চূড়ান্ত ঘোষণা না হলেও প্রার্থী ঠিক করার ক্ষেত্রে বিজেপি শিবির ঠাকুরবাড়ির কথাই অগ্রাধিকার দিচ্ছে।

ঠাকুরবাড়িতে কপিল-মঞ্জুলের পারিবারিক বিবাদ অবশ্য বহু আগেই সর্বজনবিদিত। তৃণমূল ছেড়ে সেই বিবাদের আঁচ আরও উস্কে দিয়ে এ দিন মঞ্জুল অভিযোগ করেন, তাঁর দাদা কপিলের মৃত্যু স্বাভাবিক নয়! ওই ঘটনার সিবিআই তদন্তের দাবি তুলেছেন তিনি। তাঁর এই আক্রমণের লক্ষ্য বৌদি মমতাবালা। তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা-সহ কয়েকটি বিষয় নিয়েও এ দিন প্রশ্ন তোলেন মঞ্জুল। যার প্রেক্ষিতে মমতাবালার পাল্টা বক্তব্য, “আমার স্বামী দু’মাস ধরে অসুস্থ ছিলেন। তখন তো উনি (মঞ্জুল) বা ওঁর ছেলে এক বারও দেখতে আসেননি!” তাঁর পাল্টা অভিযোগ, “আমার স্বামীর মৃত্যুর পিছনে ওঁদেরই ভূমিকা আছে! নানা ভাবে ওঁরা আমার স্বামীকে হেনস্থা করেছেন। থানা-পুলিশও করতে হয়েছে।” তবে তিনি জানিয়েছেন, চিকিৎসকেরা কপিলের মৃত্যু নিয়ে অন্য কিছু বলেননি। তাই তিনি কোনও তদন্ত চান না।

মঞ্জুলদের যোগদান-পর্বে বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুলবাবু দাবি করেছেন, সারদা কেলেঙ্কারিতে ফেঁসে থাকা অনেক তৃণমূল নেতাই তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। তবে কেলেঙ্কারির ছোঁয়াচ এড়াতে তাঁরা ‘অ-সারদা মঞ্চ’ গড়বেন। মঞ্জুল-সুব্রতর যোগদানের প্রেক্ষিতে তিনি বলেন, “উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্বের জন্য বিজেপি চেষ্টা করবে।” যা বনগাঁ উপনির্বাচনে তাঁদের হাতিয়ার হবে।

tmc manjulkrishna thakur matua bjp
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy