E-Paper

‘ভারতে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ সংগঠিত নয়, এটি হচ্ছে মানবিক ট্র্যাজেডির ফলে’, বললেন শেখ হাসিনা

সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা জানান, ভারত যখন বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অভাবের কথা বলে, বিশ্ব শোনে।

অগ্নি রায়

শেষ আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০২৫ ০৫:৩৬
শেখ হাসিনা।

শেখ হাসিনা। —ফাইল চিত্র।

প্রশ্ন: আওয়ামী লীগকে ভোটে লড়ার প্রশ্নে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। দলীয় রেজিস্ট্রেশন কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের রাজনীতির মূলস্রোতে ফেরার প্রশ্নে আপনি কতটা আশাবাদী? দলের সামনে রাস্তা কী? আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়েই বা কী ভাবছেন?

শেখ হাসিনা: যারা আওয়ামী লীগকে সরিয়ে দিতে চাইছে, ছোট করে দেখাতে চাইছে তাদের কাছে আমরা আদৌ অপরিচিত নই। আমরা আক্রমণ, হামলা, নিধন, সামরিক শাসন পার করে এসেছি। রাজনৈতিক ভাবে আমাদের শেষ করে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে বারবার। কিন্তু তা সত্ত্বেও দেশের মানুষ আমাদের ন’বার ভোটে জিতিয়েছেন। কারণ একটাই, প্রতি গ্রামে, জেলায়, প্রতিবেশী অঞ্চলে আমাদের শিকড় গভীরে প্রোথিত। আমাদের নিষিদ্ধ করে দিয়ে লাখ লাখ মানুষের সমর্থন তো মুছে ফেলতে পারবে না। তাতে শুধুমাত্র প্রকৃত গণতান্ত্রিক নির্বাচনে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তিকালীন সরকারের ভীতিটাই ফুটে উঠবে। এ কথা ভুলবেন না, ইউনূস সরকারের পক্ষে একটি ভোটও বাংলাদেশের মানুষ দেননি বা সে পরিস্থিতিও তৈরি হয়নি। বাংলাদেশের লাখ লাখ ভোটারের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার কোনও অধিকার তাঁর (ইউনূসের) নেই।

আইনি এবং গণতান্ত্রিক পথে আমরা শান্তির সঙ্গে এই নিষেধাজ্ঞাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে যাব, দেশের ভিতরে এবং আন্তর্জাতিক স্তরে। সুষ্ঠু অবাধ এবং সবাইকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচন সংগঠিত করার ডাক দেব। ইতিহাস বলে, বাংলাদেশিরা যখন তাঁদের প্রিয় বা পছন্দের দলকে ভোট দিতে পারেন না, তাঁরা আদৌ ভোটই দেন না। আমাদের বাইরে রেখে যে নির্বাচনই হোক না কেন, তা পরবর্তী সরকারের বৈধতা বা মান্যতাকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে দেবে। মানুষের সমর্থন নিয়ে সরকার তৈরি করার দাবি তারা করতে পারবে না।

আমরা ভোটে যোগ দিতে পারব কি না, তা নির্ভর করছে গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি দেশে ফিরে আসে কি না তার উপর। তার অর্থ, নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া, অন্যায় ভাবে জেলে ঢোকানো রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দেওয়া এবং নির্বাচন যাতে অবাধ ও নিরপেক্ষ হয় তার নিশ্চয়তা দেওয়া। আমরা আশাবাদী, গণতন্ত্রের জয় হবে। ইউনূস সরকারের এই জমানায় প্রতিটি দিন মানুষ বুঝতে পারছেন, কেন তাঁরা আমাদের বারবার জিতিয়ে এনেছেন।

প্রশ্ন: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত বড় ভূমিকা নিয়েছিল। এই সঙ্কটের সময়ে ভারতের কাছে আপনার কী প্রত্যাশা?

হাসিনা: ১৯৭১ সালে ভারত গণহত্যার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। আজকের পরিস্থিতিতে অন্য ভূমিকা প্রয়োজন। তা হল, কূটনৈতিক চাপ বাড়ানো, অর্থনীতির মাধ্যমে যতটা লেভারেজ আদায় করা যায় তা দেখা, আন্তর্জাতিক জোট তৈরি করা। ভারত ইতিমধ্যেই নীতিগত অবস্থান নিয়ে জানিয়েছে, বাংলাদেশে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচন করতে হবে। সংখ্যালঘু নিপীড়নের বিষয়টিও তুলে ধরেছে। আমাদের দেশ সম্পর্কে ভারতের ধারাবাহিকভাবে উৎসাহী থাকা, দশকের পর দশকের পরিশ্রমে গড়ে ওঠা অংশীদারির উপর বিশ্বাস রাখার কারণে ভারতের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। ভারত যখন বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অভাবের কথা বলে, বিশ্ব শোনে।

প্রশ্ন: ২০২৪-এর অগস্টের পর থেকে আজ পর্যন্ত বিএনপি এবং জামায়েতের সার্বিক ভূমিকা সম্পর্কে আপনি কী বলবেন? জামায়েতে এবং এনসিপি-র বিরুদ্ধে কোনও নতুন রাজনৈতিক সমীকরণের কথা ভাবছেন? নিজের দলের বাইরে বাংলাদেশের অন্য কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কথাহচ্ছে কি?

হাসিনা: যে কোনও জোটই সাংবিধানিক নীতি ও ধর্মনিরপেক্ষ প্রশাসনের উপর ভিত্তি করে তৈরি হওয়া উচিত। আমরা এমন কারও সঙ্গে জোট গড়তে পারি না যারা তাদের মৌলিক নীতিগুলিই বিসর্জন দিয়েছে। মনে রাখবেন, ২০১৩ সালে জামায়েতে এবং বিএনপি উভয়েই নির্বাচনের আইন বদলাতে চেয়েছিল। বহু নির্বাচন তারা বয়কট করেছে, দাঙ্গা-হাঙ্গামা করেছে।

প্রশ্ন: বাংলাদেশে নানা ভাবে পাকিস্তানের প্রভাব বাড়ছে, বর্তমান জমানায়। পাকিস্তানের আইএসআই, সেনা, বাণিজ্যকর্তারা বাংলাদেশে যাচ্ছেন বৈঠক করছেন। নয়াদিল্লির আশঙ্কা, বিষয়টি সীমান্ত এবং ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগজনক। কী বলবেন?

হাসিনা: বাস্তব বোধসম্পন্ন নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ চায় পাকিস্তানের সঙ্গে সুস্থির সম্পর্ক। কিন্তু অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে এগোতে হবে। আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক ভারতের সঙ্গে, তা যেন কোনও ভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। ইউনূস সরকারের না আছে অভিজ্ঞতা, না রয়েছে সেই অধিকার যে নতুন বিদেশনীতির অভিমুখ তৈরি করবে। পাকিস্তানের দিকে আদর্শগতভাবে ঝুঁকে পড়া শুধুমাত্র প্রতীকী অর্থেই সমস্যাজনক নয়, রণকৌশলগতভাবেও বিপজ্জনক। আমার আশা, যখন বৈধ সরকার আবার বাংলাদেশে তৈরি হবে, এই সব সাধারণ জ্ঞান ফিরে আসবে।

জামায়াতে ইসলামী ও তাদের সহযোগী সাত রাজনৈতিক দলের সমর্থকদের মিছিল ঢাকায়।

জামায়াতে ইসলামী ও তাদের সহযোগী সাত রাজনৈতিক দলের সমর্থকদের মিছিল ঢাকায়। ছবি: পিটিআই।

প্রশ্ন: বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীর বিষয়টি ভারতের কেন্দ্র এবং সীমান্ত রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে রাজনৈতিক সংঘাতের বিষয় হয়ে উঠেছে। আপনি কী মনে করেন? বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে অনুপ্রবেশ ঘটছে নিয়মিত ভাবে এবং পশ্চিমবঙ্গের ভোটার তালিকা এবং গণচরিত্রকে (ডেমোগ্রাফি) বদলে দিচ্ছে?

হাসিনা: সীমান্তকে সুস্থির রাখতে আমাদের সরকার ভারতের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করে গিয়েছে। বায়োমেট্রিক সিস্টেম যাতে চালু থাকে, সমন্বয়ের মাধ্যমে যাতে টহলদারি হয় তা নিশ্চিত করেছে। আমাদের অর্থনীতি বেড়েছে, কর্মসংস্থানও বেড়েছে। অনুপ্রবেশ কমেছে যেহেতু দেশে কাজের নতুন নতুন সুযোগতৈরি হয়েছে।

কিন্তু এখন বাংলাদেশের অর্থনীতি ধাক্কা খেয়েছে। ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় প্রতিদিন পীড়নের মুখোমুখি হচ্ছে। মানুষ মরিয়া হয়ে উঠেছেন, অন্যত্র নিরাপদ জায়গায় পালিয়ে যেতে চাইছেন, অন্যত্র কাজের সন্ধান করতে চাইছেন। এটা কোনও সংগঠিত অনুপ্রবেশ নয়, এটি ঘটছে মানবিক ট্র্যাজেডির ফলে। শুধুমাত্র সীমান্তে প্রহরা বাড়ানোই সমাধান নয়, বাংলাদেশে গণতন্ত্র এবং সুস্থিতি তৈরি করাই জরুরি।

প্রশ্ন: দিল্লিতে আসার পর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে? বর্তমান সঙ্কট নিয়ে কথা বলেছেন?

হাসিনা: নির্দিষ্ট কোনও কথোপকথনের কথা এখানে উল্লেখ করতে চাই না। শুধু এটুকুই বলতে পারি ভারতের রাজনৈতিক বৃত্তের সব নেতাই বুঝতে পারছেন, বাংলাদেশের সঙ্কটের কী প্রভাব আঞ্চলিক সুস্থিতিতে পড়ছে।

প্রশ্ন: হঠাৎ করেই যখন দেশ ছাড়তে হল, মনের অবস্থা কেমন ছিল? কী ধরনের চক্রান্ত হয়েছিল সে সময়ে যা পরে বুঝতে পেরেছেন ?

হাসিনা: যখন হিংসার তাণ্ডব চলছে, তখন দেশ ছেড়ে আসা সহজ সিদ্ধান্ত ছিল না। তবে তা আমাকে নিতে হয়েছিল যাতে মানুষের প্রাণহানি কমানো যায়। আমার লক্ষ্য ছিল দেশকে সুরক্ষিত রাখা, এত কষ্ট করে যা যা তৈরি করেছি তাকে অক্ষত রাখা। দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছে শান্তিপূর্ণ ছাত্র আন্দোলন কী ভাবে চকিতেই চরম হিংসার দিকে চলে গেল। এবং তা গেল পরিকল্পনামাফিকসমন্বয়ের মাধ্যমে।

পরে বোঝা গিয়েছে এর পিছনে বিরাট চক্রান্ত ছিল। যে ভাবে ইউনূস সমস্ত দুর্বৃত্তদের রক্ষাকবচ দিলেন, প্রতিবাদীর মৃত্যুর ঘটনায় আমাদের বিচারবিভাগীয় তদন্ত বন্ধ করলেন, সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীদের ছেড়ে দিলেন, তাতেই স্পষ্ট আমার সরকারকে উৎখাত করার পরিকল্পনা নিয়েই গোটা বিষয়টি সাজানো হয়েছিল।

(ইমেলে প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন শেখ হাসিনা)

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Sheikh Hasina Interview Bangladesh

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy