Advertisement
০৪ মে ২০২৪
Coronavirus

সুন্দর জীবন ছারখার হয়ে গিয়েছে, তবে বাজারে জিনিসপত্রের অভাব নেই

এই ভাইরাস ক্রমশ তার পাখা বিস্তার করতে থাকে। লোকজনের মধ্যে প্যানিক-শপিং এর ধুম পড়ে যায়।

জনশূন্য রাস্তাঘাট। —নিজস্ব চিত্র।

জনশূন্য রাস্তাঘাট। —নিজস্ব চিত্র।

সুদীপ চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২৩ মার্চ ২০২০ ১২:৫৮
Share: Save:

ইটালীয় ভাষায় ‘লা দলচে ভিতা’। বাংলা করলে ‘একটি সুন্দর জীবন’।ইটালি সবসময়ই তার নিজস্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত। কিন্তু সেই সুন্দর ইটালির বুকে নেমে এসেছে তিক্ত অভিশপ্ত এক জীবনযুদ্ধের ছায়া। হ্যাঁ, আপনারা ঠিকই ধরেছেন। আমি করোনাভাইরাস এর কথাই বলছি। আজ থেকে ঠিক এক মাস আগেও ছবিটা ছিল একদম অন্য রকম।

প্রথমে পড়াশুনার তাগিদে আর এখন কর্মসূত্রে ইটালি এর সঙ্গে আমার সম্পর্ক নয় নয় করে ১৪ বছরের। এই বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি আমি সপরিবারে ভারত থেকে ইটালিতে ফিরে আসি।মাঝখানে বলে রাখি, আমি কলকাতা থেকে একটু দূরে রানাঘাট এর বাসিন্দা। ওই সময় করোনা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে চিনে। পৃথিবীর কোনও কোনও প্রান্তে ওই সময় তেমন করোনার দাপট চোখে তেমন পড়ছিল না।কিন্তু সকলেরই মনের মধ্যে একটা মৃদু ভয় ওই সময় থেকেই বাসা বাঁধতে শুরু করছিল। ইটালির উত্তর ভাগে (লম্বারদিয়া/ভেনতো) ওই সময় দু’চারটে কেস মাত্র শুরু হয়েছে। কিন্ত কোনও রকম বিধিনিষেধ শুরু তখন হয় নি।

আমরা সেই ভয়টাকে কাটিয়ে কলকাতা থেকে যাত্রা শুরু করে দিল্লি-রোম হয়ে এসে পৌঁছলাম আমাদের এই ছোট্ট শহর কোসেনজায়।এখানে আমি কালেব্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করি। আমার বুঝতে অসুবিধা হয় নি, যে এই করোনা একটা মস্ত বড় আতঙ্ক সৃষ্টি করতে চলছে। রোম এবং কোসেনজায় নামার পর থার্মাল স্ক্যানের এ দু-দু’বার পরীক্ষা করে আমরা যথারীতি গন্তব্যে চলে এলাম। কিন্তু হঠাৎ করে এক সপ্তাহের মধ্যে ছবিটা একদম পাল্টে গেল। দুই শতাধিক আক্রান্ত আর সেটা পরের সপ্তাহেই হাজার পাঁচেক। আস্তে আস্তে মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়তে থাকে। সবথেকে বেশি আক্রান্ত উত্তর ইটালি।মধ্য বা দক্ষিণ তখনও তেমন করে করোনার প্রকোপের মুখে পড়েনি।

বাজারে জিনিসপত্র মিলছে। —নিজস্ব চিত্র।

আরও পড়ুন: দেশে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে ৪১৫, বহু রাজ্যে লকডাউন: করোনা আপডেট এক নজরে​

অবশ্য সেটা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। অবস্থা বেগতিক দেখে পার্শ্ববর্তী দেশ যেমন অস্ট্রিয়া,সুইৎজারল্যান্ড আন্তর্জাতিক সীমান্ত পুরোপুরি বন্ধ না করলেও অনেক বিধিনিষেধ আরোপ করে। সঙ্গে সঙ্গে ইটালীয় সরকার প্রথমে স্কুল বন্ধ করে। কিন্তু অবস্থার অবনতি হতেই থাকে। ধীরে ধীরে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায়। সঙ্গে পাবলিক অফিসে কাজও কমতে থাকে। ট্রেন বাসের সংখ্যা কম হতে থাকলে লোকজন উত্তর থেকে নিজের নিজের প্রদেশগুলোতে ফিরে আসতে থাকে। আর সঙ্গে সঙ্গে এই ভাইরাস ক্রমশ তার পাখা বিস্তার করতে থাকে। লোকজন এর মধ্যে প্যানিক-শপিং এর ধুম পড়ে যায়। জরুরি পরিষেবা বাদ দিয়ে সব কিছু সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে। সন্ধ্যা ৬টার পর দোকান, বাজার, পাব, বার সব বন্ধ হয়ে যায়। দিনেরবেলা রাস্তাঘাট সব শুনশান। যেন একটা মৃত্যুপুরী। বিশ্ববিদ্যালয় বা তার আশপাশে কিছু ছাত্রের আনাগোনা থাকলেও কিছু দিন পরে সেটাও কমতে থাকে। বিদেশি ছাত্রছাত্রী ছাড়া বাকিদেরওবিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়ে যায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিন থেকে খাবার দাবারের পরিমাণ ও কমতে থাকে দিন দিন। বিনা অনুমতিতে রাস্তায় বেরোনো নিষিদ্ধ। শুধুমাত্র খাবার দাবার আর ওষুধপত্রের দোকানে যাবার অনুমতি রয়েছে। তবে সেটাও সরকারের দেওয়া একটা সেলফ ডিক্লারেশন ফর্ম নিয়ে। যেটা সঙ্গে না থাকলে ২৬০ইউরো পর্যন্ত জরিমানা হচ্ছে। সেটাও অনেকে মানতে নারাজ।

এরই মধ্যে কিছু লোকজন এর দেখা মিলছে, যাঁরা দিব্যি রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আমাদের এই ছোট শহর এখন যেন প্রাণহীন। আমরা কোর্স করাচ্ছি আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে।মিটিং,থিসিস ডিফেন্স সব কিছুতেই তাই। ভারতে আমাদের বাবা, মা সকলেই চিন্তায় রয়েছেন। আমরা সর্বদাই তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলছি। ভারতীয় দূতাবাসের তরফে আমাদের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ করা হয়নি। কিন্তু আমি আমার স্ত্রী আর সঙ্গে দুটি বাচ্চা ছেলে নিয়ে আমরা কোনও অসুবিধার সম্মুখীন এখনও হইনি।

আরও পড়ুন: বাজার খুলতেই উপচে পড়ল ভিড়, বাড়তি দামে মাছ-মাংস-সব্জি কিনলেন মানুষ​

যতটা সম্ভব লোকজনের সঙ্গে মেলামেশা বা সংস্পর্শে না আসার চেষ্টা করছি। আজ থেকে আমাদের এই কালেব্রিয়া প্রদেশ থেকে উত্তরে যাবার সমস্ত রকম যাতায়াত ব্যবস্থা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। দোকান বাজারে এমনিতেই খাবার দাবারের একটু টান শুরু হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস এখনও পাওয়া যাচ্ছে। মাছ, মাংস কম পাওয়া গেলেও ফল, দুধ, সব্জীর যোগান পর্যাপ্ত। যে কোনও সুপারমার্কেটে একসঙ্গে ১০ জনের বেশি থাকতে পারবে না। তাই (গেটের বাইরে লম্বা লাইন ভেতরে ঢোকার জন্য। একজন করে বার হবে তো একজন ঢুকবে।কিন্তু এই ভাবে কত দিন চলবে জানা নেই। তাই আমার একান্ত অনুরোধ রাজ্যবাসীরকাছে, আপনার দয়া করে ঘরে থাকুন, লোকজন এর সঙ্গে মেলামেশা কম করুন। আর হু-এর নির্দেশ মতো নিজেদের মানিয়ে নিয়ে একটু ভাল থাকুন আর অন্যদেরও ভাল থাকার সুযোগ করে দিন। অযথা প্যানিক না করে সবার সঙ্গে সহযোগিতা করুন। না হলে সেই দিন আর বেশি দূরে নেই যখন ভারতবর্ষের অবস্থা আজকের ইটালির থেকেও আরও অনেক বেশি ভয়ানক আরও অনেক বেশি বেদনাদায়ক হয়ে উঠবে।

লেখক কালেব্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ইটালিতে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus COVID-19 Italy Health
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE