পুজোর বার্তা ভেসে এসেছে দূর শহরেও। কলকাতা সাজছে নববধূর মতো— রাস্তা জুড়ে আলোর মালা, বাজারের কোণে কোণে ভিড়, ঢাকের শব্দে আকাশ কাঁপছে। উমা আসছেন— আবারও। এই অপেক্ষা চিরন্তন, প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বয়ে চলেছে। আমি আজও সেই প্রতীক্ষায় ভেসে যাই, তবে দূর শহর ব্যাঙ্ককে, যেখানে তিন বছর ধরে আমার ঠিকানা। আমার জানলা খুললেই দেখা যায়— বিষ্ণু মন্দির, তাইল্যান্ডের বৃহত্তম হিন্দু মন্দির। প্রতিদিন ভোরে ঘণ্টাধ্বনি আর ধূপের গন্ধ ভেসে আসে ঘরে। এখানেই প্রাণ পায় আমাদের সকলের প্রাণের উৎসব— দুর্গাপুজো।
প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায় জুলাইতেই। কুমোরটুলির শিল্পীরা আসেন প্রতিমা গড়তে। পুজোর সময় মন্দির যেন এক অপূর্ব মঞ্চ— রং, আলো, ভক্তি আর আনন্দের মিলনে ভরে ওঠে। হাজারো মানুষ ভিড় জমান। দুর্গা এখানে পরিচিত উমা দেবী নামে— অচেনা ভাষা, অথচ একই ভক্তির সুর। এখানে প্রবাসী ভারতীয় সমাজ হয়তো লন্ডন বা সিডনির মতো বড় নয়, কিন্তু ঘনিষ্ঠ। আর তার ভিতরে বাঙালিদের উপস্থিতি বিশেষ ভাবে দৃশ্যমান। সত্যি কথা বলতে কি, আমার কেনাকাটার অভাব কখনও তীব্র হয় না, মা প্রতি বছর ডাকযোগে পাঠিয়ে দেন নতুন ধুতি-পাঞ্জাবি। এই নতুন পোশাক পরে বিষ্ণু মন্দিরে পা রাখার মুহূর্তে, মনে হয় যেন নিজের ঘরের এক টুকরো সঙ্গে নিয়ে এসেছি।
প্রতিদিনই ভক্তদের পরিবেশন করা হয় প্রসাদ— জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাই একই আসনে বসে খান। অষ্টমী আর নবমীর রাতে মন্দিরে প্রায় দু’হাজার মানুষ সমবেত হন। বাঙালি হৃদয় খুঁজে ফেরে বাংলার পুষ্পাঞ্জলির সুর। তাই অষ্টমীতে যোগ দিই ‘ভারতী তাইল্যান্ড’ আয়োজিত পুজোয়, আইটিসিসি হলে— যেখানে কলকাতার আবহ ফিরে পাই।
দশমীর দিন ঢাকের শেষ তালে আকাশ যেন হঠাৎ নিস্তব্ধ হয়ে যায়। গঙ্গা নেই, কিন্তু আয়োজন কম নয়। শোভাযাত্রা বেরোয়, রঙিন পাল্কি, ঢাকঢোল আর নৃত্যে ভরপুর। আর সেই রঙিন আলোয় মোড়া সিলমের রাস্তায় শোভাযাত্রা ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে। প্রতিমার মুখে লাল আবিরের রঙ, চোখে সেই চেনা বিদায়বেলার শান্ত দৃষ্টি। ঢাকের তালে তালে কলকাতার শ্যামবাজারের ভিড় যেন এসে মিশেছে ব্যাঙ্ককের অচেনা জনসমুদ্রে। মনে মনে বলি— ‘আসছে বছর আবার হবে।’
চোখ বুজতেই ভেসে ওঠে শৈশবের সকাল— মায়ের হাত ধরে ফুল তোলার দৃশ্য, পাড়ার মণ্ডপে ভোরের আলোয় পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার স্মৃতি। আর চোখ খুলে দেখি— আমি এখন প্রবাসী। প্রতিমা যখন মিলিয়ে গেল আলো-অন্ধকারের ভেতরে, বুকের ভেতরটা হঠাৎ শূন্য হয়ে যায়। অথচ সেই শূন্যতায়ও থেকে যায় একটা গভীর আশ্বাস। মনে হয়, দেবী চলে গেলেও তিনি রয়ে গিয়েছেন। নদীর জলে নয়, আমাদের অন্তরের গহিনে। বাতাসে তখনও ভেসে আসে ধূপের গন্ধ, ঢাকের শেষ প্রতিধ্বনি মিলিয়ে যায় আকাশে। দাঁড়িয়ে থাকি নীরবে, চোখে জল। ভিড় ধীরে ধীরে সরে যায়, আলো নিভে আসে। মনে হয় এই শহর, এই মানুষ, এই মুহূর্ত—সবই এক অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা। সেই সুতোই হয়তো আমাদের সত্যিকারের ঘর— যেখানে উমা ফিরে আসেন, বারবার, বছর বছর।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)