একে অপরের চিরশত্রু দুই দেশ। নতুন নয় দু’পক্ষের সংঘাতের ইতিহাসও। এ বার সংঘাতের কারণ, পরমাণু চুক্তি! ইরানের ‘পারমাণবিক শক্তিবৃদ্ধি’তে আশঙ্কিত হয়ে সে দেশের উপর হামলা চালাল ইজ়রায়েল। ইজ়রায়েলের ‘অপারেশন রাইজ়িং লায়ন’ অভিযানে নিহত হয়েছেন ইরানের চার শীর্ষ সেনাকর্তা। প্রাণ গিয়েছে ছ’জন পরমাণু বিজ্ঞানীরও।
ইজ়রায়েলি হামলাকে সরাসরি সমর্থন করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও। তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, ইরান নয়া পরমাণু চুক্তি না মানলে তাদের ‘আরও ভয়ঙ্কর হামলা’র মুখে পড়তে হবে। প্রাথমিক ভাবে আমেরিকার বিদেশসচিব মার্কো রুবিয়ো দাবি করেছিলেন, ইরানে বিরুদ্ধে ইজ়রায়েলি হামলায় আমেরিকা কোনও ভাবেই জড়িত নয়। পরে ট্রাম্প বুঝিয়ে দিয়েছেন, ইরান পরমাণু বোমা তৈরি করলে, সেটা তারা কোনও মতেই মেনে নেবে না।
আগামী রবিবার ওমানে পরমাণু সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে ষষ্ঠ দফার বৈঠকে বসার কথা আমেরিকা এবং ইরানের। আমেরিকা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, তারা চায় না ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি চালিয়ে যাক। বিভিন্ন রিপোর্টে দাবি, ইরান ইতিমধ্যেই ইউরেনিয়ামের বিশুদ্ধতা ৬০ শতাংশে নিয়ে গিয়েছে। পরমাণু অস্ত্র তৈরি করতে অবশ্য এই বিশুদ্ধতার পরিমাণ আরও বৃদ্ধি করতে হবে ইরানকে। কিন্তু আমেরিকা চায়, এখানেই থেমে যাক ইরান।
ভূ-রাজনীতিকদের একাংশ মনে করছেন, ওমানের বৈঠকের আগে আমেরিকাও আসলে ইরানের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে রাখতে চাইল। ট্রাম্প বুঝিয়ে দিয়েছেন, ইজ়রায়েলের হামলার সিদ্ধান্তে তাদের সমর্থন রয়েছে। রয়েছে ‘মদত’ও। সমাজমাধ্যম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ মার্কিন প্রেসিডেন্ট লিখেছেন, ‘‘আমেরিকার সেরা অস্ত্র ইজ়রায়েলের হাতে রয়েছে। তারা জানে, ওই অস্ত্র কী ভাবে ব্যবহার করতে হয়। ইরানের কট্টরপন্থীদের অনেকেই বড় বড় কথা বলেছিলেন। তাঁদের কেউ আর বেঁচে নেই। এ বার পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।’’
যদিও ইরান আগেই দাবি করেছে, তারা কোনও পরমাণু বোমা তৈরি করছে না। কিন্তু পরমাণু প্রযুক্তি ব্যবহারের অধিকার তাদের রয়েছে। যে প্রযুক্তিতে তৈরি জিনিস সাধারণ মানুষেরই কাজে লাগবে। ‘নিউক্লিয়ার নন-প্রলিফারেশন’ চুক্তিতে ইরানের স্বাক্ষর রয়েছে। সেই চুক্তি মেনে ইরানও ইউরেনিয়াম ব্যবহার করতে পারে। ইউরেনিয়ামের বিশুদ্ধতা বাড়াতে পারে। তবে ইরান এমন কিছু করছে না, যা দিয়ে পরমাণু অস্ত্র তৈরি করা যায়। আমেরিকার মতো ইরানও ওমানের বৈঠকের দিকেই তাকিয়ে। সে দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী আজিজ নাসিরজাদে আগেই হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছিলেন, পরমাণু চুক্তি নিয়ে আলোচনা ব্যর্থ হলে ইরান পশ্চিম এশিয়ার মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলোতে হামলা চালাবে।
ঘটনাচক্রে, ঠিক তার পরেই ইরানের পরমাণু কেন্দ্র এবং সামরিক ঘাঁটিতে হামলা চালাল ইজ়রায়েল। ইরানও প্রত্যাঘাতেরও হুঁশিয়ারি দিয়েছে। সংবাদ সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, ইরান রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে, তারাও ইজ়রায়েলকে জবাব দেবে। বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর দেশ যে মাত্রার হামলা চালিয়েছে, সেই একই মাত্রায় তারা জবাব দেবে। ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতোল্লা আলি খামেনেইও ইজ়রায়েলকে ‘কঠোর শাস্তি’ দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। বলেছেন, ইজ়রায়েল যেন খারাপ পরিণতির জন্য প্রস্তুত থাকে।
ইজ়রায়েলি হামলায় ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক মেজর জেনারেল মহম্মদ বাগেরি নিহত হয়েছেন। মৃত্যু হয়েছে ইরানের রেভলিউশনারি গার্ডের প্রধান কমান্ডার জেনারেল হোসেন সালামি, ডেপুটি কমান্ডার জেনারেল ঘোলামালি রশিদ এবং রেভলিউশনারি গার্ড অ্যাকোস্পেস ফোর্সের (এই বাহিনীর হাতেই ক্ষেপণাস্ত্র হামলার দায়িত্ব রয়েছে) প্রধান মেজর জেনারেল আমির আলি হাজিজ়াদের। প্রাণ হারিয়েছেন ইরানের ছ’জন পরমাণু বিজ্ঞানীও। নিহত বিজ্ঞানীদের মধ্যে রয়েছেন ইরানের পরমাণু শক্তি সংস্থার প্রাক্তন প্রধান ফেরেউদুন আব্বাসি।
ইরানও পাল্টা ড্রোন-হামলা চালিয়েছে, কিন্তু বিশেষ সুবিধা করে উঠতে পারেনি। ইজ়রায়েলের বক্তব্য, তারা তা প্রতিহত করেছে। বস্তুত, ইরান যে হামলা চালাতে পারে, এমন আশঙ্কা করে দেশে আগেই জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে দেয় ইজ়রায়েল।
‘চিরশত্রু’ দু’দেশের এই সাম্প্রতিক সংঘাতে স্বাভাবিক ভাবেই নতুন করে অশনিসঙ্কেত দেখা গিয়েছে বৃহত্তর আরব রাজনীতিতে। আশঙ্কা, প্যালেস্তাইনের সঙ্গে যুদ্ধের আবহে ইরানের সঙ্গেও ইজ়রায়েলের সংঘাত শেষমেশ যুদ্ধের দিকে মোড় নিলে গোটা পশ্চিম এশিয়াই দীর্ঘ সংঘাতে জড়িয়ে পড়বে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দরিদ্র এবং উন্নয়নশীল দেশগুলিতে। যুদ্ধ পরিস্থিতির আশঙ্কা করে পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে প্রশাসনিক আধিকারিক এবং তাঁদের পরিবারকে সরিয়েও নেয় ওয়াশিংটন।
ইরানের উপর নতুন করে হামলা শুরু ইজ়রায়েলের
ইরানের পরমাণুকেন্দ্র সামরিক ঘাঁটি লক্ষ্য করে হামলা চালানোর পরে সে দেশে শুক্রবার রাতে নতুন করে হামলা শুরু করে ইজ়রায়েল। এমনটাই বলছে সংবাদমাধ্যম বিবিসির রিপোর্ট। অন্য দিকে, ইরানের সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, সে দেশের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সক্রিয় করা হয়েছে। শুক্রবার সকাল থেকে ইরানের পরমাণু এবং সামরিক ঘাঁটি লক্ষ্য করে হামলা চালানো শুরু করে ইজ়রায়েল। ইরানের রাজধানী তেহরানে এবং সংলগ্ন এলাকাতেও আকাশপথে হামলা চালায় ইজ়রায়েলি সেনা। ইরান এই হামলার কথা স্বীকার করেছে। ইজ়রায়েলের হামলার পরে প্রত্যাঘাতের হুঁশিয়ারি দেয় ইরানও। সে দেশের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতোল্লা আলি খামেনেই একটি বিবৃতি দিয়ে ইজ়রায়েলকে ‘কঠোর শাস্তি’ দেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন। এই আবহে ইরানকে হুঁশিয়ারি দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
মোদীকে ফোন করে হামলার কারণ জানিয়েছেন নেতানিয়াহু
পশ্চিম এশিয়ায় শান্তি বজায় রাখার জন্য ইজ়রায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে বার্তা দিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ইরানের বিভিন্ন সামরিক ও পরমাণুকেন্দ্রে বিমানহানার ‘ব্যাখ্যা’ এবং পরবর্তী পরিস্থিতি সম্পর্কে মোদীকে অবহিত করতেই ফোন করেছিলেন নেতানিয়াহু। দু’জনের মধ্যে পশ্চিম এশিয়ার আঞ্চলিক পরিস্থিতি নিয়ে বিশদে আলোচনা হয়েছে বলে সংবাদ সংস্থা পিটিআই জানিয়েছে। ইজ়রায়েলের বিদেশমন্ত্রী জ়িডিয়ন সার ফোন করেন বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্করকে। বিকেলে ৭ লোককল্যাণ মার্গে ফোন আসে নেতানিয়াহুর। পিটিআই জানিয়েছে, আঞ্চলিক শান্তি এবং সুস্থিতি বজায় রাখার জন্য ইজ়রায়েলি প্রধানমন্ত্রীকে বার্তা দিয়েছেন মোদী। পাশাপাশি, আগামী দিনে নয়াদিল্লি-তেল আভিভ যোগাযোগ অব্যাহত রাখার বার্তা দিয়েছেন।
ইজ়রায়েলি হামলার সম্ভাব্য কারণ
অনেকের মত, ইরান পরমাণু শক্তিধর হয়ে উঠুক, তা চায় না ইজ়রায়েল। কারণ শিয়া ধর্মাবলম্বী ইরানের শাসকেরা ইহুদিপ্রধান ইজ়রায়েলের অস্বিত্বই স্বীকার করতে চান না। বরং প্রায়ই তাঁদের পৃথিবীর মানচিত্র থেকে ইজ়রায়েলকে মুছে ফেলার হুঁশিয়ারি দিতে শোনা যায়। সম্প্রতি গাজ়া ভূখণ্ডে ইজরায়েল-হামাস সংঘাত অবশ্য ইরানকে বিকল্প উপায় ভাবতে বাধ্য করেছে। প্যালেস্টাইনি সশস্ত্র সংগঠন হামাস কিংবা লেবাননের সশস্ত্র সংগঠন হিজ়বুল্লাকে ব্যবহার করে বেশ কয়েক বছর ইজ়রায়েলকে ব্যতিব্যস্ত রেখেছিল ইরান। কিন্তু ইজ়রায়েলি হানায় ওই দুই সংগঠনই এখন কোণঠাসা। তাই রণাঙ্গনে নামতে হচ্ছে ইরানকেই। ইরান অবশ্য দাবি করছে, পরমাণু অস্ত্র নয়, ওষুধ কিংবা বিদ্যুৎ তৈরির মতো কাজেই তারা ইউরেনিয়াম ব্যবহার করতে চায়।
পাল্টা ইরানি হামলার আশঙ্কা
ইজ়রায়েলি হামলার পর শুক্রবার ইরানের ‘ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক রাজধানী’ হিসেবে পরিচিত কোম শহরের জ়ামকারান মসজিদ (শিয়া ধর্মাবলম্বী ইরানের প্রধান মসজিদ হিসেবে পরিচিত)-এর চূড়ায় লাল পতাকা উড়তে দেখা গিয়েছে। এই লাল পতাকাকে যুদ্ধের প্রতীক বলেই মনে করা হয়। এর থেকেই আশঙ্কা, ইরানও প্রত্যাঘাতের প্রস্তুতি নিচ্ছে। অতীতেও বিভিন্ন সময়ে তেহরানের শাসকবর্গ শত্রুদেশের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণার আগে দেশের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতৃত্বের বার্তায় জ়ামকারান মসজিদের চূড়ায় যুদ্ধের লাল নিশান উড়িয়েছে। ইরানি হামলার আশঙ্কা করে শুক্রবার ইজ়রায়েলি বিদেশ মন্ত্রক বিশ্ব জুড়ে তাদের সমস্ত দূতাবাস, কনস্যুলেট এবং অন্য কূটনৈতিক কেন্দ্রগুলি সাময়িক ভাবে বন্ধ রাখার কথা ঘোষণা করেছে। এর পাশাপাশি, বিদেশে বসবাসকারী এবং ভ্রমণে যাওয়া ইজ়রায়েলি নাগরিকদের উদ্দেশে বিশেষ সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে। চলাফেরা নিয়ন্ত্রণ ও প্রয়োজনীয় সতর্কতা বজায় রাখার পাশাপাশি কোনও অবস্থাতেই ইহুদি বা ইজ়রায়েলি প্রতীক প্রকাশ্যে বহন না করার নির্দেশ দিয়েছে তেল আভিভ। সেই সঙ্গে অবিলম্বে বিদেশে থাকা ইজ়রায়েলি নাগরিকদের ‘অবস্থান’ জানানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ব্যাহত বিমান পরিষেবা
ইজ়রায়েল-ইরান সংঘাতের জেরে বিশ্ব জুড়ে ব্যাহত হল বিমান পরিষেবা। ইতিমধ্যেই দেশের আকাশসীমা (এয়ারস্পেস) বন্ধ করে দিয়েছে ইরান। সে দেশে বিমান পরিষেবাও আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। ইরানে ইজ়রায়েলি বিমানহানার পরেই আকাশসীমা বন্ধ করেছে পড়শি দেশ ইরাক এবং জর্ডন। এই দুই দেশের আকাশপথ ব্যবহার করে গন্তব্যে যেতে পারছে না কোনও উড়ান। পরবর্তী নির্দেশ না-দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে ইজ়রায়েলের রাজধানী তেল আভিভের বেন গুরিয়ন বিমানবন্দর। তিনটি দেশের আকাশসীমা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ব্যাহত হয়েছে বিশ্বের নানা প্রান্তের বিমান পরিষেবা। ইরানের সীমান্তবর্তী পূর্ব ইরাক বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত ‘এয়ার করিডর’। প্রতি মুহূর্তে এই আকাশপথ ধরে পশ্চিমের কোনও দেশে কিংবা ইউরোপে যায় এশিয়ার কোনও দেশের বিমান। আবার ফিরতি পথেও এই করিডর ব্যবহার করে এই বিমানগুলি। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এই রাস্তা অবরুদ্ধ হয়ে যাওয়ায় বিকল্প পথে গন্তব্যে যেতে হচ্ছে বিমানগুলিকে। এর ফলে বাড়ছে জ্বালানির খরচও।