দীর্ঘদিনের শরিক বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে সাম্প্রতিক নানা বিষয়ে মতের অমিল ও তা থেকে পারস্পরিক কাদা ছোড়াছুড়ি ঠেকাতে শীর্ষ বৈঠক বসানো হয়েছিল লন্ডনে। একটি ‘বিশেষ মহল’ সেই বৈঠকের আয়োজন করেছিল। সেই বৈঠকে সৌহার্দ্যের ঘাটতি না থাকলেও কেবলমাত্র একটি বিষয় ছাড়া কোনও বিষয়েই দুই দলের মতের মিল হয়নি বলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সূত্রের খবর। তারেক রহমানের কিছু চাঁছাছোলা মন্তব্য জামায়াতের আমিরের পছন্দ না হওয়ায় তিনি কথা বাড়াতেও আর রাজি হননি। তবে যে বিষয়টিতে বিএনপি ও জামায়াতের শীর্ষ নেতৃত্ব একমত, তা হল— কোনও ভাবেই বাংলাদেশের পূর্বতন শাসক দল আওয়ামী লীগ এবং তার শরিকদের নির্বাচনে খোলামেলা ভাবে অংশ নিতে দেওয়া হবে না।
চিকিৎসার জন্য পূর্ব লন্ডনে পুত্র তারেক রহমানের বাড়িতে এখন রয়েছেন বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। তারেক নিজেও দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ডাকে ব্রাসেলস সফরে গিয়েছিলেন জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান। সঙ্গে ছিলেন দলের দু’নম্বর নেতা সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। প্রাথমিক ভাবে ‘অসুস্থ খালেদা জিয়াকে দেখতে’ জামায়াত নেতারা রবিবার লন্ডনে তারেকের বাড়িতে গিয়েছিলেন, বলা হচ্ছে। তবে জামায়াতের বন্ধু শক্তি পাকিস্তানি গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই-এর কিছু কর্তা দু’দলের এই শীর্ষ বৈঠকের আয়োজক ছিলেন বলে রাজনৈতিক সূত্রের খবর। যদিও জামায়াতের আমির বৃহস্পতিবার যুক্তি সাজিয়েছেন, কোনও এক আত্মীয়ের সঙ্গে দেখা করতে তিনি ব্রাসেলস থেকে লন্ডনে গিয়েছিলেন। সেখানে পৌঁছে ‘খালেদা কেমন আছেন’ দেখে আসতে যান। সেখানে তারেকও ছিলেন। জামায়াতের আমিরের কথায়, “রাজনৈতিক নেতাদের আলোচনায় তো রাজনীতির প্রসঙ্গ ওঠেই। সেখানেও উঠেছিল। কিন্তু সুনির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়নি।”
লন্ডনে বিএনপি-র এক দায়িত্বশীল নেতা জানাচ্ছেন, “তারেকের বাড়িতে জামায়াত নেতাদের খুবই খাতির করা হয়। তবে মিষ্টি মিষ্টি কথা হলেও কেউই নিজের নিজের অবস্থান থেকে নড়েননি। আওয়ামী লীগ ও তাঁর শরিকদের যে অবাধে নির্বাচন করতে দেওয়া ঠিক হবে না, সেই বিষয়টিতে দু’পক্ষ সহমত হয়। এ ছাড়া কোনও বিষয়েই কথা এগোয়নি।” ওই নেতা জানাচ্ছেন, তারেক রহমানের কিছু কথার সুরে শফিকুর ক্ষুণ্ণ হন। এ দিন ঢাকায় সাংবাদিক বৈঠকে শফিকুর বলেন, “রাজনীতিতে মতপার্থক্য থাকতে পারে। আমরা চাই মতপার্থক্য থাকুক, নয়তো রাজনীতিবিদেরা অন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু এ–ও প্রত্যাশা করি, এটি যাতে মতবিরোধের রূপ না নেয়। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে আমাদের রাজনীতিবিদেরা অনেক সময় বিষয়গুলো খেয়াল করেন না বা করি না।” জামায়াতের আমির বলেন, “আমার মতামত আমি জানাব, কিন্তু এটা বলতে পারি না যে এটাই করতে হবে বা এটা আমি করতে দেব না। রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ভাষা এটা নয়।”
এ দিকে আওয়ামী লীগের কাছে খবর, নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে টালবাহানার মধ্যে রবিবার আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনালে এক তরফা বিচারে শেখ হাসিনা এবং তাঁর শরিক দলের কিছু নেতাকে খুন ও গণহত্যার মতো মামলায় চার্জশিট দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। তার প্রতিবাদে ওই দিন, ২০ এপ্রিল বাংলাদেশের ৬৪টি জেলায় কর্মীদের মুখে কালো কাপড় বেঁধে প্রতিবাদ মিছিলের নির্দেশ দিয়েছেন দলের নেতৃত্ব। জেলাশাসকদের স্মারকলিপি দিয়ে প্রতিবাদ জানানোর নির্দেশ দেওয়া হয়।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাসিম বলেন, “বাংলাদেশে নিরন্তর আক্রমণ ও গণগ্রেফতারের ফলে কর্মসূচি পালন কঠিন হওয়ায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী দলের কর্মীরা ২০ তারিখ বা সুবিধামতো তার দু’এক দিন আগে-পরে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলির সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করবেন। দূতাবাসের প্রধানদের কাছে স্মারকলিপি দিয়ে তাঁরা বিচারের নামে এই বেআইনি প্রহসনের প্রতিবাদ জানাবেন।” যুদ্ধাপরাধ আদালতে গণহত্যার কয়েকটি মামলায় শেখ হাসিনা ছাড়া তাঁর দলের নেতা আনিসুল হক, জুনাইদ আহমেদ পলক, শরিক দল ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এবং জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতি হাসানুল হক ইনুকে প্রধান আসামি করা হয়েছে। জামায়াত ও মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে এঁরা ছিলেন সব চেয়ে সরব। নাসিম বলেন, “সন্দেহ নেই এদের প্রধান নিশানা শেখ হাসিনা। তাঁর বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত প্রায় ৩৫০টি মামলা দেওয়া হয়েছে। এমন ভুয়ো মামলায় আসামি করা হয়েছে হাজার হাজার মানুষকে। মিথ্যা, কাল্পনিক তথ্যের ভিত্তিতে বিচারের নামে প্রহসন চলছে। দেশ ও বিদেশে কর্মীরা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাবেন।”
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)