আপনার একটা ছোট দোকান আছে। তার ব্যবসা বছরে ২০ লক্ষ টাকার নীচেই। তা হলে কেন্দ্রের নিয়ম অনুযায়ী, জিএসটি-র আওতায় নথিভুক্ত হওয়ার বাধ্যবাধকতা আপনার নেই। ছোট-মাঝারি ব্যবসায়ীদের কিছুটা স্বস্তি দিতেই এই সিদ্ধান্ত বলে দাবি সরকারের। কিন্তু সত্যিই কি তাই? নতুন কর জমানায় জিএসটি নম্বর না-থাকলে ঠিক কোথায় হোঁচট খেতে পারেন, তা জানেন আপনি? পাড়ার অরুণবাবু থলে হাতে আপনার কাছে মাসকাবারি বাজার করে গেলে না-হয় অসুবিধা নেই। কিন্তু যদি কারও থেকে ব্যবসার জন্য কাঁচামাল কেনে কোনও বড় সংস্থা? সমস্যা হবে কি সে ক্ষেত্রে?
সব কিছু খতিয়ে দেখার পরে সংশ্লিষ্ট মহলে এখন প্রশ্ন উঠেছে, নথিভুক্ত না-হলে প্রতিযোগিতার বাজারে লাভজনক ভাবে আদৌ ব্যবসা চালানো যাবে তো? বিশেষ করে ব্যবসায়িক লেনদেন যদি চলে অন্য কোনও ব্যবসার সঙ্গে (বি-টু-বি)। সরকার বলছে, শিল্প, বিশেষত ছোট-মাঝারি সংস্থার জন্য জিএসটি ঐতিহাসিক পট-পরিবর্তন। কারণ, তারা এর আওতায় আরও সংগঠিত উপায় ব্যবসা করে মুনাফা করার সুযোগ পাবে। শর্ত শুধু প্রযুক্তি নির্ভর ডিজিটাল কর ব্যবস্থার নিয়ম-নীতির সঙ্গে পুরোদস্তুর মানিয়ে নেওয়া। কিন্তু নথিভুক্ত হওয়া বা না-হওয়ার ক্ষেত্রে সুবিধা-অসুবিধার ছবিটা যদি পরিষ্কার না-হয়, তা হলে ব্যবসা করার মূল জায়গাটা নিয়েই তৈরি হবে ধোঁয়াশা। তাই আজ চোখ রাখব এই বিষয়টিতেই।
নথিভুক্তি বাধ্যতামূলক কি?
জিএসটি-তে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ছোট-মাঝারি ব্যবসার নথিভুক্তি বাধ্যতামূলক। যদি—
• করযোগ্য ও করবিহীন পণ্য বা পরিষেবার জোগান মিলিয়ে রাজ্যের মধ্যে সংস্থা বছরে মোট ২০ লক্ষ টাকার বেশি ব্যবসা করে।
অর্থাৎ করবিহীন পণ্য বা পরিষেবার জোগান (রফতানি সমেত) যদি কারও ১৮ লক্ষ টাকা হয় এবং করযোগ্য জোগান যদি ৩ লক্ষ টাকা হয়, তা হলে মোট ব্যবসা ২০ লক্ষ পেরিয়ে যাওয়ায় তাকে নথিভুক্ত হতে হবে। এবং ওই ৩ লক্ষ টাকার পণ্য বা পরিষেবা সরবরাহের উপর জিএসটি দিতে হবে।
• আন্তঃরাজ্য বা একাধিক রাজ্যের মধ্যে পণ্য জোগানের ব্যবসা করলে।
• অনিয়মিত (ক্যাজুয়াল) কর দিতে হলে।
• কেন্দ্রীয় জিএসটি আইনের (সিজিএসটি অ্যাক্ট) ৯(৩) নম্বর ধারা অনুযায়ী, সংস্থাকে নির্দিষ্ট কিছু পরিষেবা নেওয়ার জন্য খরচ করতে হলে। এর মধ্যে আছে উকিলের ফির, পণ্য পরিবহণ এজেন্সির চার্জ, স্পনসরশিপ ফি, পরিষেবা আমদানির খরচ ইত্যাদি। কারণ, রিভার্স চার্জ প্রকল্পের আওতায় এই সব পরিষেবা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে জিএসটি দিতেই হয়।
• অনলাইনে ব্যবসা করা হলে। বছরে যদি ব্যবসার অঙ্ক ২০ লক্ষ টাকা নীচে হয় তা-ও।
• ই-কমার্স সংস্থাগুলির মাধ্যমে কোনও পণ্য বা পরিষেবা বিক্রি করলে।
• ইনপুট পরিষেবা প্রদানকারী (ইনপুট সার্ভিস ডিস্ট্রিবিউটর) হলে। যেমন, কেব্ল টিভি পরিষেবা সংস্থার মতো কেউ।
• কেউ টিডিএস মারফত কর আদায় করলে।
• অন্য নথিভুক্ত করযোগ্য ব্যবসার হয়ে এজেন্ট হিসেবে বা অন্য কোনও ভাবে পণ্য বা পরিষেবা সরবরাহ করলে।
• বিদেশে বসবাসকারী হয়ে ভারতে জিএসটি-তে নথিভুক্ত না-হওয়া ব্যবসাকে অনলাইন তথ্য বা তথ্যভাণ্ডার পুনরুদ্ধার (অনলাইন ইনফর্মেশন অ্যান্ড ডেটাবেস রিকভারি) পরিষেবা দিলে।
তবে যে-সংস্থাগুলি বছরে ২০ লক্ষ টাকার নীচে ব্যবসা করে, তারাও চাইলে নিজের থেকেই নথিভুক্ত হতে পারেন।
সুবিধা কোথায়?
বাধ্যতামূলক ভাবেই হোক বা স্বেচ্ছায়, জিএসটি-তে নথিবদ্ধ হলে সবচেয়ে বড় যে-সুবিধাটি পাওয়া যায়, তার নাম ইনপুট ট্যাক্স ক্রেডিট। এর আওতায় পণ্য তৈরির জন্য ব্যবহৃত কাঁচামাল বা উপাদানের উপর মেটানো কর ফেরত পান ব্যবসায়ী। একই রকম ভাবে সংস্থা চালানোর জন্য নেওয়া যাবতীয় পরিষেবা বাবদ যে-কর দিতে হয়, ফেরত মেলে তা-ও। এর হাত ধরে নথিভুক্ত সংস্থাটির উৎপাদন খাতে খরচ, নথিভুক্ত না-হলে যতটা হতো তার তুলনায় ১৮% থেকে ২০% কমতে পারে।
এ ছাড়া, আগে একটি পণ্য বা পরিষেবার উপরে উৎপাদন শুল্ক, পরিষেবা কর, ভ্যাট, বিক্রয় কর ইত্যাদি বিভিন্ন রকম কর ও সেস গুনতে হত। জিএসটি-তে সেই ঝক্কি অনেকটাই কমার কথা।
নাম না লেখালে?
আগেই বলা হয়েছে, বছরে ব্যবসার অঙ্ক ২০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত হলে (কিছু রাজ্যে ১০ লক্ষ) জিএসটি নম্বর না-নিলেও চলে। কিন্তু বিশেষত দু’টি ব্যবসার মধ্যে লেনদেন চালায় যে সংস্থা, (বি-টু-বি) তার পক্ষে জিএসটি জমানায় নথিভুক্ত না-হয়ে ব্যবসা করাই দুষ্কর হতে পারে। এর কারণ—
• সংস্থা জিএসটি-তে নাম না-লেখালে, পণ্য ও পরিষেবার উৎপাদন খরচের মধ্যে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত পণ্য ও পরিষেবার কর বাবদ খরচ বা ইনপুট ট্যাক্স যোগ হবে। আর নথিভুক্ত না-হওয়ার দরুন তারা সেই কর পরে সরকারের কাছে দাবিও করতে পারবে না। ফলে ব্যবসার খরচ বইতে হবে বেশি। দাম বেশি রাখতে হবে পণ্যেরও। অথচ ইনপুট ট্যাক্স ক্রেডিটের আওতায় করের টাকা পুরো ফেরত পাওয়ার সুবিধা থাকায়, একই পণ্যের দাম তুলনায় কম রাখতে পারবে নথিভুক্ত সংস্থাগুলি। ব্যবসার খরচও বইতে হবে তুলনায় কম। এই হিসেব পর্যালোচনা করে দেখা গিয়েছে, নথিভুক্ত ও অ-নথিভুক্ত সংস্থার মধ্যে পণ্যের খরচে ফারাকের পরিমাণ হতে পারে ১৮ থেকে ২০ শতাংশ। সব মিলিয়ে যার জেরে প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকা কঠিন হবে অ-নথিভুক্তদের।
• জিএসটি-তে নথিভুক্ত নয় এমন কোনও সংস্থার থেকে যদি নথিভুক্ত সংস্থা পণ্য বা পরিষেবা কেনে, তবে তার জন্য ওই সরবরাহকারীর হয়ে রিভার্স চার্জ প্রকল্পের আওতায় জিএসটি দিতে হয় নথিভুক্ত সংস্থাকেই। এবং সেটাও পণ্য বা পরিষেবা কেনার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। যদিও তা পরে ইনপুট ট্যাক্স ক্রেডিট হিসেবে ফেরত মেলে। কিন্তু তৎক্ষনাৎ অতটা টাকা বার করতে হলে, একে তো টান পড়ে ব্যবসা চালাতে প্রয়োজনীয় কার্যকরী মূলধনে। তার উপর পরে তা ফেরত পেতে আবেদনের ঝক্কিও কম নয়। তাই এ সবের মধ্যে যেতে চায় না অনেকেই। অ-নথিভুক্ত সংস্থার তুলনায় কোনও নথিভুক্ত সংস্থার থেকে পণ্য বা পরিষেবা নেওয়াকে বেশি সুবিধাজনক মনে করছে তারা। যার প্রভাব পড়ছে অ-নথিভুক্ত সংস্থার ব্যবসায়। তাদের নগদের জোগান কমার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে ধীরে ধীরে বাজার হারানোর।
তবে গত ৬ অক্টোবর জিএসটি পরিষদের বৈঠকে রিভার্স চার্জ প্রকল্পটিকে আগামী ২০১৮ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যদিও তা প্রত্যাহার হয়নি।
কম্পোজিশন প্রকল্পের আওতায়
একটি অর্থবর্ষে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত ব্যবসা করলে, ছোট-মাঝারি সংস্থাগুলির জন্য কিছু বিকল্প সোজা নিয়মের বন্দোবস্ত রাখা হয়েছে জিএসটি-তে। উত্তর-পূর্বের কিছু রাজ্যের জন্য ওই সীমা ৭৫ লক্ষ। তবে শর্ত, ব্যবসা করতে হবে শুধু রাজ্যের মধ্যে। এটির নাম কম্পোজিশন স্কিম। সরকারের দাবি, এই প্রকল্পের আওতায় নাম লেখালে কিছুটা সুবিধা পাবেন ছোট ব্যবসায়ীরা। যেমন—
• এতে নথিভুক্ত ব্যবসায়ীদের জন্য জিএসটি-র হার ১%। উৎপাদনকারীদের দিতে হবে ২%। রেস্তোরাঁর জন্য ৫%।
• রিটার্নও তিন মাসে একবার দিতে হবে।
তবে কম্পোজিশন স্কিমের অসুবিধার জায়গায়ও রয়েছে কয়েকটি। এগুলি হল—
• ইনপুট ট্যাক্স ক্রেডিটের সুবিধা মিলবে না। ফলে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত পণ্য ও পরিষেবার খরচের উপর দেয় কর পণ্যের খরচের খাতে যোগ হবে।
• রিভার্স চার্জের আওতাতেও জিএসটি-তে নথিভুক্ত না-হওয়া সংস্থার থেকে কেনা পণ্য ও পরিষেবার জন্য কর বইতে হবে।
• জিএসটি বাবদ গোনা টাকা ক্রেতাদের থেকে উসুল করা যাবে না।
সমস্যা কোথায়?
কম্পোজিশন স্কিমের আওতায় নথিভুক্ত হওয়া বা না-হওয়ার সিদ্ধান্ত নির্ভর করে ব্যবসায়ী বা সংস্থার ইচ্ছে-অনিচ্ছের উপর। করের চাপ এখানে কম। তবে ইনপুট ট্যাক্স ক্রেডিটের সুবিধা না-পাওয়ায়, রিভার্স চার্জ পুরো বইতে হওয়ায় এবং জিএসটি-র খরচ ক্রেতাদের থেকে উসুলের পথ না-থাকায় পণ্যের পেছনে খরচ হয় বেশি। ফলে তা বেশি দামে বেচতে হয়। সাধারণ ভাবে নথিভুক্ত সংস্থা বা ব্যবসায়ীর তুলনায় যার পরিমাণ অন্তত ১৮ থেকে ২০ শতাংশ বেশি। যে কারণে এই প্রকল্পেও অ-নথিভুক্তদের মতো ব্যবসার নগদের জোগানে টান পড়ার আশঙ্কা থাকে। ভয় থাকে বাজারের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে না পারারও।
খেয়াল রাখুন
জিএসটি পরিষদ পরের বৈঠকে ছোট সংস্থার জন্য কিছু নিয়ম শিথিল করবে বলে জল্পনা। এগুলি হল—
• এখন ২০ লক্ষ টাকা বা তার কম ব্যবসা হলেও, পণ্য যদি অন্য রাজ্যে সরবরাহ করা হয় তবে জিএসটি-তে নাম লেখানো বাধ্যতামূলক। জিএসটি পরিষদের আগামী বৈঠকে এই নিয়ম তুলে নেওয়া হতে পারে।
• এখন সিজিএসটি অ্যাক্টের ৯(৩) ধারায় রিভার্স চার্জ প্রকল্পের আওতায় সংস্থা কিছু পরিষেবা নিলে জিএসটি দিতেই হয়। ফলে ২০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ছাড়ের সুবিধা পায় না তারা। জিএসটি নথিভুক্তি হয় বাধ্যতামূলক। তুলে নেওয়া হতে পারে এই নিয়মও।
সুতরাং...
জিএসটি-তে নথিভুক্ত না হওয়ার সুযোগ থাকলে, সেই সুযোগ নেওয়ার আগে দশবার ভাবুন। খতিয়ে দেখুন তাতে আপনার ব্যবসা করতে অসুবিধা হবে কিনা। একই কথা কম্পোজিশন স্কিমের ক্ষেত্রেও সত্যি।
লেখক কর বিশেষজ্ঞ
(মতামত ব্যক্তিগত)
পাঠকের প্রশ্ন
প্রঃ আমি লিকুইড ফান্ডে এসআইপি পদ্ধতিতে সঞ্চয় করতে চাই।?
উদয়ভানু সরকার, ঝাড়গ্রাম
চাইলে লিকুইড ফান্ডে এসআইপি করতেই পারেন। তবে আমার মনে হয় এটা করে খুব একটা লাভ হবে না। এর কারণ হল—
প্রথমত, লিকুইড ফান্ড খুব অল্প মেয়াদের হয়। নগদ টাকা বাড়ি বা সেভিংস অ্যাকাউন্টে ফেলে না-রেখে অনেকে এই ফান্ড কেনেন। যাতে কিছুটা বেশি সুদ মেলে, আবার চট করে প্রয়োজন মতো তুলে নেওয়ার সুবিধাও বহাল থাকে। কিন্তু এসআইপি হল অল্প অল্প করে দীর্ঘ মেয়াদে সঞ্চয়ের পথ। অত অল্প সময়ের জন্য এসআইপি করে লাভ কী? যে-কারণে এমন প্রকল্প বাজারে পাওয়া যাবে বলেও মনে হয় না।
দ্বিতীয়ত, এসআইপি-তে লম্বা মেয়াদে অনেক দিন ধরে জমানো যায় বলে ইকুইটি ফান্ডেই তা বেশি করা হয়। শেয়ার বাজারের ঝুঁকিও তাতে কম থাকে, আবার একটা বড় তহবিলও আস্তে আস্তে গড়ে উঠতে থাকে। কারণ শেয়ার বাজারের লগ্নিতে সব সময়েই চড়া রিটার্নের সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু লিকুইড ফান্ডের ক্ষেত্রে তহবিল লগ্নি করা হয় স্বল্প মেয়াদের ঋণপত্রে। ফলে সে দিক থেকে অল্প সময়ে বড় রিটার্নের সম্ভাবনা যে থাকছে, তা-ও নয়।
আপনি বরং বাজারে ভাল কোনও ইকুইটি ফান্ড সম্পর্কে খবরাখবর নিন। তার পর সম্ভব হলে তাতে অন্তত বছর পাঁচেকের একটা এসআইপি শুরু করুন। পাঁচ বছর পরে চাইলে মেয়াদ আরও বাড়িয়ে নিতে পারেন।
পরামর্শদাতা নীলাঞ্জন দে
পরামর্শের জন্য লিখুন:
‘বিষয়’, ব্যবসা বিভাগ,
আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা, পিন-৭০০০০১।
ই-মেল: bishoy@abp.in
ঠিকানা ও ফোন নম্বর জানাতে ভুলবেন না
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy