Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

‘আর কেউ এমন ঝুঁকি নেবেন না’, অনুরোধ শ্রমিকের

গত ২৪ জুলাই সাফাইয়ের কাজ করতে গিয়ে প্রায় ৭০ ফুট উঁচু জলাধার থেকে নীচে পড়ে যান নারায়ণবাবু।

হাসিখুশি: বাড়ি ফেরার আগে হাসপাতালে সস্ত্রীক নারায়ণ ঘোষ। মঙ্গলবার, পঞ্চসায়রে। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।

হাসিখুশি: বাড়ি ফেরার আগে হাসপাতালে সস্ত্রীক নারায়ণ ঘোষ। মঙ্গলবার, পঞ্চসায়রে। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।

নীলোৎপল বিশ্বাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ অগস্ট ২০১৯ ০১:৫৯
Share: Save:

সকাল থেকে তাঁর মুখে চওড়া হাসি। ২৭ দিন পরে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরছেন তিনি! পেটের মাঝ বরাবর ব্যান্ডেজ করা কাটা অংশটা এড়িয়ে কোনও মতে ট্রাউজার্স কোমরে গলিয়ে বললেন, ‘‘কত দিন রুই মাছের ঝোল খাই না।’’ পাশে দাঁড়ানো তাঁর স্ত্রীর মুখেও চওড়া হাসি। সামান্য থেমে এর পরে ৫৩ বছরের নারায়ণ ঘোষ বলেন, ‘‘এ যাত্রায় ডাক্তারবাবুরা বাঁচিয়ে দিলেন। আর কোনও দিন কাজ করতে পারব কি না, জানি না। তবে করলেও কোমরে দড়ি, মাথায় টুপি না পরে নয়। সে দিন দড়িটা কোমরে না বেঁধেই উপরে উঠে যাওয়া ভুল হয়েছিল!’’

গত ২৪ জুলাই সাফাইয়ের কাজ করতে গিয়ে প্রায় ৭০ ফুট উঁচু জলাধার থেকে নীচে পড়ে যান নারায়ণবাবু। সঙ্গী সোমনাথ দাসের সঙ্গে সে দিন তিনি রাজ্য সরকারের মৎস্য সমবায় সংস্থা ‘বেনফিশ’-এর পঞ্চসায়র চকগড়িয়া কমপ্লেক্সের একটি জলাধারে উঠেছিলেন। উঁচু জায়গায় নির্মাণকাজের জন্য মাথায় টুপি, কোমরে দড়ি বাঁধা-সহ নিরাপত্তার জন্য যা যা থাকার কথা, তার কোনওটাই ওই দু’জনের সঙ্গে ছিল না বলে অভিযোগ। পঞ্চসায়রের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যেতে সোমনাথবাবুকে মৃত ঘোষণা করা হয়। সেখানেই সঙ্কটজনক অবস্থায় এত দিন ভর্তি ছিলেন নারায়ণবাবু। হাসপাতালের চিফ এগজিকিউটিভ অফিসার সুদীপ্ত মিত্র এ দিন বলেন, ‘‘অত উঁচু থেকে পড়ে পেট ফেটে পেটের ভিতরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বাইরে বেরিয়ে এসেছিল নারায়ণবাবুর। বাঁ পায়ের মালাইচাকি এবং হাতেও গভীর ক্ষত ছিল। দীর্ঘ অস্ত্রোপচার এবং প্লাস্টিক সার্জারিতে রোগীর শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ জোড়া দেওয়া গিয়েছে।’’

তবে ওই ঘটনার জেরে শহরের উঁচু নির্মাণস্থলে কাজ করতে যাওয়া কর্মীদের সুরক্ষা-বিধি না মানার পুরনো চিত্রটাই সামনে আসে। নির্মাণ সংস্থাগুলির সংগঠন ‘ক্রেডাই’-এর প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য সুশীল মেহতাও বলেন, ‘‘কর্মীদের কোমরে দড়ি বেঁধে কাজ করা এবং মাথায় হেলমেট থাকা বাধ্যতামূলক। এ ছাড়াও কর্মীদের গায়ে গেরুয়া বা হলুদ রঙের চকচকে পোশাকও থাকার কথা। যাতে দূর থেকে তাঁদের দেখা যায়। বেনফিশের ওই কমপ্লেক্সে এই সব কিছুই মানা হয়নি সম্ভবত।’’ নির্মাণ সংস্থাগুলির সঙ্গে যুক্তদের আরও প্রশ্ন, পুর প্রশাসন উঁচু নির্মাণস্থলে কাজ করার কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম বেঁধে দিলেও ছোট বা মাঝারি নির্মাণ সংস্থাগুলি সেই নিয়ম মানছে কি না, বা কর্মীদের তা মানতে বলছে কি না, সেটা দেখবে কে? এ প্রশ্নের কোনও স্পষ্ট উত্তর মেলেনি পুলিশ বা প্রশাসন কারও কাছেই। যেমন ভাবে বেনফিশ চিকিৎসার পুরো খরচ দিলেও নারায়ণবাবুর ভবিষ্যতের আয়ের সংস্থান কী হবে, সে ব্যাপারেও কোনও স্পষ্ট উত্তর নেই।

বাবাকে হাসপাতাল থেকে নিতে এসে নারায়ণবাবুর ছোট মেয়ে ঝুমা অবশ্য বলেন, ‘‘হুঁশ ফিরে বাবা বলেন, কোমরে বেঁধে নেওয়ার জন্য দড়ি দেওয়া হয়েছিল সে দিন। দড়ি মাটিতে ফেলেই বাবা বাঁশের ভারা বেয়ে উপরে উঠে গিয়েছিলেন।’’ ওই অবস্থায় ভারা ভেঙে সোমনাথবাবু নারায়ণবাবুর উপরে পড়েন। এর পরে দু’জনেই মাটিতে।

ওই ঘটনার আর কিছুই প্রায় এখন মনে করতে পারেন না নারায়ণবাবু। মেয়ে ঝুমা এবং স্ত্রী গীতার কাঁধে ভর দিয়ে কালীঘাটে নিজের বাড়িতে ঢোকার মুখে শুধু বলেন, ‘‘নতুন জীবন ফিরে পেয়েছি। আর কেউ এমন ঝুঁকি নেবেন না।’’

শহরের নির্মাণস্থলগুলিতে ঝুঁকি নিয়ে কাজের চিত্রটা কি বদলাবে? প্রশ্ন থেকেই যায়!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Narayan Ghosh Accident
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE