E-Paper

অনেক ইতিহাস মিলিয়ে পড়া

চার বছর আগে অমলেশ ত্রিপাঠীর জন্মশতবর্ষে বর্তমান গ্রন্থের সঙ্কলক শৈবাল মুখোপাধ্যায় তাঁর অগ্রন্থিত রচনাগুলির গুরুত্বের কথা বলেছিলেন।

অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০২৫ ০৮:২৫
একত্র: মহাত্মা গান্ধী, সুভাষচন্দ্র বসু, বল্লভভাই পটেল, জওহরলাল নেহরু প্রমুখ। হরিপুরা কংগ্রেস অধিবেশনে।

একত্র: মহাত্মা গান্ধী, সুভাষচন্দ্র বসু, বল্লভভাই পটেল, জওহরলাল নেহরু প্রমুখ। হরিপুরা কংগ্রেস অধিবেশনে।

ভাবনার বৈচিত্র ও গবেষণার বৈদগ্ধে অমলেশ ত্রিপাঠীর ইতিহাস-চর্চার অনন্যতা অজানা নয়। অর্থনৈতিক ইতিহাস, রাজনৈতিক ইতিহাস, সাংস্কৃতিক ইতিহাস, ধর্মভাবনার ইতিহাসকে তিনি আধুনিক ভারতের প্রেক্ষিতে সাজিয়েছেন তাঁর ইংরেজি ও বাংলা গ্রন্থগুলিতে, এমনকি দেশে ও বিদেশে ইতিহাস রচনার ইতিহাসকে বিশেষ ভাবে পর্যালোচনা করেছেন তাঁর নানা বইয়ে। তাঁর এই বাংলা রচনার সঙ্কলন তাঁর ভাবনার সেই বিস্তীর্ণ দিগন্ত উন্মোচন করল।

চার বছর আগে অমলেশ ত্রিপাঠীর জন্মশতবর্ষে বর্তমান গ্রন্থের সঙ্কলক শৈবাল মুখোপাধ্যায় তাঁর অগ্রন্থিত রচনাগুলির গুরুত্বের কথা বলেছিলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁরই তত্ত্বাবধানে এই গ্রন্থ পাঠকের কাছে এল। এখানে ৫৩টি লেখা, বারোটি অংশে ভাগ করা। ভাগগুলি বিষয়ভিত্তিক, কালানুক্রমিক নয়। স্বভাবতই বৈচিত্র, সাময়িকতা ও বৈদগ্ধের সমাহারে এক অভূতপূর্ব বিশ্লেষণ মেলে এই বিভাগগুলিতে, কিছু ক্ষেত্রে কালাতিক্রমণের সমস্যা থাকা সত্ত্বেও। বারোটি ভাগ এই রকম: বঙ্গভঙ্গ ও কার্জন, স্বাধীন ভারত ও গণতন্ত্র, কংগ্রেসের ঐতিহ্য ও অবক্ষয়, স্বাধীনতা সংগ্রামে ত্রয়ী অর্থাৎ গান্ধী, নেহরু ও সুভাষ, ঐতিহাসিকের মূল্যায়ন, ইতিহাসের আলোকে তিন যুগপুরুষ অর্থাৎ চৈতন্য, রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দ, বাংলা সাহিত্যে দুই পথিকৃৎ বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথ, সমাজ-সাহিত্য-সংস্কৃতি, ইতিহাসে কলকাতা, পূর্বসূরিদের স্মরণ, এবং ব্যক্তিগত স্মৃতিকথা। এখানে স্থানাভাবের জন্য মাত্র কয়েকটি লেখাই কেবল বেছে নেওয়া যেতে পারে। প্রথম ভাগের ‘একের পর এক ঢেউ’ রচনাটিতে ভারতে ১৯৩০-এর রাজনৈতিক অস্থিরতা (পূর্ণ স্বরাজ, ডান্ডি অভিযান, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন), অর্থনৈতিক বিপর্যয় (বিশ্বব্যাপী মন্দা), ধর্মভাবনার পরিবর্তন (উপনিষদ ও সুফি কেন্দ্রিক উপলব্ধি), নৃতত্ত্ব ও মনস্তত্ত্বের বিশ্বব্যাপী অভিঘাত (মন ও মননে আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে বুদ্ধিদীপ্ত সেন্সিবিলিটি-র সংমিশ্রণ) এবং দেশ-বিদেশে তার সাহিত্যিক প্রতিফলন (বিদেশে এলিয়টের কাব্যে, গোর্কি, লরেন্স ও হামসুনের উপন্যাসে, বাংলায় জীবনানন্দ, বিষ্ণু দে ও সমর সেন প্রমুখের কাব্যে)। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসকে এই ভাবে মিলিয়ে পড়ার প্রচেষ্টা সত্যিই অভিনব।

স্বাধীন ভারতের সাফল্য ও ব্যর্থতার আলোচনায় অমলেশবাবু আশা ও নৈরাশ্যের দ্বন্দ্বে দীর্ণ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নতুন রাজনৈতিক নেতাদের হাতেই ছেড়ে দেন এক দায়— “অনেক পুরোনো শিবোলেথ ভুলে, অনেক স্বার্থ ত্যাগ করে, সংহত গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, প্রগতিমুখী একবিংশ শতাব্দীর ভারত সৃষ্টি করার দায়।” পরে আবার যোগ করেন, “আমাদের প্রত্যেককেই নিতে হবে স্বাধীনতা সার্থক করার ভূমিকা” (‘স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর’)। যে কথা বললেন ‘কংগ্রেস, ঐতিহ্য ও প্রাপ্তি’ প্রবন্ধে সে কথা বোধ হয় আজ সব রাজনৈতিক দলকেই বলা যায়— “কংগ্রেসকে ফিরে যেতে হবে সুনীতির মূলে। ফরাসি কবি ও দার্শনিক শার্ল পেগির (১৮৭৩-১৯১৪) ভাষায়— সবচেয়ে বড় বিপ্লব— নীতির বিপ্লব।”

‘গান্ধী-নেহরু, ঐতিহ্য আধুনিকতা’ রচনায় আবার দেখি অন্য এক ভাবনা প্রতিফলিত, ভারত-ইতিহাসের ভাবনা। গান্ধী যদি হন ঐতিহ্য তথা প্রবহমানতার প্রতীক, তবে নেহরু আধুনিকতা তথা পরিবর্তনের। গান্ধী চাইছিলেন ঐতিহ্যের ‘উৎসমুখে ফিরে যেতে, নেহরু চাইছিলেন এর নিরুদ্ধ স্রোতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ধারা বইয়ে দিতে’। নেহরুর এই ভাবনার পিছনে তিনি যতটা না মার্ক্সকে দেখেন, তার থেকে বেশি দেখেন ‘শ’কে, টনিকে, উইলিয়াম মরিসকে, হয়তো বা গান্ধীকে’। ‘চিরবিদ্রোহী দেশনায়ক’ প্রবন্ধে লিখেছেন সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে— “নব্যহিন্দুত্ব, বিবেকানন্দ, অরবিন্দ, চিত্তরঞ্জন— এই পরম্পরায় রচিত হয়েছে তাঁর ভাবাদর্শ বা রোল মডেল।” প্রশ্ন করেছেন, “যখন দেশভাগের পক্ষে কংগ্রেসের সব বড় নেতাই চলে গেছেন, গান্ধী একান্ত একা, তখন কি তিনি এই বীর কিন্তু ভাগ্যহত য‌োদ্ধাকে পাশে পেতে চাননি?”

প্রবন্ধ সংকলন

অমলেশ ত্রিপাঠী, সম্পা: শৈবাল মুখোপাধ্যায়

১২৫০.০০

আনন্দ

ইতিহাস রচনার ইতিহাস নিয়ে চিরকাল ছিলেন সচেতন অনুসন্ধানী, তাই আধুনিকও, তবুও অমলেশবাবু ফরাসি বিপ্লবের দু’শো বছর পূর্তির সময় প্রশ্ন করলেন, আজও “আবেগ, উচ্ছাস, পক্ষপাত যদি এত প্রবল থাকে, সত্যকার সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে কবে?” (‘সেদিন আশার বসন্ত হতাশার শীত’)। তিনি জানেন বিপ্লবের জন্ম থেকেই বিতর্কের জন্ম, জানেন কার্লাইল, তকভিল, তেইন ও মাতিয়ের মতামত। জানেন আনাল পত্রিকার এক সংখ্যায় (১৯৬৯) একে বুদ্ধিজীবীর বিপ্লব আখ্যাও দেওয়া হয়েছে। তবু তিনি বিশ্বাস করেন, ফরাসি বিপ্লব মিথ নয়। লেফেভরের ‘দ্য গ্রেট প্যানিক’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ফরাসি বিপ্লব অকারণে হয়নি আর অর্থহীনও নয়। এই বিপ্লব “দেশে দেশে যে স্বাধীনতার আগুন লাগিয়েছিল তা আজও অনির্বাণ। ফরাসি তথা অন্য দেশীয় সাম্রাজ্যবাদের সবচেয়ে বড় শত্রু।”

অমলেশবাবুর বিশ্লেষণে স্বামী বিবেকানন্দের ধর্মপ্রচার অভিনব। তাঁর “শিকাগো ভাষণ শুধু সনাতন ধর্ম দর্শন (যাকে লিবনিজ় পেরিনিয়াল ফিলসফি আখ্যা দিয়েছেন)-এর পুনরুক্তি ছিল না, ছিল পশ্চিমি সভ্যতার উত্তরে আধুনিক ভারতের প্রতিক্রিয়া।” (‘সনাতন ধর্মের প্রচারক: নবীন ধর্মের প্রবক্তা’)। প্রবন্ধটির শেষে রোম্যাঁ রোল্যাঁর উদ্ধৃতি, “মার্কস ও লেনিন বিবেকানন্দের এই মহৎ বাণীটি দাবী করতে পারতেন, ‘একমাত্র সেই বাঁচে, যে সকলের মধ্যে বাঁচে’”।

আঠারো বছর বয়সে প্রেসিডেন্সি কলেজের ম্যাগাজিনে (১৯৩৯) তিনি লেখেন রবীন্দ্রনাথের ঘরে বাইরে উপন্যাস নিয়ে। প্রমথ চৌধুরীর মতটিকেই তিনি সমর্থন করেন যে নিখিলেশ হচ্ছে প্রাচীন ভারতবর্ষ, সন্দীপ নবীন ইউরোপ এবং বিমলা বর্তমান ভারতের প্রতিভূ। কিন্তু সন্দীপ বিমলা ও নিখিলেশের মনস্তত্ত্বের ব্যাখ্যায় অমলেশবাবু ছিলেন অভিনব। সন্দীপের তিনটি পরাজয় লক্ষ করেন। প্রথম, অবিমিশ্র লোভের একটা সীমা আছে। দ্বিতীয়, তাঁর দর্শনবাদে বস্তুকে বিশ্ববিজয়ী মনে করা হয়েছিল। তৃতীয়, সন্দীপ বিমলার ভুল ভাঙা প্রত্যাশা করেনি। সেই তুলনায় বিমলার অন্তর্দ্বন্দ্ব এই যে, সে ভুল বুঝতে পেরেও ভুল করে। আর নিখিলেশের মধ্যেও ছিল উভয় আমির দ্বন্দ্ব। তাঁর এক আমি প্রাচীন খ্যাতি, আর এক আমি সর্বহারা বিরহী। তাঁর প্রথম আমি লেখককে আকর্ষণ করে না, দ্বিতীয় আমি তাঁকে ব্যথিত করে গেলে। তা ছাড়া, তর্ককালে নিখিলেশের যে পরিচয় পাওয়া যায় তা সজীব নয়, শুষ্ক। তাই সন্দীপ-নিখিলেশের কথা কাটাকাটি কোথাও গভীর নয়। “বিমলার সঙ্গে আপন সম্বন্ধকে একটি সুকঠিন ভালর ছাঁচে ঢালাই করিবার মধ্যে (নিখিলেশের) জবরদস্তি ছিল, এই জুলুমের জন্য তাহারা পৃথক হইয়া গিয়াছিল।” খুবই আশ্চর্য মন্তব্য, বিশেষত আঠারো বছরের এক যুবকের পক্ষে।

‘ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার সংস্কৃতি’ প্রবন্ধে বাংলার নবজাগরণের পুনর্বিচার করে তিনি গুরুতর প্রশ্ন তুলেছেন: কেন ভাঙা যতটা হল, গড়া ততটা হয়নি? বলেছেন, বঙ্কিমের কাছে মূল সমস্যা ছিল সমাজের মধ্যে ব্যক্তির স্থান নির্ধারণের সমস্যা— সেই সূত্রেই তাঁর নীতিবাদ। এই নীতিতে যদি ব্যক্তিত্বের আপন বিকাশ ক্ষুণ্ণ হয়, তা হলেও সমাজের কল্যাণে, এমনকি ব্যক্তির কল্যাণেই, তা মেনে নিতে হবে।

সঙ্কলকের ভূমিকাটি ছোট, কিন্তু রচনা ও তার প্রকাশ সংক্রান্ত নানা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সম্বলিত। অমলেশ ত্রিপাঠীর বাংলা গ্রন্থের ও বাংলা রচনার একটি পঞ্জি সংযোজনও করেছেন। কিন্তু এর সঙ্গে একটি বিস্তৃত সম্পাদকীয় ভূমিকাও কি প্রয়োজন ছিল না এই সঙ্কলনে? নানা সময়ের লেখা, আপাতদৃষ্টিতে বিচ্ছিন্ন প্রবন্ধগুলিকে তা হলে একসূত্রে বাঁধা যেত। অমলেশবাবুর অগ্রন্থিত ইংরেজি লেখাগুলি প্রকাশের সময় এমন ভূমিকার সংযোজনে এই অপূর্ণতা দূর হবে, আশা করি।


(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Netaji Subhas Chandra Bose mahatma gandhi jawaharlal nehru Sardar Vallabhbhai Patel

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy