এক কালে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রজীবনী গবেষকদের প্রধান অবলম্বন ছিল, তাতে তথ্যের সঙ্গে কবিসান্নিধ্যের নৈকট্য হেতু জীবনীকারের ব্যক্তিগত মতামতও আমরা পাই। এটা যেমন পাঠকের এক বিশেষ পাওনা, আবার কখনও প্রতিবন্ধকও। রবীন্দ্রজীবনী-র চারটি খণ্ডে সব তথ্যই অভ্রান্ত, এমন দাবিও সঙ্গত হবে না। পরবর্তী কালে বস্তুনিষ্ঠ গবেষণায় তা ধরা পড়েছে, ধরা পড়েছে রবীন্দ্র-গবেষকদের অজস্র রচনায়। তবে ১৯৮২ থেকে প্রশান্তকুমার পালের রবিজীবনী পাঠকদের মস্ত সহায় হয়ে উঠল। বস্তুনিষ্ঠতা ও নৈর্ব্যক্তিক গবেষণার অসামান্য দৃষ্টান্ত রবিজীবনী-র খণ্ডগুলি। ২০০৩-এ তার নবম খণ্ডটি বেরোয়। তার পরেই প্রশান্তকুমার অসুস্থ হয়ে পড়েন, ২০০৭-এ তাঁর প্রয়াণ। দশম খণ্ডের অনেকটা কাজ তিনি করে রেখেছিলেন, শঙ্খ ঘোষের পরামর্শে অভীককুমার দে সে কাজ সম্পূর্ণ করে ২০২৪-এর মে মাসে সেই খণ্ডটি প্রকাশ করেছেন। এতে ১৩৩৩-৩৫ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের জীবন-তথ্য আমরা পেয়েছি। প্রশান্তকুমার সাহিত্যরস এড়িয়ে তথ্যের উপর জোর দিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু রচনার গুণে পাঠকের কাছে কখনও তা শুষ্ক লাগে না, ক্লান্তিকর তো নয়ই।
রবিজীবনী স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার দীর্ঘ একুশ বছর পর বিজন ঘোষাল রবিজীবন শীর্ষক গ্রন্থের সূচনা ঘটালেন। ১৩৩৩ বঙ্গাব্দ থেকেই তাঁর যাত্রা শুরু। ধরনটা প্রশান্তকুমার-অনুগামী। অনুপুঙ্খ তথ্যের সমাহার। আমাদের আলোচ্য রবিজীবন (১৩৩৭-১৩৩৮)-এর তৃতীয় খণ্ড।
রবীন্দ্রনাথ ক্ষিতিমোহন সেনকে বলেছিলেন, “আমার লেখার চেয়ে কম হবে না আমার চিঠি। প্রত্যেকের কাছে আমার স্টাইল ভিন্ন। কিছুতেই একজনকে অন্যের লেখা স্টাইলে লিখতে পারি নে।” কবির চিঠিপত্র নিয়ে যাঁরা কাজ করেছেন তাঁরা জানেন এ কথার গূঢ় মর্মার্থ। বিজন ঘোষাল রবিজীবন রচনার আগে রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্র বিষয়ে বিস্তর গবেষণা করেছেন। বস্তুত তাঁর রবিজীবন-এর মুখ্য অবলম্বন কবির বিপুল পত্রসম্ভার। অবশ্যই তাঁর গবেষণায় অন্য বহু সূত্রের অন্বেষণও আছে— রবীন্দ্রভবনে রক্ষিত অজস্র দলিল তিনি ঘেঁটেছেন, কিন্তু চিঠির ব্যবহার চোখে পড়ার মতো। আগেই জানিয়েছি, তাঁর গবেষণার রীতি-প্রকরণ প্রশান্তানুসারী, তবে তিনি আরও অনুপুঙ্খে যেতে চান। রবীন্দ্রনাথের জীবনের প্রতিটি দিনের খবর পাঠককে জানাতে চান। কবির প্রাত্যহিক জীবনচর্যা সর্বদা ঘটনাবহুল, কিন্তু সব তথ্যই তো ইতিহাসের বিচার্য নয়। তথ্যের ঝাড়াই-বাছাই ইতিহাসবিদের অবশ্যকর্তব্য।
আলোচ্য খণ্ডটি শুরু ফ্রান্সের অতিথিবৎসল আলবার্ত কাহনে-র অতিথিশালায় রবীন্দ্রনাথের জীবনের ঘটনাপুঞ্জ দিয়ে। এ কথা আমাদের জানা, ১৯৩০-এ কবির শেষ ইউরোপ-সফর। সফরটি নানা কারণে গুরুত্বময়। চিত্রশিল্পী রবীন্দ্রনাথের বিদেশের মাটিতে আত্মপ্রকাশ। দ্বিতীয়ত, অক্সফোর্ডে হিবার্ট বক্তৃতামালায় রিলিজিয়ন অব ম্যান পাঠ। তৃতীয়ত, রবীন্দ্রনাথের রুশভ্রমণ। ১৯৩০-এর ২ মার্চ থেকে ১৯৩১-এর ৩১ জানুয়ারি— প্রায় এক বছর নানা স্থানে ঘুরে, আমেরিকা থেকে দেশে ফেরেন।
প্যারিসে অনুষ্ঠিত হয় রবীন্দ্রনাথের চিত্রপ্রদর্শনী। ১২১টি ছবি ছিল। প্রদর্শনীর মুখ্য উদ্যোক্তা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো বিষয়ে কবি প্রতিমাদেবীকে ২ মে-র চিঠিতে জানাচ্ছেন, “ভিক্টোরিয়া যদি না থাক্ত তাহলে ছবি ভালোই হোক্ মন্দই হোক্ কারো চোখে পড়ত না।... খরচ কম হয়নি— তিন চার শো পাউন্ড হবে, ভিক্টোরিয়া অবাধে টাকা ছড়াচ্ছে। এখানকার সমস্ত বড়ো-বড়ো গুণীজ্ঞানীদের ও জানে— ডাক দিলেই তারা আসে।” প্রদর্শনী সম্পর্কে ফরাসি নামী সংবাদপত্রে লেখা হল, “টেগোর রিভিলস টু আস আ স্ট্রেঞ্জ বিউটি, নট অব ফর্ম অর অব কালার বাট অব সিম্বলিজ়ম— অব ম্যাজিক অলমোস্ট।” ৬ মে (২৩ বৈশাখ) প্যারিসের ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন রবীন্দ্রনাথের সত্তর বছরে পদার্পণ মহাসমারোহে পালন করে। ১৯৩১-এ দেশে ফেরার পর বিপুল সমারোহে সত্তর বছর-পূর্তি পালিত হয়। প্রকাশিত হয় দ্য গোল্ডেন বুক অব টেগোর।
ফ্রান্স থেকে লন্ডনে পৌঁছে হিবার্ট বক্তৃতার আগে রবীন্দ্রনাথ বার্মিংহামে কোয়েকারদের আমন্ত্রণে একটি জরুরি ভাষণ দিয়েছিলেন। ওই কালপর্বেই স্বদেশে গান্ধীজির আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হয়। বিজন ঘোষাল তাঁর গ্রন্থে আইন অমান্য আন্দোলন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের প্রতিক্রিয়ার কথা কিছু কিছু বিক্ষিপ্ত ভাবে জানিয়েছেন। বিশেষ করে ২৬ মে রথীন্দ্রনাথের কাছে লেখা চিঠি— “কাগজে নিশ্চয় দেখেচিস গান্ধি বলেচেন তিনি এদের রফানিষ্পত্তির রাস্তা খুলতে চান না। তিনি বোধ-হয় ভাবছেন নুন নিয়ে ঠেলাঠেলি করতে করতেই ভারতবর্ষ স্বাধীন হবে। একটুও ভালো লাগ্ল না। নিছক একগুঁয়েমি করে পলিটিক্সের দরজা কোনো দেশেই খোলে নি।” স্পষ্টতই লবণ সত্যাগ্রহকে পছন্দ করেননি কবি— এ কথা বোঝা যাচ্ছে। প্রাচ্য-প্রতীচ্যের শ্রেষ্ঠ মানুষদের মিলনে রাজনৈতিক প্রতিকার সম্ভব— এটা কবির চিরকালীন মত হলেও লর্ড আরউইনকে ‘বেস্ট টাইপ অব ইংলিশ জেন্টলম্যান’ (অক্সফোর্ড মেল পত্রিকায় ব্যক্ত কবির মত) বলা— ইত্যাদি বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের অবস্থান এবং গান্ধীর অবস্থান দীর্ঘ বিশ্লেষণের দাবি রাখে। বিজন ঘোষাল সে-কাজটি না করে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত কিছু তথ্য সরবরাহ করেছেন। পাঠক খানিকটা বিভ্রান্ত বোধ করতে পারেন।
রবিজীবন ৩ (১৩৩৭-১৩৩৮)
বিজন ঘোষাল
৬৫০.০০
দে’জ়
আদ্যন্ত তথ্যনিষ্ঠ এই গবেষণায় লেখক জানাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথের বহু রচনা এখনও গ্রন্থভুক্ত হয়নি, পত্রপত্রিকায় ছড়িয়ে আছে। তেমনই একটি রচনা ‘নবীন কবি’, বুদ্ধদেব বসু সম্পর্কে দীর্ঘ প্রবন্ধ। নিবন্ধটি অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ অথচ এখনও অগ্রন্থিত। রবিজীবন-কারের এ ধরনের অভিযোগ বা পর্যবেক্ষণ কেবল এই একটিমাত্র ক্ষেত্রে নয়। রবীন্দ্রনাথের বহু রচনা বিষয়ে আমরা এ রকম উক্তি পাচ্ছি। কিন্তু সে-পর্যবেক্ষণ বাস্তবিক তথ্য নয়। ‘নবীন কবি’ গ্রন্থভুক্ত পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রকাশিত রবীন্দ্র-রচনাবলী’র (ফেব্রুয়ারি ২০০০) পঞ্চদশ-ক খণ্ডে। ১৯৩১ সালে অল বেঙ্গল মুসলিম স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনে প্রদত্ত ভাষণ সঙ্কলিত হয়েছে রবীন্দ্র-রচনাবলী’র (মে ২০০৪) পঞ্চদশ-খ খণ্ডে। ওই খণ্ডেই পাওয়া যাবে ওই একই সময়ে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ-এর সংবর্ধনার উত্তরে কবির অভিভাষণ। হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশের মহাভারতম্ বিষয়ে কবির ‘একখানি মহাভারত’ নিবন্ধ ওই পঞ্চদশ-খ খণ্ডেই রয়েছে। সাইকোঅ্যানালিসিস বিষয়ে সরসীলাল সরকারকে লেখা চিঠিটি অবশ্য বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগের আলস্যে চিঠিপত্র সিরিজ়ে সংবদ্ধ হয়নি। শুধু এই চিঠি নয়, কবি লিখিত হাজার হাজার চিঠি এখনও অগ্রন্থিত। সে-কাজটি অবশ্য বিজন ঘোষাল নিষ্ঠাভরে করে চলেছেন। এই গ্রন্থেও তার নজির আছে।
লেখক-প্রদত্ত কয়েকটি তথ্য বেশ উপভোগ্য। যেমন, সুরেন কর ও রমার (সন্তোষচন্দ্র মজুমদারের কন্যা) সমস্যাবহুল বিয়েতে রবীন্দ্রনাথ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়কে চিঠি লিখে বিবাহে পৌরোহিত্য করতে অনুরোধ করেন। শেষ পর্যন্ত সুনীতিকুমারকে অবশ্য সে-কাজ করতে হয়নি। আর একটি ঘটনাও চিত্তাকর্ষক। ১৯০৫ সালে চিত্তরঞ্জন দাশের বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ একটি ছোট লাল রঙের খাতা দেখে গান গেয়েছিলেন এবং ভুলক্রমে খাতাটি ফেলে এসেছিলেন। বাসন্তীদেবী সেই খাতা ফেরত দেন রবীন্দ্রনাথের সত্তর বছর পূর্তি উৎসব উপলক্ষে আয়োজিত এক প্রদর্শনীর সময়। আর একটি তথ্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৩১-এর ২ মার্চ কবি অমলচন্দ্র হোমকে চিঠিতে জানাচ্ছেন, তিনি এখন পোস্ট-কার্ডে চিঠি লিখছেন ডাকঘরে দারোগাদের দুঃখ নিবারণের জন্য। ১৯৩১-এ কবি সরকারের কাছে সন্দেহভাজন। গান রচনাকে যে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সৃষ্টির সর্বোত্তম কাজ বলে মনে করতেন, এ বিষয়ে ১৯৩১-এর ১ জুলাই ধূর্জটিপ্রসাদের কাছে লেখা কবির এই কথাগুলি এখন বিশেষ প্রাসঙ্গিক: “গান পরের কণ্ঠ নির্ভর করে। যে মানুষ রচনা করে সে তাকে জন্ম দেয় মাত্র, যে মানুষ গায় সেই তাকে হয় বাঁচায় নয় মারে।... এই কারণবশতই আমার স্নেহটা বেশি আমার গানের পরেই।”
গ্রন্থের ভূমিকা-নিবন্ধে বিজন যথার্থ লিখেছেন, “গবেষণা হল ধারাবাহিক বিবর্তন প্রক্রিয়া।” সংযোজন-সংশোধন অবিরাম ঘটতে থাকবে। রবিজীবন তেমনই এক প্রয়াস। তবে এই গুরুত্বপূর্ণ কাজে মুদ্রণপ্রমাদ যাতে এড়ানো যায় তার প্রতি বিশেষ সতর্কতা প্রয়োজন। comitte(পৃ ৮১), depresion (৯৮), dreems (১৩৫) বা আউটট্রাম (২১৬), ভগৎ সি (২১৯)— এমন অসংখ্য প্রমাদ গোটা বইটিতে ছড়িয়ে। ব্যক্তিনাম মণীন্দ্রকুমার মণীন্দ্রনাথ ঘোষ হলে (৩৫৮) বা এতদ্সত্ত্বেও ‘এতত সত্ত্বেও’ (৩৫৮) হলে চোখে বড় লাগে। আর ‘বক্তব্য রাখেন’ (২৮) কি বাংলা ভাষায় চালু হয়েই গেল!
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)