E-Paper

কথকতার হাত ধরে ইতিহাস

তাম্বুলি সমাজের মানুষ বড়ায়িনন্দন তাম্বুলচর্চা আর কথকতা দু’টিকে মিলিয়ে কাশীপুরের রাজা সিংহদেবের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিলেন।

গোপা দত্তভৌমিক

শেষ আপডেট: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১০:১৯

ঐতিহাসিক উপন্যাস কাকে বলে তা নিয়ে বিস্তর মতান্তর। তাম্বুলি-আখ্যান উপন্যাসের নিবেদন অংশে বিশ্বজিৎ রায় এটিকে ঐতিহাসিক উপন্যাস বলতে চাননি, কারণ মুখ্য চরিত্রগুলির নামধাম পাথুরে ইতিহাসে নেই। তিনি জানিয়েছেন, রাজনীতি এই উপন্যাসের উপজীব্য। পাঠকের কিন্তু মনে হয় রাজনীতির পথ ধরেই পুরুলিয়ার প্রায়-অনালোচিত, অথচ মূল্যবান ইতিহাস এই উপন্যাসের আষ্টেপৃষ্ঠে এমন ভাবে জড়িয়ে আছে যে, ঐতিহাসিক উপন্যাসের কোঠায় এই বইকে অবশ্যই রাখা যায়। ঘটনাপট কাল থেকে কালান্তরে ঘাট ছুঁয়ে ছুঁয়ে চলেছে। অনতিদূর অতীত ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে আখ্যানের উন্মোচন, পরের পরিচ্ছেদে ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে তার এগিয়ে আসা, তার পর কখনও এগিয়ে কখনও পিছিয়ে শঙ্খিল বিন্যাসে কাহিনির চলন। উপন্যাসের কেন্দ্রে আছে একটি বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায় শিল্পকলা— কথকতা।

তাম্বুলি সমাজের মানুষ বড়ায়িনন্দন তাম্বুলচর্চা আর কথকতা দু’টিকে মিলিয়ে কাশীপুরের রাজা সিংহদেবের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিলেন। মিঠা পানের সঙ্গে নানাবিধ সুগন্ধি সুস্বাদ উপকরণ দিয়ে সরস খিলি বানিয়ে এগিয়ে দেওয়া এবং পাশাপাশি পুরাণ আখ্যানের বর্ণময় কথকতা শোনানো— বড়ায়িনন্দনের বিশিষ্ট শিল্পকলাটি বড় মনোরম। কিন্তু নিম্নবর্ণের মানুষের পুরাণচর্চা এবং রাজসুহৃদ হয়ে ওঠা সঙ্কীর্ণমনা অহঙ্কারী ব্রাহ্মণ কাত্যায়নের পক্ষে সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়ে। উপন্যাসের এই অংশে সামন্ততন্ত্রী জীবনচর্যার অনুপুঙ্খ বর্ণনা বিশেষ কালের আবহটিকে সার্থক ভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। ঔপন্যাসিকের লিখনশৈলী এখানে তৎসম শব্দবহুল, কিঞ্চিৎ মন্থর আবার বিশ শতকে আখ্যান ঝাঁপ দেওয়ার সময় ভাষায় এসেছে দ্রুতগতি, সচেতন ভাবে তৎসম শব্দ কমিয়ে দিয়েছেন। বড়ায়িনন্দনের কথকতায় নিপুণ ভাবে উদ্ভাসিত রাধাকৃষ্ণলীলার নাটকীয় খণ্ডাংশ, সময় যেন থমকে আছে মধ্যযুগে। অন্য দিকে, নতুন কাল ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে মানভূমের সদর শহর ‘পুরুল্যা’য়। শ্বেতাঙ্গরা গোটা ভারতকেই নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে তখন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের শেষ পর্বের ছবিতে আকস্মিক বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহ। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ঈর্ষায় উন্মাদ কাত্যায়ন সস্ত্রীক বড়ায়িনন্দনকে বড় বীভৎস ভাবে জীবন্ত দগ্ধ করে পথের কাঁটা সরিয়েছে। তার চোখে ব্রাহ্মণভূম স্থাপনের অলীক স্বপ্ন। তবে মৃত্যুর আগে অনাথ বালক বেণুমোহনের মধ্যে বড়ায়িনন্দন সঞ্চারিত করে গিয়েছেন কথকতার উত্তরাধিকার।

প্রথম থেকেই চৈতন্যদেব ও তাঁর প্রচারিত প্রেমধর্ম এই উপন্যাসে একটি শক্তিশালী প্রভাব হিসেবে কাজ করেছে। পাশাপাশি ঝঙ্কার তুলেছে লোক-ঐতিহ্যের ঝুমুর গান। কাত্যায়নের বিপরীতে আছেন উদারহৃদয় নীলাম্বর চক্রবর্তী— নামগোত্রহীন মেধাবী বালক বেণুমোহনকে যিনি ব্রাহ্মণ পরিচয় দিয়েছেন। কৃষ্ণবর্ণা আদিবাসী নারী মঙ্গলার কাছে বেণুমোহন শিখেছে মাটির তৈরি পাখি বাঁশিতে আশ্চর্য সুর তোলা। বড়ায়িনন্দনের শারীরিক অক্ষমতা হেতু দুঃখী ছিল তাঁর স্ত্রী নয়নতারা। মঙ্গলা শুধু তার দাসী নয়, সুখী। দুই সুখীর একটি ঘনিষ্ঠ চুম্বনের দৃশ্যে সাহসী সমকামের ইশারা রয়েছে। সংলাপের ব্যাপারে ঔপন্যাসিক কত যত্নশীল ও সতর্ক তার উদাহরণ বইটিতে ছড়ানো। সিংহদেবের কনিষ্ঠা রানি যখন অন্য দুই রানিকে ডেকে বলেন, ‘বসো গো বুনেরা’, কিংবা নীলকর সাহেব জ্যাকসনের মেয়ে এমিলি অপরিচিত কাত্যায়নকে জিজ্ঞাসা করে, ‘তুমি কেটা? তোমার বাটী কোথায়?’ পাঠক যেন উচ্চারণের বিশেষ সুর শুনতে পায়।

তাম্বুলি-আখ্যান

বিশ্বজিৎ রায়

৪৫০.০০

ধানসিড়ি

আদ্রা শহরের রেলস্টেশন যুগান্তরের সঙ্কেতবাহী। এখানেই তরুণ শিক্ষক কাঙালিচরণের সঙ্গে বেণুমোহনের পরিচয়। কাঙালিচরণ নতুন যুগের মানুষ, কলকাতার নবজাগরণের দূত। ঔপনিবেশিক শাসকের আমদানি করা চা-সংস্কৃতির বিপরীতে তিনি তাম্বুল-সংস্কৃতিকে স্থাপন করে দেশজ ঐতিহ্যের প্রসার ঘটাতে চান। তাঁর প্রতিটি কাজের পিছনেই কাজ করে প্রগাঢ় স্বাদেশিকতা, বেণুমোহন যে তা খুব বুঝতে পারেন তা নয়। তবু দু’টি মানুষের সখ্য তৈরি হয়। তাম্বুলখানা গড়ে তুলে বেণুমোহন বড়ায়িনন্দনের ধারাকে বহমান রাখার চেষ্টা করেন। কাঙালিচরণের সূত্রে তাঁর হাতে আসে রবিবাবুর ‘মানসী’— নতুন যুগের কবিতা, যার ভাব ও ভাষা বেণুমোহনের কাছে অচেনা। সাংস্কৃতিক পটবদলের ছবিটি বিশ্বাজিৎ সন্তর্পণে নির্মাণ করেছেন। তাম্বুলখানায় কথকতার আদর ক্রমেই কমতে থাকে, তা হয়ে ওঠে আড্ডা গল্পগুজব ও পান খাওয়ার জায়গা। এই ভবিষ্যৎ আশঙ্কা করেই কি নিজের ছেলে পতিতপাবনকে কথকতায় দীক্ষা দেননি বেণুমোহন? পতিতপাবন বরং মুগ্ধ ছিল তার মা নিস্তারিণীর মুখের সহজ গল্পকথায়। অবশেষে তাম্বুলখানা বন্ধ হয়ে যায়, আর পিতার এই সিদ্ধান্ত মেনে না নিতে পেরে ক্রোধে স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে পিতৃগৃহ ত্যাগ করে পতিতপাবন। অনাথ বেণুমোহনের মধ্যে কোথাও একটি গভীর বৈরাগ্য ছিল। সংসারের সঙ্গে তার বন্ধন আলগা।

পতিতপাবন চলে আসে পুরুলিয়া শহরে। এই সূত্রে উপন্যাসে ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে ওই অঞ্চলের বিশিষ্ট রাজনৈতিক পরিস্থিতি জীবন্ত হয়ে উঠেছে। মানভূমের গান্ধীরূপে পরিচিত নিবারণচন্দ্র দাশগুপ্ত, বিখ্যাত মুক্তি পত্রিকা, দেশের জন্য নিবেদিতপ্রাণ এক দল নরনারী, স্বদেশি শিল্পীর উদ্যোগ, খদ্দর ভান্ডার— সব মিলিয়ে ভারী বাস্তব সেই ছবি। সরাসরি ইতিহাসের তথ্য পতিতপাবনের পরিবারের গল্পের সঙ্গে চমৎকার মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে। সাধারণ মানুষের দেশাত্মবোধের উদ্দীপনার সঙ্গে সুর মিলিয়ে স্থাপিত হয়েছে পতিতপাবনের স্বদেশি ভান্ডার। শুধু দোকান নয়, যেন একটি আদর্শের রূপায়ণ। অন্য দিকে, স্বাধীনতার আগে থেকেই যা শুরু হয়েছিল, তা পরে উগ্র চেহারা নিয়েছে— মানভূমের বাংলাভাষীদের উপর বিহার কংগ্রেসের জোর করে হিন্দি চাপানোর চেষ্টা। এই আগ্নেয় পরিস্থিতিতে অধুনা বিস্মৃত লোকসেবক সঙ্ঘ যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল ইতিহাসের অবহেলা সরিয়ে ঔপন্যাসিক তা তুলে এনেছেন। পুরুলিয়া পশ্চিমবঙ্গে এল, কিন্তু তত দিনে ঘুণ ধরে গেছে রাজনৈতিক ব্যবস্থার। যাঁরা এক কালে আদর্শবাদী ছিলেন তাঁদের মধ্যেও দেখা গেল ক্ষমতার লোভ, দুর্নীতি। টুসু সত্যাগ্রহের একটি গান আছে উপন্যাসে, ‘শুন বিহারি ভাই তোরা রাখতে লাইরবি ডাং দেখাই।’ আদ্যন্ত আদর্শপরায়ণ রাজনৈতিক কর্মী বিধুভূষণের মনে হয়েছে যে ক্ষমতায় যায় সে-ই ডাং দেখায়। আধুনিক লোভনীয় পণ্যের প্রবল চাপে স্বদেশি ভান্ডারও বন্ধ হয়ে গেছে। পতিতপাবনের ছেলে দীনু জীবিকার দায়ে খুলেছে পান-সিগারেটের দোকান। রুচিবদল ও পটবদলের সূক্ষ্ম ইঙ্গিতগুলি আখ্যানের ভাঁজে ভাঁজে বিন্যস্ত।

১৯৮৬ সালের পুরুলিয়া শহরে পরিবর্তিত দৃশ্যপটের কেন্দ্রে আছেন জে কে কলেজের ভাবুক ও চিন্তক অধ্যাপক প্রবোধবাবু আর তাঁর সংস্কৃতিমনস্ক বন্ধু ও ছাত্ররা, আছে বালক নিরুপম— যার অভিজ্ঞতায় হয়তো বিশ্বজিতের পুরুলিয়ায় কাটানো অল্পবয়সের স্মৃতি সঞ্চিত আছে। এই উপন্যাস ধাত্রীভূমিকে দেওয়া তাঁর শ্রদ্ধা আর ভালবাসার অঞ্জলি। পুরুলিয়ায় প্রান্তিকতার সমস্যা আজও মেটেনি। এই জেলার গৌরবময় ইতিহাসকে তুলে এনে ঔপন্যাসিক একটি জরুরি কাজ করেছেন। আদিবাসী ভূমিপুত্রের সংস্কৃতি আর মূলধারার সংস্কৃতি কি আজ সেখানে যুযুধান হবে— এই প্রশ্ন তুলে বিশ্বজিৎ প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়, মেলানোর সুরে আস্থা রেখেছেন। উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে মনে পড়ল কলকাতার বিলুপ্ত ঐতিহ্যকেও পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চলছে এখন— যুগোপযোগী করে। এমন কয়েকটি আসরে যাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে সম্প্রতি। সেখানেও ঐতিহ্য অনুসরণে কথক ও শ্রোতা-দর্শকদের জন্য বাটা-ভরা পানের খিলি থাকছে কিন্তু।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Review

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy